ছন্দ মানে কি?
গান শিখতে গেলে শিখতে হয় ছন্দ, নাচে জানতে হয় ছন্দ। কবিতায়ও ছন্দ। এমনকি আমার এক বান্ধবীর নাম ছিলো ছন্দা। শব্দটা শুনলেই মনে এক দোলা লাগে অথচ সত্যিকারে অর্থটা সহজ করে বলা বড় কঠিন। একদিন জানতে পেলাম, এই যে দোলা লাগা সেটাই নাকি ছন্দ।
মানে একি নিয়মে কোনো কিছু বার বার ঘটা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় পর পর কোনো কিছু দোলা লাগাকেই নাকি ছন্দ বলে।
বাহ মজার ব্যাপার তো! শিশুদের যখন আমরা দোলনায় দোলা দেই সেটারও তো তাহলে ছন্দ আছে। একবার আমার এক দাদু ছোটবেলায় মাকে বললেন, তোমার মেয়েকে নাচ শেখাও, ওর হাঁটায় ছন্দ আছে। এত ছন্দ ছন্দ শুনতে শুনতে আমিও পড়ে গেলাম ছন্দের প্রেমে।
যাইহোক স্কুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডাক পড়লো সকল কাজের কাজী এই আমার, জসিমউদ্দীনের বিখ্যাত কবিতা 'রাখাল ছেলে' আবৃত্তি করবার জন্য।
আবৃতি শেখাবেন আমাদের চশমা আঁটা বিখ্যাত রাগী দিদিমনি নিরুপমা সেন। নামটা যতই মধুর হোক না কেনো, চেহারায় তিনি যতই সবচাইতে মিষ্টি দেখতে হোক না কেনো মেজাজেও তিনি সর্বেসর্বা। কি আর করা পড়েছি রাবনের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে।
আমার হাতে বইটি ধরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, পড়ো।
আমি মিন মিন করে পড়ছিলাম। এমনিতেই গলাটা আমার একটু মিনমিনে মানে দূর্জনেরা বলে মিচকা শয়তান টাইপ। তবুও যেইনা মিনমিনে পড়া শুনে নিরুপমা দিদিমনি বিরাশী সিক্কা ওজনের এক হাঁক দিলেন অমনি সব মিচকামী ছুটে গেলো আমার। ভয়ে শুরু হলো কাঁপাকাঁপি।
দিদিমনি বললেন গলায় জোর নেই, বলায় ছন্দ নেই( হায় হায় আবারও সেই ছন্দ) তাল নেই ,লয় নেই, তুই পড়বি কবিতা?
মনের দুঃখ বুকে চেপে চরম দুঃসাহসে বললাম সেসব আবার কি? দিদিমনি আমাকে চিনিয়েছিলেন ছন্দ কাকে বলে।
কবিতার ছন্দ। সেটাই আমি আজ শেয়ার করতে চাই সবার সাথে।
মিত্রাক্ষর ছন্দ
কবিতার প্রতি লাইনের শেষে মিল থাকাই নাকি মিত্রাক্ষর ছন্দ ।
ঘুম হতে আজ জেগে দেখি শিশির ঝরা ঘাষে
সারারাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া ভাই।
সরষে ফুলের পাপড়ী নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।
বাহ বাহ! মজা মজা ! শুরু করে দিলাম মিত্রাক্ষর ছন্দের খেলা।
ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি দাদু বসে আছেন
বাবা নাকি থলে হাতে মাছ কিনতে গেছেন।
আমার মিত্রাক্ষর ছন্দের জ্বালায় তখন বাড়ির মানুষের কান প্রাণ বাঁচানো দায়। ( সাধে কি আর বলি বিখ্যাত হতে দিলোনা কেউ ? )
কোনো কোনো ছন্দে পংতির শেষে মিল নেই কিন্তু অন্যভাবে মিল আছে একটু ঘুরিয়ে যেমন
হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমন
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
