কখনো কখনো মনে হয়, শ্বাপদসঙ্কুল গভীর এক অরণ্যের ভেতরে আছি। এবং সেখানে আমার নিজেরও রূপান্তর ঘটেছে। আমি হিংস্রতার এক অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছি। আত্মরক্ষার জন্য অবিরাম ছুটছি বনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এই বুঝি কোনো শিকারি পশু ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর! তারপর খুবলে খাওয়া।
বেদনায় মন ভারী হয়ে ওঠে। অরণ্যচারীদের জীবনযাপনেরও কতকগুলো নিয়ম আছে। সেখানেও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আছে। আমরা দেখেছি, বাঘ-সিংহ দিয়ে আক্রান্ত মহিষগুলো দলবেঁধে প্রতিরোধব্যূহ তৈরি করে। এই সমাজে আমরা অবিচার-জুলুমের বিরুদ্ধে সেটুকু প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারছি না।
আমাদের সমাজ এখন কি জঙ্গলের নিয়মে চলতে শুরু করেছে? আমরা কি মানুষের সমাজে বাস করছি না? আমরা কি আদিম মানুষের যুগে নিজেদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি? আমরা কি সভ্যতা থেকে পেছনে যাত্রা শুরু করেছি? যে দেশের মানুষের আছে আড়াই হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস, যে দেশের মানুষ সাগরের সাথে লড়াই করে হাজার হাজার বছর ধরে জীবনের উপাদান সংগ্রহ করে আসছে। এই মানুষই একটি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশকে ‘ইমার্জিং টাইগার’ কিংবা ‘নিউ ইকোনমিক জায়ান্ট’-এর পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। এরাই যুগে যুগে স্বৈরচারী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছে। এরাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করেছে ভিনদেশী শক্তির বিরুদ্ধে, তাদের হটিয়ে দিয়েছে।
সেই অদম্য অকুতোভয় মানুষ আজ নিজ দেশেই যেন পরবাসী হয়ে পড়েছে।
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ সমাজের ভেতরে শৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে ধারাবাহিকভাবে নানা আইন করে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করেছে। সে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য ছিল, আরো উন্নত সুশৃঙ্খল জীবন ও জীবনের নিরাপত্তা। সেভাবেই মানুষ সভ্য হয়ে উঠেছে। আধুনিক মানুষ রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো নির্মাণ করেছে। প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, বিচার বিভাগ তৈরি করেছে।
এর সব কিছুই করা হয়েছে সমাজ, জীবন, রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খল করার জন্য। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। সরকারকে বাড়াবাড়ি থেকে নিবৃত্ত করার জন্য। সরকারের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য।
কিন্তু এসব প্রয়াস, সভ্যতার সব আয়োজন যেন বাংলাদেশে আজ মিথ্যা হয়ে যেতে বসেছে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। সর্বত্র একটা রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। চোখকান খোলা রাখলে দেখা যায়, শোনা যায়। সবারই প্রশ্ন, কী হচ্ছে? এ সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে এমন হাজারটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যখন যেটা সামনে আসছে, মানুষ সেটা নিয়েই উদ্বেগ, শঙ্কা ও আতঙ্কে শিউরে উঠছে, কী হবে?
ক্ষমতায় থাকলে সব সময় এ পরিস্থিতি টের পাওয়া যায় না।
বিশ্বাসও হয় না। ক্ষমতায় থাকলে শত হাঙ্গামার মুখেও বলে দেয়া যায় যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সর্বকালের চেয়ে ভালো। বলে দেয়া যায়, দ্রব্যমূল্য মোটেও বাড়েনি। বলে দেয়া যায়, পণ্যমূল্য মানুষের নাগালের ভেতরেই আছে। অবলীলায় বলে দেয়া যায়, ‘ক্রসফায়ার’ বলে কিছু নেই।
পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। কিন্তু নাগরিকদের চোখ আছে, তাদের দূরদৃষ্টি আছে, তাদের প্রশ্ন করার ক্ষমতা আছে। তাদের সে প্রশ্ন শাসকগোষ্ঠীর কর্ণকুহরে কখনো প্রবেশ করে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো প্রশ্ন করে, ক্রসফায়ার মানে তো বন্দুকযুদ্ধ। উভয়পক্ষই গোলাগুলি করবে।
