অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
তেমন বড় কোনো পরিবর্তন আসে নি জীবনে, অন্তত যেখানে গেলে বলা যায় আমূল বদলে গেছে জীবনের রং, তেমন পরিবর্তন আসে নি, পরিবেশগত কিংবা উপলব্ধিগত কোনো পরিবর্তন আসে নি জীবনে। সুতরাং সেই পুরোনো কাসুন্দি ঘাটা যায় এই অবসরে।
কয়েকদিন আগে পড়া একটা বাক্যের অনুবাদ করবার চেষ্টা করেছিলাম, সঙ্গম শেষে বিছানায় নির্জীব পড়ে থাকা মানুষটাই স্বামী। আদতে কথাটা এতটা সাধারণ ভাবে বলা যায় না হয়তো, স্বামী শব্দের সাথে যতটা অধিকারবোধ এবং পূজ্যতা বিদ্যমান, এই ন্যুজ্ব অস্তিত্বে সেটা নেই।
সেখানে হাস্যকর ভাবে উত্থানরহিত একটা অবস্থা বিদ্যমান।
এবং সেটাই হয়তো জীবনের ট্রাজেডী। আমাদের চিরচারিত সম্পর্ক যাপনে পারস্পরিক যৌনাকর্ষণ ক্রমশ ফিকে হয়ে যাওয়া একটা সময়ে আমরা দাম্পত্যে প্রবেশ করি। আমাদের এই পর্যায়ে যাওয়ার আগে একটা রহস্যময় সময় কাটে। দীর্ঘ সময়ের জুটি দেখেছি আমরা, জীবন বীমার বিজ্ঞাপনের জুটির মতো, তারা এখনও কি অলৌকিক ভাবে একই রকম রোমান্টিক।
তাদের এই পারস্পরিক আকর্ষণের রহস্য উদঘাটন করতে পারি না, আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় হয়তো এটার ব্যখ্যা সম্ভব নয়।
সম্পর্ক বদলাচ্ছে, মানুষ এবং মানুষের সম্পর্কে পরিবর্তন আসছে, মানুষ অনেক আগের ধ্যানধারণ বাদ দিয়ে এখন সীমিত ভাবে হলেও রোমান্টিক। সেটা পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কামনা, ভালোবাসা আকর্ষণ সব মিলিয়েই একটা বাস্তবতা।
বাঙালী অন্তত প্রেম করতে শিখেছে কিংবা প্রেমউপভোগ করতে শিখেছে এইসময়ে এসে। পূর্বতম ধারণায় যৌথ পরিবারের স্ত্রীর চরিত্র বর্তমানে নেই, গ্রামে পরিবেশ কেমন আমার জানা নেই, আমি শহুরে মানুষ, নিদেনপক্ষে মফস্বলী মানুষ, গ্রাম আমার কাছে তেমন আবেদনময় নয়, আমার গ্রামের অভিজ্ঞতা কয়েক ঘন্টা থেকে এক রাত্রি যাপনের বেশী কিছু নয়। সেই সীমিত অভিজ্ঞতায় গ্রামীণ দাম্পত্যকথা বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় মোটেও।
শহুরে মানুষ, বিশেষত ঢাকার বাসিন্দা হয়ে থাকা দীর্ঘ ১৮ বছরে মাঝের সামান্য প্রবাস বাদ দিলে, বাঙালী প্রেম শিখছে, নারী কিংবা মেয়েরা পরিবারে এবং সংসারে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করতে শিখেছে। শরৎচাটুজ্যের মেয়েরা এই সময়ে অচলআনি।
