অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বরূপ
ফকির ইলিয়াস
=========================================
গোটা বিশ্বে বহুল আলোচিত সোস্যাল নেটওয়ার্ক 'ফেসবুক' বাংলাদেশে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে চলছে এখন দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা। এর আগে পাকিস্তানেও ফেসবুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফেসবুকের বিভিন্ন ফিচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও চলছে নানা বিতর্ক। বিশেষ করে ব্যবহারকারীর 'ব্যক্তিগত নিরাপত্তা' নিয়ে মার্কিন মিডিয়ায় ক'সপ্তাহজুড়ে চলেছে নানা তর্ক-বিতর্ক।
ফেসবুকের শীর্ষস্থানীয়রা বলেছেন, তারা 'ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা' আরও নিশ্চিত এবং কঠোর করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশেও ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছে প্রায় একই কারণে। রাষ্ট্রের শীর্ষ রাজনীতিকদের নামে ফেসবুকে একাউন্ট খোলা, তাদের ছবির অবৈধ ব্যবহার, নানা কটূক্তি রাষ্ট্রের প্রশাসনকে বিব্রত করে তুলেছিল। ফলে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা তা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।
বিশ্বে একটি সোস্যাল নেটওয়ার্ক সব সময় সামাজিক কল্যাণের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়।
সমাজের বিবর্তনের পাশাপাশি, সমাজের উন্নয়নে মানুষের মতবিনিময়ের জন্যই এমন গোষ্ঠীবদ্ধ কর্মকান্ড চালানো হয়। প্রথমত, এতে কোন অশুভ উদ্দেশ্য থাকার কথা নয়। এখানে মনে রাখা দরকার কারও বিনা অনুমতিতে তার নামে একাউন্ট খোলা, তার ছবি, তার ব্যক্তিগত ডাটা ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে গর্হিত কাজ। আর তা উন্নয়নে অন্তরায় তো বটেই বরং সমাজকে ক্রমেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কিংবা সামাজিকভাবে হীনউদ্দেশ্য নিয়ে বেশ কিছু দিন থেকেই এমন কিছু অপচেষ্টা চলে আসছে।
যা গোটা জাতি ও দেশের জন্যই অশনি সঙ্কেত। তারা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত কটাক্ষ করতে কসুর করেনি।
এ বিষয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর গোয়েন্দা বিভাগ একজনকে গ্রেফতারও করেছে। এর নেপথ্যে সংঘবদ্ধ কোন চক্র রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে খবরে বেরিয়েছে।
একটি কথা সবারই জানা, সাইবার ক্রাইম বিশ্বজুড়ে একটি নতুন উপদ্রব।
এ উপদ্রপকে মোকাবেলা করার জন্য আধুনিক দেশগুলো বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে এবং করা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ সে তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে বহুগুণ।
আমরা আরও জানি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে বিশ্বে যেমন আগ্রাসন চলছে, তেমনি সত্য কথা বলা থামিয়ে দেয়ার জন্যও পরাক্রমশালীরা তৎপর রয়েছে। এর কিছু উদাহরণ আমি এ নিবন্ধে দিতে চাই। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় অন্যের তথ্য, যত্রতত্র এবং যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা।
কিংবা কোন ব্লগ, ওয়েবম্যাগ, ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা টুইটার-এ কাউকে নগ্নভাবে আক্রমণ করা। ভিন্নমত পোষণের নামে এমন হঠকারী আক্রমণ আমরা এখন প্রায়ই লক্ষ্য করি।
আর এর উল্টো চিত্রটি একটু ভিন্ন। বিশেষ করে বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের তত্ত্বাবধানে, মালিকানায় গড়ে উঠেছে মিডিয়া সংস্থা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে কোন বিবেকবান লেখককেও একটি নিবন্ধ লেখার আগে জেনে নিতে হচ্ছে, যে মিডিয়ায় তিনি লেখাটি পাঠাবেন, তার মালিক পক্ষের কোন অপকর্ম তিনি ফাঁস করে দিচ্ছেন কি না! এমনকি ওই মিডিয়ার নেপথ্য মালিক কে কে, ম্যানেজিং বোর্ডে ক্ষমতাবান কারা কারা আছেন-তা জানাও এখন যেন নিত্তনৈমিত্তিক বিষয়!
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে বিভিন্ন মিডিয়া এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষমতাবানদের অপকর্ম ঢাকার ঢাল হিসেবে।
তার ওপর আবার ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর মল্লযুদ্ধের কারণে দুই পক্ষের মিডিয়াকে মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্যও আমরা দেখছি প্রায় প্রতি সপ্তাহে। আরও লজ্জাজনক হচ্ছে যারা রাষ্ট্রশাসনের ধারে কাছে নীতিনির্ধারক হিসেবে থাকেন, তারাও চোখ রাখেন মিডিয়ায় আসা তাদের বিরুদ্ধে কোন বিরূপ সমালোচনা প্রকাশের আগেই থামিয়ে দেয়া যা কি না। আর এই যে ক্ষমতাবানদের অপচেষ্টা তা দেখে-জেনে-বুঝেই একটি চক্র আরও এগ্রেসিভ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তারা ক্ষমতাবানদের চরিত্র হননে জঘন্য হীন পথ অবলম্বন করছে। যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
দুই.
