বিশাল শ্যাওড়া গাছটার তলায় মৃত্যুশয্যায় এক মুহূর্তের জন্য দাদাকে একা পেয়েছিলাম। ‘দামড়া ভূত তুই পালতে পারবি না, শুভ, এদের খাই অনেক--দেখ, এখন আমাকে কেমন খাচ্ছে। ' দাদার মৃত্যু নিয়ে কিছু কানাঘুষা শুনেছিলাম। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, ওসব বিশ্বাস করতে নেই। 'ছোট গাছ কিনিস, ছোট ভূত,’ দাদার ফিসফিসে কণ্ঠস্বর এখনও কানে ভাসে।
সম্ভবত ওটাই ছিল কারও উদ্দেশ্যে দাদার শেষ কথা। আর সেটা যে আমার প্রতি এক প্রকার ওছিয়ত ছিল এতদিনে তা বুঝতে পারছি।
বংশপরম্পরায় ধরে আমরা ছিলাম ভূত লালন-পালনকারী। কিন্তু দাদার মৃত্যুর পর সেসব সম্পর্ক ছিন্ন করে বাবা শহরে চলে এল। বাবার সাথে সাথে আমরা।
শহরে অন্যরকম জীবন। না আছে ঘন জঙ্গল, না কোন শ্যাওড়া বৃক্ষ;- পূর্ণিমার রাত্রিতে এখানে ঘটে না কোনো কংকালের হাসির সাথে চাঁদের কান্নার বিপন্ন ক্ষরণ। কদিন থেকেই খুব আনমনা হয়ে পড়েছি আমি, বিস্মরণের মহাপ্রাচীর ভেঙ্গে পড়েছে এই পড়ন্ত যৌবনবেলায় এসে; এক পাল ভূত এঁসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম খুব; কিন্তু রক্তের মধ্যে এসব ব্যাপার ছিল কিছুটা বলেই বোধকরি দ্রুতই সামলে নিতে পেরেছিলাম। তাছাড়া ওঁদের আচার-আচরণ ছিল একদম নিরীহ গোছের।
এঁসেছিল আবার আকুতি নিয়ে--বাসার সামনে একটা শ্যাওড়া গাছ পুতে দিতে হবে, কি না, তেঁনারা থাকবেন। ছানাপোনাগুলো অন্তত শহরে মানুষ হোক, আর তাদের দেখাশুনার জন্য গোটাকয়েক শাকচুন্নী, আর দু'টো মামদো, আর...। ধমকে তাড়িয়েছি, ওসব সাতে-পাঁচে নেই আমি, বলিহারি আবদার আর কী!
আমার তিন বছরের একটাই ছেলে, শাতিল,-সেদিন তার জেদে বৃক্ষ মেলায় গেছি--একটা বনসাঁই আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল। পরিচিত কোন গাছ নয়, আবার মনে হচ্ছে খুব চেনাচেনা! চমকে গেলাম, স্পষ্ট লেখা আছে, ‘শ্যাওড়া,’- বয়স ৬৫। একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি ছানাভূতগুলো আর আমার ছোট্ট ছেলে মিলে যে ষড়যন্ত্র ফেঁদেছে নিজের অলক্ষে আমি কেবল তা বাস্তবায়িত করে চলেছি। নাকি দাদার সেই ওছিয়ত! ওছিয়তের প্রভাব, অবচেতনে ছুটে যাচ্ছি আপন কর্তব্য পালন করতে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, চারিদকে সবুজ আর সবুজ, মনেহয় গ্রামে ফিরে গেছি, মাথা ঝিমঝিম লাগে। এমনিতে গাছ-গাছালি পছন্দ করি না; বৃক্ষমেলায় গিয়ে বৃক্ষ কিনব এমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না; কিন্তু কী এক অদৃশ্য ইশারায় বাপ-বেটা মিলে দস্তুর মতো চড়া দামে একটা শ্যাওড়ার বনসাঁই কিনে ফেলি।
ভূতগুলো আবার এঁলে ওঁদের জানিয়ে দিলাম, পূর্ব-পুরুষদের সম্মান রক্ষার্থে কেবল তাঁদের ছানাগুলোকে আমি রাখতে পারি, অন্যরা গ্রামে ফিরে যাক।
আরও কিছু কথা হল এবং তাঁরা মেনে নিল আমার কথা।
দু’বছর হয়ে গেল- আমার ছেলেটা বাবু ভূতগুলোর সঙ্গে লুটোপুটি করে খুব আনন্দে আছে। ভাবছি, ব্যবস্থা মোতাবেক, এই আষাঢ়েই দেশ থেকে কচি ভূতের একটা নতুন চালান আনাব। দামড়া ভূত পালার মধ্যে বাবা আমি নেই! সোফায় বসে চোখের সামনে খবরের কাগজটা ধরে মহানন্দে পা নাচাতে থাকি। এফ,এম রেডিওতে ধুমধারাক্কা গান বাজছে,
বনস্পতি অবশেষে
বিরহে নিলে সন্যাস
আমার বসার ঘরে হে
নতুন তার বসবাস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।