যৌথ পরিবারের কাঠামো কিংবা সেই সময়ের কাঠামোতে হয়তো এটাই বাস্তবতা ছিলো, স্বামী সকালে উঠিবেন, কোনো রকমে প্রাতঃরাশ সেরে জীবিকার সন্ধানে বেরুবেন, দিনান্তে বন্ধুর বাসার বৈঠকখানায় মজলিস সেরে কিংবা নিজের বৈঠকের মজলিস সমাপ্ত করে প্রদীপ নির্বাপনের আগে মশারীর আড়ালে প্রবেশ করিবেন, ইত্যবসরে নারীর প্রাত্যহিক জীবন সমাপ্ত, সারাদিনের পরিশ্রম শেষে শ্বাশুরী ননদ জা পরিবেষ্ঠিত সময় কাটিয়ে একান্ত সময়ে স্বামীসহচার্য উপভোগ করিবার সময়টাতে ঘর অন্ধকার, টিমটিমে আলোতে দাম্পত্য উপভোগ করা কিংবা সংসার পরিকল্পনার সুযোগ হয়তো তেমন থাকতো না, নারী যে মুহূর্তে নিজের কথা বলবার অবসর পেয়েছে সঙ্গমবিরতিকালীন সময়ে সে সময়ে গৃহকর্তা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এই চিত্রটাই পাওয়া গেলো ক্যাসানোভার ভাষ্যে, নারী তোমাকে সব উজার করে দিবে, তুমি যদি তাকে নিয়ে খেলতে চাও, তার কথা শুনো, মনোযোগ দিয়ে নারীদের কথা শুনে, বিনিময়ে তারা সবকিছু উজার করে দিবে।
এই অভিজ্ঞতায় বলীয়ান হয়েই ক্যাসানোভা একই বিছানায় তিন বোনকে নিয়ে শুয়ে আছেন এবং তিনজনের সারাদিনের নানারকম কথা শুনছেন।
সবারই নিজেকে উজার করে দেওয়ার প্রয়োজন পরে, তাই বৈঠকী মজলিসে নিজের ভেতরের সব কথা বলে নিশ্চিত বিছানায় ঘুমকাতর স্বামী, স্ত্রী নিজের কথা বলবার অবসর পায় না স্বামীকে। এইসব প্রায় স্বামীসংসর্গবিহীন নারীদের সাথে ক্যাসানোভার নিত্য উঠাবসা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রেম, নারী, সে অনেক নারীর সাথেই প্রেম ছিলো আমার, সংখ্যাটা কখনও হিসেব করে দেখি নি, বুঝলে, হবে হাজার খানেক নারী।
এই চিরায়ত পরিস্থিতি বদলেছে , ফ্ল্যাট কালচারের যুগে, যেখানে আর আড়াল নেই, শ্বাশুরী ননদ জা পরিবেষ্ঠিত বৈরী সময় নেই। নারী নিজের একাকীত্বে ক্লান্ত হয়ে চাকুরীরতা, সেটাই সম্ভবত ভালো, সেখানেও নারীর নিজস্ব মুক্তি ঘটে, কিন্তু কয়েকদিন আগে হঠাৎ যেমন এক বান্ধবীর কাছে শুনালাম, মাঝে অনেক দিন কথা হয় নি, যোগাযোগ ছিলো না, তাই দীর্ঘ অযোগাযোগের পরে যখন প্রথম কথা হলো, বললাম তুমি কি শেষ করেছো পড়াশোনা?
কবে শেষ হয়েছে,
এখন কি করো?
আমি এখন হোমমেকার।
নিজের বেকারত্বকে চমৎকার একটা নাম দিয়েছো, এর বাইরে আর কিছু বলতে পারলাম না।
এক পূত্র সন্তানের জননী হয়েছে, স্বামীর সাথে এখনই চলে যেতে হবে, সুতরাং স্বামীর নাম ছাড়া অন্য কিছুই জানা হলো না,
পরে ফোন দিবো, এর বাইরে আর কিছুই বলার থাকলো না আমার।
হোম মেকার এই নারীদের সময় কাটানোর উপকরণ কি? সাজানো বাসাকে প্রতিদিন নতুন করে সাজানো, সোফা আর পর্দার কাপড় বদলানো, আলাদা আলাদা করে সব কিছু কেতামোতাবেক মিলিয়ে সাজিয়ে রাখা সংসার।
সন্তানের স্কুল আছে, সেই অবসরে নারীর করণীয় কি?