গোটা বিশ্ব এখন ডিজিটাল যুগে প্রবেশের তীব্র প্রতিযোগিতা করছে। 'পেপারলেস' দফতর চালানোর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে। রয়েছে এ বিষয়ে দ্বিমতও। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষক রেডিন রজার্সের মতে, 'তাহলে কি বিচার বিভাগের ভারী ভারী ফাইল বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে একজন নিরপরাধ মানুষের দোষ-নির্দোষ নির্ভর করবে কম্পিউটারের ডাটার ওপর?'
এ প্রসঙ্গে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, যদি কোন প্রযুক্তির সিস্টেমটা পুরো ক্র্যাশ করে আর সেই ঘটনাবলির কাগজি দলিল-দস্তাবেজ না থাকে তবে মাননীয় বিচারক রায় দেবেন কি দেখে? অর্থাৎ রেডিন রজার্সের মতে, পেপারলেস জীবনপ্রবাহ চলানোর সময় এখনও এই মানব সমাজের জন্য আসেনি।
হাঁ, হয়তো আসেনি।
কিন্তু আজ থেকে দুশ' বছর পরে কি হবে, তা তো এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বলা যাচ্ছে, তথ্যপ্রবাহের মুক্ত পরিবেশনা যেমন এগোচ্ছে, তার অপব্যবহার রোধে সতর্কাবস্থা খুবই জরুরি। আর তা থেকে পিছিয়ে পড়লে ভর্ৎসনা পেতে হবে প্রজন্মের কাছ থেকেই।
বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করা কি আদৌ সম্ভব হয়েছে? না হয়নি। যেদিন ঘোষণা দেয়া হয়, সেদিনই বিভিন্ন ব্লগ, ওয়েবসাইটে দেখেছি অনেকেই জানিয়েছেন 'প্রক্সিসাইট ' দিয়ে কিভাবে ফেসবুকে ঢোকা যাবে।
তা অনেকে করেছেনও। অন্যদিকে ফেসবুক আবার চালুর দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে তরুণ সমাজ। তারা বলেছে, লাখ লাখ তরুণ প্রজন্ম দিনবদলের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মহাজোট সরকারকে ভোট দিয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছে। প্রজন্ম, সরকারকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
তারা আরও বলেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কথা বলবেন, আর অবাধ তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করে দেবেন, তা তো হতে পারে না।
এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের সংজ্ঞা কি? আর অন্যটি হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমারেখা কতটুকু? মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে মানুষের মৌলিক চেতনা, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, সৃজনশীল জাতিসত্তার প্রান্তরে আঘাত করা কোন সিদ্ধ আইনই গ্রাহ্য করে না। তেমনি অবাধ তথ্যপ্রবাহের নামে কারও ব্যক্তিগত ডাটায় হস্তক্ষেপ করা, হ্যাকিং করাও চরম অনৈতিক, দন্ডনীয় অপরাধ।
একটা বিষয় খুবই সহজ।
একজন অপ্রাপ্ত বয়স্কের হাতে কম্পিউটার ধরিয়ে দেয়ার আগে তার অভিভাবককে ভাল করে কম্পিউটার রপ্ত করা দরকার। শিখে নেয়া দরকার, কিভাবে 'প্যারান্টাল কন্ট্রোল' বটনটি চালাতে হয়। তা না হলে তো অবুঝের হাতে বন্দুকই তুলে দেয়া হচ্ছে। যা দিয়ে সে যে কাউকে গুলি করতে পারে।
বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করা কোন বুদ্ধিমান সরকারের কাজ হতে পারে না।
তা উচিতও নয়। বরং সাইবার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রাইম বন্ধে আইন প্রণয়ন দরকার খুব জরুরি ভিত্তিতে। দরকার প্রতিটি ল্যান্ড ফোনে কলার আইডি প্রথা চালু করা। ট্রাকিং সিস্টেম চালু করা, যা দিয়ে সহজে সাইবার ক্রাইম চিহ্নিত করা যায়। ইরান, চীন প্রভৃতি দেশে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ওপর কঠোরতা আরোপের খবর আমরা দেখছি।
তারাও প্রজন্মের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশকে বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে এগোতে হবে।
নিউইয়র্ক ১ জুন ২০১০
=========================================
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ৪ জুন ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- আরফা মিক্স
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।