একে নাকি বলে অমিত্রাক্ষর ছন্দ । যাইহোক নানা রকম ছন্দ অনুসরন করেই নাকি কবিতা লেখা হয়। কবিতার ছন্দগুলোকে যেভাবে সাজালে কবিতাটি শুনতে ভালো লাগে এবং এরি মধ্যে একটি সময় ও ধ্বণীর চমৎকার মিল তৈরী হয়। শব্দ সাজাবার সেই নিয়মকেই ছন্দ বলে।
তিনভাগে ছন্দকে ভাগ করা যায়।
১) স্বরবৃত্ত ছন্দ-একমাত্রার মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর ছন্দ। প্রত্যেক পর্বের প্রথমে শ্বাসাঘাত পড়ে। প্রত্যেক পর্বের মাত্রার সংখ্যা চারটি। সকল পর্ব সমান মাত্রায় বিভক্ত। ছন্দের লয় বা গতি দ্রুত হয়।
পংতির শেষ পর্ব অপূর্ণ থাকতে পারে।
৪+৪+৪+১ =খু কু যা বে!! শ্ব শুর বাড়ি! স ঙ্গে যা বে !!কে
২)মাত্রাবৃত্ত ছন্দ -মুক্তাক্ষর এক মাত্রা, বদ্ধাক্ষর দুই মাত্রা। গতী বা লয় মধ্যম প্রকৃতির। শেষ পর্ব ছাড়া অন্যান্য পর্বের মাত্রা সংখ্যার সমতা। চরণে পর্ব সংখ্যা সব সময় সমান নয়।
নী ল ন ব ঘ নে! আ ষা ঢ় গ গ ণে! তি ল ঠা য় আ র ! না হি রে=৬+৬+৬+৩
৩)অক্ষরবৃত্ত ছন্দ -মুক্তাক্ষর এক মাত্রা, বদ্ধাক্ষর যদি শব্দের প্রথমে থাকে বা মাঝে তখন এক মাত্রা। শেষে থাকলে দুই মাত্রার হিসাবে গণনা করা হয়। গতী বা লয় ধীর। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বিভিন্ন রুপ,পয়ার,ত্রিপদী,চৌপদী,অমিত্রাক্ষর,মুক্তক ইত্যাদি ও ইত্যাদি।
পয়ার-প্রতি চরণ দু পর্বের।
সকালে উঠিয়া আমি! মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন! ভালো হয়ে চলি।
ত্রিপদী- প্রতি চরণে তিনটি পর্ব। অন্তমিল আছে এখানে।
দাদ খানি চাল! মসু রির ডাল
চিনি পাতা দই!
দুটো পাকা বেল ! সরি ষার তেল
ডিম ভরা কৈ!
চৌপদীতে প্রতি চরণে চারটি পদ। অন্তমিল আছে।
চির সুখী জন ! ভ্রমে কি কখন।
ব্যাথিত বেদন! বুঝিতে পারে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ- প্রতি পংতিতে ১৪ বা ১৮টি অক্ষর। পংতি সংখ্যাও ১৪টি। প্রথম আট পংতি কে বলে অষ্টক।
পরের ছয় পংতি স্তবক। মাইকেল মধুসুধনের কপোতাক্ষ নদ সনেটের জীবন্ত উদাহরন।
এই সব ছন্দের বাইরের কবিতার নাম গদ্য ছন্দ। ভাগ্যিস এই ছন্দ ছিলো নইলে কি করে আমি খোকাভাই সিরিজ লিখতাম এত সব ছন্দ চিন্তা মাথায় নিয়ে
লেখাটি আমার ছন্দ-বন্ধু শাহরিয়ার, আরেক লেজ বিশিষ্ঠ ছন্দ-বন্ধু( যদিও আবোল তাবোল ছন্দ তার) দুরন্ত বান্দর আর রাজ সোহান পিচকি ভাইটাকে ভেবে লেখা। তাদের যদি আমার এই গবেষনালদ্ধ ফলাফলে( বই পড়ে আর দিদিমনিদের বকা খেয়ে ) কোনো উপকার হয় আর কি।
ধীরে বৎস বলেছিলো আমার লেখা কোনো ব্যাকরণ মানেনা তাই ভাবলাম তাকেও জানিয়ে দেই ব্যকরণ না মানা লেখা আছে আর সেটা ছিলো বলেই একটু লেখালিখির অপচেষ্টা।
আর সবার শেষে সবুজ অঙ্গন ভাইয়াকে স্মরণ করিলাম। কৃতগ্গতা কৃতগ্গতা( বানান জানিনা, যাও জানি ফোনেটিকে লিখতে পারিনা। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।