ইমরোজ
তখনও আমার ঘুম আসছে না। জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি, বাইরে অনবরত ঝিঁঝি পোকার ডাক। আমাবশ্যার রাত। আনুমানিক ২ টা কি আড়াইটা বাজে। তখন হঠাৎ করেই দরজায় কড়া নড়ে উঠলো।
গ্রামের ভিটা। মাটির বাড়ি। উপরে টিনের চালা। আধুনিক অত্যাধুনিক মিলিয়ে আমার গামের বাড়িটার এই হাল হয়েছে। তা যাই হোক, গ্রামে রাত আড়াইটার সময় দরজায় টোকা পড়া মানে কিন্তু অন্য কিছু।
সবসময়ের জন্য এটাই প্রযোজ্য। কারণ গ্রামে অনেক তাড়াতাড়ি লোকজন ঘুমিয়ে পড়ে।
দরজা খুলতেই একটা দরদী বাতাস আমাকে ছুয়ে দিল। এর পর কাউকেই আর চোখে পড়ে না। আমি নির্ভয়ে বাইরে এসে পড়লাম।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই সামনে ক'হাত দূরের পুকুরটাকেও দেখা যাচ্ছে না। তবু তারার সাথে কথা বলা আমাদের শহুরে অভ্যাস। কিছুক্ষণ বাইরে থাকার পর, একপ্রকার ভুলেই গেছি আমার দরজা যে কেউ ধাক্কা দিয়েছিল।
ঘরে এসে বিছানায় শুতে গিয়ে বুকের ভেতরটা ধরাস করে উঠল।
বিছানায় একটা ছায়ামূর্তি শুয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি করে ম্যাচ জ্বালালাম। কিন্তু তখনই চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। শুয়ে থাকা লোকটা আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। তার চেহারা কেমন বিকৃত হয়ে আছে।
ঠোট বেঁকে আছে। আঁতকে উঠারই কথা। তখন খেয়াল হলো দরজাটা মনে হয় এই নক করেছিল। তার হাতটা ধরে দেখার চেষ্টা করলাম। তখন হিম হয়ে গেছে তার সারা শরীর।
লোকটি উঠে বসল।
আমি বললাম, "আপনি কে"?
-কেউ না, অনেক আগে কিছু একটা ছিলাম হয়তো। কিন্তু মৃত্যু হবার পর থেকে আজ কিছুই নই।
-কী যাতা বলছেন, আমি কী আর পাঁচটা লোকের মত অশিক্ষিত? বোকা?
-নাহ আপনি বোকা নন, তাই তো দেখছি। এদিকে আসুন...
আমি এবার সাহস পেলাম।
লোকটার কথা বলার ধরণ খুব সুন্দর। তার পিছা করতে দিধা হলো না। লোকটি আমাকে বাইরে নিয়ে এসে বললেন, "আমার সাথে আসেন, সমস্যা না হলে। "
বাড়িতে আরও তো লোক আছে। তাদের না বলে যাওয়াটা ঠিক না জানি।
কিন্তু ততক্ষণে আমি সব ভুলে গেছি। লোকটা আমাকে কেমন করে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমন সম্মোহনী শক্তি তার! কিন্তু যেতে যেতে মাঝপথে লোকটাকে হারিয়ে ফেললাম।
তবে বুঝতে বাকি রইলো না মিত্তির বাড়ির জঙ্গলের কোন একখানে আটকা পড়েছি আমি। লোকটার নাম জানি না।
চিৎকার করে ডাকাও তো বেকার কাজ। এই রাতে ফিরবো কেমন করে?
তখন হঠাৎ চোখে কেমন ধাঁধা লেগে গেল। আমি সামনে সাদা কিছু দেখছি। আরও সামনে, আরও সামনে যেতেই বিদ্ঘুটে একটা কিছুর সাথে ধাক্কা খেলাম। গাছ মনে করে পাশে সরতেই তিনটা লাশ ঝুলতে দেখলাম গাছের সাথে।
এ কেমন কথা? কেউ কী আমার সাথে মজা করছে। তখন স্নায়ুটাকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কষ্টকর। এখন এর থেকে বেঁচে যাওয়ার উপায় কী? অন্ধকার ক্রমেই ঘন হচ্ছে। আমি লাশের সামনে থেকে সরে এসেছি।
ঘন অন্ধকার চোখের সামনে অনবরত চেপে আসছে।
এ বলে বুঝানো সম্ভব না। তবে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টায় ছিলাম, ভয়ে আর ইচ্ছা কোনটা যে আযরাইল কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
সামনে লোকটা পড়ল আবার। মাটি খুড়ছে। আমি ছুটে গিয়ে বললাম, "আমাকে বাড়ি দিয়ে আসেন"!
-কোনটা তোর বাড়ি?
-মাস্টার বাড়ি।
-মাস্টার বাড়ি, মিত্তিরের এখানে কী চাস?
-ভাই আমাকে আপনি এনেছেন।
-কে বলল? আমি তো কবর খুড়ছি, তিনটা লাশ আছে, কবর দিতে হবে।
-এগুলো কাদের লাশ?
-একটা আমার ভাইয়ের, অন্য দুইটা কার জানিনা। আমি আমার ভাইয়েরটা কবর দিয়ে চম্পট দিব।
লাশ কবরে নামানো পর্যন্তই আমাকে অপেক্ষা করতে হলো।
তারপর যদি দয়া করে আমাকে বাড়ি দিয়ে আসে।
তখন প্রচন্ড জোরে নিশ্বাস নিতে শুরু করলাম। হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। কবরের কাছাকাছা কোথাও শুতে ইচ্ছা করছে। হাস-ফাস হাস-ফাস তারপর শেষে চোখে সবই মৃত্যুময় হয়ে উঠলো।
লোকটাকে না পেলে আমার আজকে এখানেই শুতে হবে। ঐ তো পাশে আরেকটা কবর আছে। ওখানে যেতে যেতে...ই সকাল হলো। চোখ জোড়া চকিতে খুলে গেল। জানালা হা করে খোলা।
গ্রীলগুলো সবুজ কালো রাঙ্গানো।
এই স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার কোন মিলই ছিল না এতদিন জানতাম। হঠাৎ করে সেদিন কেমন করে যেন ১৯৭৩ সালের একটা আঞ্চলিক কাগজ আমার হাতে পড়লো। বাবার আলমারিতে হাতালে আরও পাওয়া যাবে।
নিছক সখের বসে পড়তে গেলাম।
একটা খবরে চোখ আটকে গেল, "তিন মাস হতে চলল, একসাথে তিনটি আত্মহত্যার ঘটনার কোন তদন্তই হয়নি"।
পুরোটা পড়ে কোন স্থানে আত্মহত্যা করেছিল লোকগুলো আমি জানতে পারলাম না। আর চতুর্থ যে জন কবর খুড়ছিল তার কোন কথাই লেখা নাই তাতে। এ কেমন রহস্য! পরে অনেকবার গ্রামে গিয়েছি। কেউ এইখানে আত্মহত্যার কথা বলতেই পারে না।
এমনকি পুরনো লোকগুলোও জানে না কিছু। আর আমার স্বপ্নটাও কেউ জানলো না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।