এই জায়গাটাতেই আসলে দাম্পত্যের পরিবর্তনটুকু ধরা যায়। অনেক আগের সময়ে, এমন কি ২০ বছর আগের মানুষেরাও এটাই মেনে নিয়েছিলো, তাদের সারাদিন স্বামীর প্রতীক্ষায় থাকতে হবে, বিছানায় একান্ত সঙ্গমকালীন সময় ব্যতীত তাদের স্বামীসঙ্গ পাওয়া হবে না এটা মেনে নিয়েই নারী আনন্দিত ছিলো।
এর পরই আসলো টিভি আর বিজ্ঞাপনের যুগ, নারী নিজের অধিকার সচেতন হয়ে উঠলো।
নারী এখন এই অল্প শাররীক মিলনে তৃপ্ত নয়, তাদের আরও বেশী কিছু চাই। তারা স্বামীর সঙ্গ চায়, এবং এ কারণে তারা নিজেদের চাহিদা প্রকাশ করে, প্রকাশের ধরণ হয়তো বদলায়, কিন্তু নিয়মিত সঙ্গমের বাইরে যেটুকু সময় নারী দাবী করে সেটুকু দেওয়াটাই বোধ হয় উচিত।
তোমার তো আমাকে দেওয়ার মতো সময় নেই, বিছানার বাইরে একান্তে বসে কতটুকু সময় কাটিয়েছো আমার সাথে। অথচ বাস্তবতার সাথে কল্পনার মিলমিশ ঘটে না। আমি তখন সেইসব জীবন বীমা কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের দম্পতিদের কথা ভাবি, তারা এই বয়েসেও নিজেদের একান্তে পাওয়ার জন্য কোনো কোনো সন্ধ্যায় একাকী নির্জন রাস্তায় ঘুরছেন, রিকশা চেপে, কিংবা কোনো নদীর বাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসে সূর্যাস্ত দেখছেন, গভীর রাতে সঙ্গমনিরত দম্পতি হয়তো এক সাথে বাতিল কোনো হিন্দি সিরিয়াল দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন।
আমি অবাক হই।
যদিও আমার উপভোগ্যতার সাথে এটা মিলে না, কিন্তু তারা দিব্যি আনন্দে আছে, এত খুতখুঁতে শুচিবাই নিয়ে হয়তো বেঁচে থাকা কষ্টের।
উপদেশ হয়তো নিজেকেই দেওয়া যায়, তবে এই সমস্যা সার্বজনীন, সেটার প্রবাস ও দেশের গন্ডী মানে না। রোমান্টিক দম্পতি সারা বিশ্বেই একই রকম, যারা পরস্পরকে নিয়মিত সময় দিচ্ছেন, যারা একান্ত পারিবারিক সময়টা উপভোগ করছে। হয়তো দুজনকেই কিছুটা রুচি ও চাহিদায় ছাড় দিতে হচ্ছে।
এরপরও এই পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে তারা এইসব ছাড় দিয়েও আনন্দিত।
আজ থেকে ১০ বছর পরে হয়তো এইসব প্রবাদতূল্য হয়ে যাবে, আমি তোমার সাথেই বৃদ্ধ হতে চাই, আই ওয়ানা গ্রো অল্ড উইথ ইয়্যু গানের শব্দগুলোর কোনো অর্থ থাকবে না।
রোমান্টিক হয়ে উঠতে না উঠতেই সম্পর্কে ফাটল ধরবে।
অধিকার সচেতন নারী খুব সহজেই বুঝতে পারে এই অবহেলা। তারা নিজেরা যতটুকু প্রাধান্য কিংবা সময় চাইছে সেটা দিতে অপরাগতা হয়তো কোনো সম্পর্ককেই থিতু হতে দিচ্ছে না।
দুজনের ভেতরে হয়তো কোনো সমস্যা নেই, তেমন কোনো স্পষ্ট বিরোধও নেই। এরপরও সম্পর্ক আলগা, তেমন রসায়ন নেই, যেটাতে সম্পর্কের বুনিয়াদ শক্ত হয়, সম্পর্ক দানা বাধবার মতো তেমন কোনো রসায়ন নেই বলেই বিশ্বজুড়ে এত এত ম্যাচমেকিং কোম্পানী, ১০ পয়েন্ট ২৪ পয়েন্ট ক্যাটাগোরী ম্যাচিং, আমাদের এখানে যারা বিয়ে করে, যাদের আমরা জুটি ঠিক করে দেই, তারা আজীবন একত্রে সুখে শান্তিতে বসবাস করে, এই বিজ্ঞাপনেও অনেক রকম ম্যাচিংয়ের বক্তব্য আছে।
আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি এই বিজ্ঞাপনের ভাষা। সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ আছে , দাম্পত্য সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, ম্যারেজ কনসালটেন্ট, এইসব আধুনিক এবং প্রয়োজনীয় পেশার মূল বক্তব্য সামান্যই। প্রতি বছর বেস্ট সেলার তালিকায় রয়ে যায় এই বইগুলো, কিভাবে সম্পর্কে সফল হবেন, সম্পর্ক সফল করবার ১০টি অব্যর্থ উপায়।
এবং এসবের প্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয়তা, বিভিন্ন কেসহিস্ট্রী এবং মানসিকতা বিশ্লেষণ।
মূলত সমস্যা না থাকলেও যে সমস্যাটা সব সময়ই থাকে, আমাদের পারস্পরিক সমঝোতার অভাব, আমাদের নিজস্ব কোনো আলোচনা নেই, আমাদের স্বাভাবিক কোনো বাক্য বিনিময়ের সুযোগ নেই। আমরা একই ছাদের তলায় থাকি, প্রতিদিন একই বিছানার দুপাশ দিয়ে নামি, নেমে পাশাপাশি বাথরুমে ঢুকে যাই, কিংবা তুমি আগে আমি পরে সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে নিজের ধান্দায় ঘুরি পরজীবি শহরে।
সেখানে থেকে বিধস্ত হয়ে ফিরে আসি সন্ধ্যায় , আমাদের কর্পোরেট শোষনে শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি থাকে না ভালোবাসবার। এমন ক্লান্তপ্রাণের কাছ ভালোবাসা বাঞ্ছা করা এবং মনোযোগ চাওয়া খুব একটা সহজ নয়।
আমিতো সারাদিন তোমার অপেক্ষায় থাকি, এই সময়টুকুর অপেক্ষায় থাকি, তুমি আসবে, অথচ তুমি ঘরে ফিরে চুপচাপ বসে থাকো টিভির সামনে, কোনো জায়গায় স্থির থাকো না, চ্যানেলের পর চ্যানেল বদলাও, তোমার কিসের এত অস্থিরতা?
এইসব গল্পের ভেতরে আসলে তেমন থিতু হওয়ার বিষয় নেই। সুতরাং খিটমিটে সময়টুকু নিজেই নিজেকে সামলে রাখা।
পরিস্থিতি রোমান্টিক? না মোটেও না, অথচ কর্পোরেট দাসত্বের আগে আসলে এটাই বুঝে নেওয়া প্রয়োজন, আমাদের কি প্রয়োজন একটা চমৎকার জীবন না দাসজীবন। আমাদের সময় উপভোগ করা প্রয়োজন জীবন উপভোগ করা প্রয়োজন, এবং সেটা মানসিক ও শাররীক ভাবে, নাকি আমাদের জীবনের উপভোগ্যতার পরিমাপ হবে অর্থ বিত্ত?
উপভোগ্য জীবনের খোঁজে আছি। একটু নিজস্ব সময়, সে সময়ে নিজে ভাবতে পারবো, নিজের সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটাতে পারবো।
এবং ঠিক এই সময়টাতেই, এই একান্ত সময়টাতেই বায়না, আমার কিছু কথা ছিলো বলবে বলে কেবল তোমায়-
এবং তখন কোথা থাকে অন্ধকার ট্রাম ধেয়ে আসে, অন্যমনস্ক আমি ট্রামের ধাক্কায় ছিটকে পড়ি , এবং ক্রমশ অন্ধকারে ঢেকে যাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।