সে কথা সরকারও বলে। গোলাগুলি হয়েছিল। কখনো কখনো তাতে কিছু অকেজো অস্ত্রশস্ত্রও পাওয়া যায়। পুলিশ-র্যাব তার হিসাবও দেয়। সেভাবে কত অস্ত্র পাওয়া গেল, সে অস্ত্র কোথায় রক্ষিত আছে, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না।
আবার লক্ষ করা যায় যে, সরকারের ক্রসফায়ারের ভাষার গৎ একই। আটক ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তার গোপন আস্তানায়। তখন আটক ব্যক্তির সহযোগীরা আটক ব্যক্তিকে পুলিশ বা র্যাবের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তাদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি চালায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা এমন কোনো খবর পাইনি যে, এই গোলাগুলিতে আটক ব্যক্তিকে যারা ছিনিয়ে নিতে এসেছিল, তাদের কেউ আহত বা নিহত হয়েছে।
আমরা এমন কোনো খবরও পাইনি যে, আটক ব্যক্তির সহযোগীদের গুলিতে কোনো পুলিশ বা র্যাব সদস্য নিহত বা আহত হয়েছে। কিংবা আটক ব্যক্তির যে সহযোগীরা পুলিশ-র্যাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল, তারা এ পর্যন্ত কেউই আহত-নিহত হলো না এটাও কম বিস্ময়ের ঘটনা নয়। এ ক্ষেত্রে শুধু খুন হয়ে যায় আটক ব্যক্তি।
এর নাম কি ন্যায়বিচার? আদিম সমাজে মানুষ মানুষকে নির্বিচারে খুন করত। গায়ের জোরে যার যা খুশি তা-ই করত।
সেটা অরাজক পরিস্থিতি ছিল। সমাজ সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যই আইন-কানুন, বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল এবং সভ্যতার সোপান নির্মাণ করেছিল। সে সোপান ধরে সামনে আগ্রসর না হয়ে আমরা বরং নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি, অতল অন্ধকারের দিকে। শাসকগোষ্ঠী আইন-আদালত-বিচার কোনো কিছুরই যেন তোয়াক্কা করতে চাইছে না।
রাজধানী থেকে দূরে কী ঘটছে, বলতে পারি না।
এই রাজধানীতেই অখ্যাত সাধারণ নাগরিকদের বেলায় কী ঘটছে বলতে পারি না। কিন্তু আমরা বিভীষিকা দেখতে পাচ্ছি আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে। মাহমুদুর রহমান চোর-ডাকাত বা দাগি আসামি নন। তিনি তার পত্রিকায় সত্য প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ব্রতী ছিলেন। তার লক্ষ্য কথিত জনগণের সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করা।
এটাই সংবাদপত্রের দায়িত্ব, গণতান্ত্রিক সমাজের সংবাদপত্রের কর্তব্য।
এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান আজ চরম নিগ্রহের শিকার। তার পত্রিকা আমার দেশ বন্ধ। তিনি বন্দী অবস্থায় এখন এক চরম নিগ্রহের শিকার। এই নিগ্রহ মানবতার বিরুদ্ধে, সভ্যতার সম্পূর্ণ বিপরীতে।
এক ঠুনকো কারণ দেখিয়ে সরকার বন্ধ করে দিয়েছে আমার দেশ পত্রিকা। সরকারের এই খামখেয়ালির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের দুইজন বিচারক। তারা রায় দিয়েছিলেন, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। ফলে বেশ কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর আমার দেশ পুনঃপ্রকাশিত হতে শুরু করেছিল বিশেষ ব্যবস্থায়। বিশেষ ব্যবস্থায় বললাম এ কারণে যে, সরকার জবরদস্তিমূলকভাবে বন্ধ রাখল আমার দেশ পত্রিকার প্রেস।
আদালতের রায় সত্ত্বেও তারা খুলে দেয়নি প্রেসের তালা। তবু সাংবাদিকসমাজ আশান্বিত হয়েছিল যে, সংবাদপত্রটি পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে। সাড়ে চার শ’ সাংবাদিক-কর্মচারীর জীবন-জীবিকা বোধ করি নিরাপদ হলো। কিন্তু এ আলো জ্বলেছিল মাত্র কয়েক দিন। তারপর একজন বিচারক সনৎ কুমার সিনহা হাইকোর্টের দুইজন বিচারকের রায় স্থগিত করে দিলেন।
তাতে পরিস্থিতি দাঁড়াল এই যে, সরকারের সিদ্ধান্তই বহাল থাকল। আমার দেশ আবারো বন্ধ হয়ে গেল। আগামী ১৫ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে সরকার স্থায়ীভাবে আমার দেশ বন্ধ করার নির্দেশনা চাইবে। সে মামলা কত দিন গড়াবে জানি না। আমার দেশ আবার কবে প্রকাশিত হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
হতে পারে আমার দেশ আবারো প্রকাশিত হবে, হতে পারে আমার দেশ বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে।
