আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানুষগুলো না বলে চলে যাচ্ছে কেন?



আমি গ্রামের মেয়ে। গ্রামেই বড় হয়েছি। এমন পরিবারে জন্ম যে বড় কোন স্বপ্ন দেখাও মানায় না। ছোট বেলায় পড়াশুনায় মোটামুটি ভাল ছিলাম বলে বাবু (বাবা) আমাকে নিয়ে নিজে তো স্বপ্ন দেখা শুরু করলেনই আমার মনেও বুনে দিলেন সেই স্বপ্নের বীজ। বাবু তার মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন।

তারপর সেই বড় কিছু হবার স্বপ্নকে লালন করতে করতে এস.এস.সি. পাশ করলাম। তার পর বাবা চাইলেন আমি ঢাকায় পড়াশুনা করি। কিন্তু আমি একটু বোকা-সোকা । বাবুর আহ্লাদী মেয়ে। একা একা আমি কিকরে ঢাকায় থাকব? রাস্তায় বের হলে আমি তো দু-পা এগিয়ে আর দু-পা পেছনের ঠিক জায়গাটায় পৌঁছাতে পারবনা।

কি করা? ঢাকায় পিসির বাসা আছে। পিসেমশাই উকিল মানুষ। যদিও ওকালতি ছেড়ে দিয়ে ব্যাবসা করছেন এখন। ভরসা দিলেন তারা। তারপর প্রথম প্রথম বাবু নিজে এ-কলেজ সে-কলেজ দৌড়ালেন।

তা, উনি নিজেও তো ঢাকায় থাকেন না। চেনেন না সব। চাকুরীজীবী মানুষ, সময় কম। পিসেমশাই ই ভরসা। সাথে করে নিয়ে যেতেন বাবুকে আর আমাকে।

কলেজে ভর্তি হবার পরও একাজ সেকাজ। পিসিদের বাসাতেই ছিলাম ২-৩ মাস। পরে হলে সীট পেয়েছি। কলেজ জীবনের পর ভর্তি পরীক্ষা। নাহ, ডাক্তার হতে পারলাম না।

আমি যেন ভেঙ্গে না পড়ি সেদিকেও পিসেমশাইয়ের খেয়াল। বোঝাতেন সব চাওয়া পূরণ হয় না। বলতেন, তুই খারাপ করলে আমার দুর্নাম হবে, আর তুই ভাল কিছু করতে পারলে তা আমারই গৌরব। এখন যে ভার্সিটিতে পড়ছি তার ফরম নেয়া থেকে শুরু করে ভর্তি করা সবই নিজে আমাকে সাথে নিয়ে করেছেন। আমি এমনিতে অসুস্থ হই কম।

কিন্তু একটু অসুস্থ হলে সহ্য করতে পারি না। কখনো অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখানো, ঔষধ আনা, এমনকি সময়মত ঔষধ খাওয়ানো সব পিসেমশাই করতেন। বাবু তো গ্রামে থাকেন। তাঁর দায়িত্বটুকু পিসেমশাই পালন করতেন। বলতেন, আমি তো তোর বাবার মতই রে! আমি যেন পিসিমার চাইতে তাঁর কাছেই বেশী আদর পেয়েছি।

কিছুদিন আগে (১৫-২০দিন হবে হয়তো) একটা শার্ট গিফট করেছিলাম পিসেমশাইকে। মজা করে বললেন, ''আরে তুই কি আমারে গিফট করস, এখনো পড়াশুনাই শেষ হয় নাই, আমি তোরে বিয়া দিমু, তোর বরের কাছ থেইকা গিফট নিমু। '' না, তিনি আমার পড়াশুনা শেষ না হতেই চলে গেলেন। আর কি আশ্চর্য ! আমার দেয়া শার্টটা পরেই শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করলেন! খবরটা আমি পেয়েছি দেরীতে। বাসায় পৌঁছে শেষ দেখাটাও দেখতে পারলাম না।

বেঁচে থাকতে তিনি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেকের জন্যই যথাসাধ্য করেছেন। তাঁর ছোট ছোট ছেলে দুইটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আমার সে সাধ্য নেই যে ওদের সান্ত্বনা দেব, সে যোগ্যতা এখনো নেই যে ওদের জন্য কিছু করব। পিসিমা সৌখিন মানুষ। সাজগোজ খুব পছন্দ।

তাঁরও তো বয়স তেমন বেশী নয়। সেই পিসিমার পরনে এখন সাদা থান। লাল রঙ এখন থেকে তাঁর জন্য নিষিদ্ধ। আমার সহ্য হচ্ছে না। পিসেমশাইকে হারিয়ে মনে হচ্ছে আমার জীবনের অনেক বড় একটা অবলম্বন হারিয়ে ফেলেছি।

আর আমাকে 'নায়িকা' বলে কেউ ক্ষ্যাপাবে না, কেউ বলবে না ''তোর নায়ক খুঁইজা পাওয়া যাইতেছে না''। আমি সত্যি সত্যি ক্ষেপে যেতাম, আর এখন মনে হচ্ছে কী ছেলেমানুষীই না করতাম! এখন আর কেউ হঠাৎ ডেকে বলবে না ''ওই মাইয়া, তুই দিন দিন ছোট হইয়া যাইতেছিস ক্যান? কালা মাইয়া, তোরে বিয়া দিমু ক্যামনে?'' যাকে ভরসা করে আমার ঢাকায় আসা, আমার শিক্ষাজীবনে বাবা-মায়ের পর যার অবদান সবচেয়ে বেশী, চলার পথে যার দিকনির্দেশনা আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তিনি চলে গেলেন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। কয়েক মাস আগে হারিয়েছি আরেকজন প্রিয় মানুষকে। শেষ দেখাটুকুও দেখা হয়নি দুজনের কাউকেই। একটু একটু করে যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।

ভাল লাগে না আর। সবাই এমন না বলে চলে যাচ্ছে কেন?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।