তীব্র ধিক্কার ওদের জন্য
ঘটনাটি ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৬ তারিখে ঘটেছিল। আমি তখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ি। কলেজ হোষ্টেলে থাকতাম। আমাদের হোষ্টেল থেকে একটু দূরেই রেলওয়ে ষ্টেশন ছিল। আমরা কয়েক বন্ধু মাঝে মাঝেই বিকেলবেলা রেললাইনের ধার দিয়ে হেঁটে আসতাম।
গাইবান্ধা রেলষ্টেশনের একটু দূরেই বেশ বড় একটি ব্রীজ আছে। আমরা ওই ব্রীজের কাছে গিয়ে বসে থাকতাম। তো সেদিন বিকালে আমি ও আমার বন্ধু পিয়াল ওই ব্রীজের কাছে গিয়ে বসে গল্প করছিলাম। সেই সময় ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী তিস্তা এক্সপ্রেস গাইবান্ধা ষ্টেশনে আসে এবং ২ মিনিট পরেই ষ্টেশন ছেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আমি ঠাট্টা করে পিয়ালকে বললাম আয় দোস্ত লাইনে মাথা দেই।
দেখি কেমন লাগে। ওই বলে আগে তুই ঢাকা থেকে ঘুরে আয় তারপর একদিন মাথা দিব (সেদিন রাতের বাসে আমার ঢাকায় আসার টিকিট কাটা ছিল)। যাই হোক আমরা দুইজনেই ট্রেনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এমন সময় আমি লক্ষ্য করলাম এক বয়স্ক মহিলা ও একজন যুবতী (কোলে বাচ্চা ছিল) ব্রীজটি পার হতে শুরু করলো। আমরা দুইজনেই এমন চমকে গিয়েছিলাম যে তাদেরকে বাঁধাও দিতে পারি নাই।
এদিকে ট্রেনও প্রায় চলে এসেছে। তবে গভীর স্বস্তি বোধ করলাম যখন দেখলাম ট্রেন ব্রীজে উঠার পরই ওরা দুইজনেই ব্রীজ নিরাপদেই পার হলো। আমরা তো দুইজনেই মনে মনে ওদেরকে একটু গালাগালি করলাম এইরকম ঝুঁকি নেয়ার জন্য। ট্রেন যখন চলে গেল তখন আমি কি মনে করে যেন ট্রেনের গমনপথের দিকে তাকালাম। দেখি রেললাইনের মাঝখানে কি যেন পড়ে আছে।
ব্রীজের অপর প্রান্তে একজন লোক তুমুল গতিতে ওই জিনিসটার দিকে দৌড়াচ্ছে। আমিও কিছু না বুঝেই তার পিছু পিছু দৌড় দেই, আমার পিছনে পিয়ালও দৌড়ায়। কাছে গিয়ে যা দেখলাম তা কোনদিন ভোলা সম্ভব হবেনা। আমরা দেখলাম ওই যুবতী মেয়েটি রেললাইনের মাঝখানে পড়ে আছে। তার ডান পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাইনের আরেক পাশে পড়ে আছে।
মেয়েটি তখনো জীবিত ছিল। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য যা ছিল তা হলো তার কোলের বাচ্চা মেয়েটি। বাচ্চা মেয়েটির শরীরের দিখন্ডিত অংশ দেখে আমরা কেউই চোখের পানি আটকাতে পারিনাই। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি দৌড়ে রেলষ্টেশনে এসে ষ্টেশন মাষ্টারকে বললাম, একজন আত্নহত্যা করার চেষ্টা করেছে আপনারা কিছু করেন কারন উনি তখনো বেঁচে ছিলেন।
ষ্টেশন মাষ্টার আমাকে জানান যে, উনাদের পক্ষে ওই মুহূর্তে কিছু করা সম্ভব না কারন আরো একটি ট্রেন আসবে। তাই ওরা উল্টো আমাকে দায়িত্ব নিতে বললেন। ওদের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না দেখে আমি আবার ঘটনাস্থলে ফিরে আসি। এসে দেখি আশেপাশের মানুষজন এগিয়ে এসেছে। কিন্তু কেউ ওই মহিলাকে ধরছেনা।
আমি নিজেও সাহস পাইনি তাকে ধরার। বেশ অনেকক্ষন পর কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ ভ্যান নিয়ে এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা দুইজনও ওদের পিছু পিছু যাই। ততক্ষনে ওনার পরিচয় বের হয়ে এসেছে। উনি ওনার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে রাগ হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসে আত্নহত্যা করার চেষ্টা করেন।
শুনে খুব খারাপ লেগেছিল।
যাই হোক, হাসপাতালে তাকে পৌঁছে দিয়ে আমরা হোষ্টেলে ফিরে আসি। ততক্ষনে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি গোসল করতে যাই। বাথরুমের আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই কেমন যেন ভয় লেগেছিল।
ঠিক সেইসময় গেল কারেন্ট, আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা কিন্তু আমি আয়নায় স্পষ্ট দেখলাম বাচ্চা মেয়েটি আমার হাত ধরে আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি বাথরুমের দরজা খুলে বের হয়ে আসি। আমার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরেছিল। এখনো আমি মাঝে মাঝে অন্ধকারে ঐ বাচ্চাটার চেহারা দেখি। এ এক দুঃসহ স্মৃতি।
সে রাতে আমি একা বাসষ্ট্যান্ডে আসতে পারি নাই। আমার কয়েকজন বন্ধু আমাকে বাসে তুলে দিয়েছিল। ওই বাচ্চাটার চেহারা ভোলার নয়। অনেক সুন্দর ছিল মেয়েটা।
ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে জানতে পারি ওই মহিলা মারা গিয়েছিলেন ২ দিন পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে।
যদি তাকে দ্রুত চিকিৎসা দেয়া যেত তাহলে হয়ত উনি বেঁচে যেতেন।
পরিশেষে শুধু এইটুকুই বলব, দাম্পত্য কলহ সংসারে থাকবেই, কিন্তু এই রকম পরিনতি আমাদের কারোরই কাম্য নয় এবং এক্ষেএে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।