ভিন্ন মতের পত্রিকা বন্ধ করে সরকার আসলে নিজের ঘরের আলোই ফুৎকারে নিভিয়ে দেয়। নিজেকে ক্রমেই অন্ধকারে আবৃত করে। পথ খুঁজে পায় না। ১৯৭২-৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালেও আমরা দেখেছি, সরকার একে একে বিভিন্ন পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে নিজের চার পাশে কী এক নিকষ কালো অন্ধকার সৃষ্টি করেছিল।
শেষ পর্যন্ত নিজের স্তবগান গাওয়ার জন্য মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে বন্ধ করে দিয়েছিল বাকি সব সংবাদপত্র। এতে জনগণের সাথে এক বিশাল দূরত্বই সৃষ্টি করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। একা বন্ধ হয়ে পড়েছিলেন আপন সঙ্কীর্ণ বৃত্তের ভেতরে। যেখান থেকে বাইরের কোনো খবরই আর তিনি রাখতে পারছিলেন না। নিজ বলয়ের বাইরে আর কিছুই দেখতে পারছিলেন না।
এই অন্ধকার সৃষ্টির কারণেই এত বড় মহীরুহ রাজনৈতিক নেতা একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন জনগণ থেকে। এবং কোনো এক করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল তাকে। সংবাদপত্র বন্ধ করে বর্তমান সরকারও নিজেদের চার পাশে তেমনি এক অন্ধকার বলয় রচনা করতে বসেছে।
আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারও তেমনি এক কালো উপাখ্যান। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারে সরকার পত্রিকা সংক্রান্ত তেমন কোনো কারণ দেখাতে পারেনি।
প্রকাশক জটিলতার যে কারণ সরকার দেখিয়েছিল, আদালতে তা গ্রাহ্য হয়নি। তাকে গ্রেফতারের পর একে একে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দায়ের করেছে সরকার। সেসব মামলায় রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। প্রথম দফায় রিমান্ডে নিয়ে তাকে তল্লাশির নামে বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। তার প্যান্ট খুলে ফেলে আন্ডারওয়্যারও খুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
কেন? বলা হয়েছিল যে, তার কাছে মোবাইল ফোন আছে কি না, সেটা খোঁজার জন্যই এ কাজ করা হয়েছে। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের মতো লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করাই তো যথেষ্ট ছিল যে, আপনার কাছে মোবাইল ফোন আছে কিনা? তিনি হঁ্যা-না যা-ই বলতেন, সেটাই বিশ্বাস করতে হতো। কিন্তু একজন মানুষের আত্মমর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য সরকার এমন নোংরা কাজে প্রলুব্ধ হলো। এটা সরকারের মর্যাদাকে তো ভূলুণ্ঠিত করেই, নাগরিকদেরও মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। এ ঘটনায় দেশের কোটি কোটি মানুষ যে সরকারকে ছিঃ ছিঃ করেছে, সেটা উপলব্ধি করার চেতনা বোধ করি সরকারের লুপ্ত হয়েছে।
এরপর মাহমুদুর রহমানকে অন্ধকার ঘরে আটকে অজ্ঞাত লোকেরা তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এর মধ্যে গত ২৩ জুন তাকে আরেক দফা রিমান্ডে নেয়া হয়। সেখানে কবরের আকৃতি এক ছোট ঘরে টিএফআই সেলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় তার চোখ বেঁধে দেয়া হয় কালো কাপড়ে।
গ্রিলের সাথে হাত লাগিয়ে তাকে আটকে ১০ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অথচ মাহমুদুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চোখ বাঁধারও দরকার ছিল না, হাতকড়ার দরকার ছিল না। এই জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি যা বলেছেন, হাতকড়া না লাগালেও তিনি তাই-ই বলতেন। তা হলে মানবিকতার এই বিপর্যয় কেন ডেকে আনা হলো? কেন অসম্মানিত করা হলো একজন সম্মানিত নাগরিককে?
ক্ষমতার দাপটে সরকার যা করছে, তা যেন আমরা নীরবে মেনেই নিচ্ছি? আমরাই বা কেন একযোগে প্রতিবাদ উচ্চারণ করতে পারছি না যে, এই অমানবিক নির্যাতন বন্ধ করো। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করো।
আজ আমরা যারা তামাশা দেখছি, কাল নিজে বিপন্ন হলে অন্যরাও তামাশা দেখতে পারে। তাই দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য আসুন আমরা সবাই একসাথে ধ্বনি তুলি এই নিপীড়ন বন্ধ করো, আইনের শাসন নিশ্চিত করো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।