শুদ্ধ উচ্চারণে পড়া বলতে পারতো অনর্গল, হাউজে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে সবার আগে হাত তুলতো ছেলেটা। বৈষয়িক জ্ঞানের বাইরেও গুছিয়ে কথা বলতে পারতো। পাঠের বাইরেও নানা বিষয়ে জানতে প্রবল আগ্রহী ছেলেটির একটি মানবিক স্বপ্ন ছিলো। তার ভাষায়, ‘স্যার আমি ডাক্তার হবো, গ্রামের মানুষের কল্যাণে অন্যরকম সেবা দিয়ে মানুষের হৃদয়ে স্থান নেবো। ’ প্রতিটি ক্লাসে সেরাদের ভেতর থাকা শওকতের লক্ষ্যটা অপূর্ণ থাকার কথা ছিলো না।
কিন্তু জন্মের ৪ বছর না পেরুতেই মা’কে হারানো ককসবাজারের শওকত এস.এস.সি’র পাঠ চুকানোর পূর্বে বাবাকে হারিয়ে অন্যরকম হয়ে গেলো। স্মৃতির পর্দায় দেখতে পাই, নির্বাচনী পরীক্ষার পরে সে নিজেকে খুব রিজার্ভ রাখতো। কথা বলতো খুব কম, সহপাঠিদের কাছ থেকে নিজেকে যথা সম্ভব আলাদা রাখতে চেষ্টা করতো। কঠিন কঠিন ইংরেজী শব্দ ব্যবহারে পটু ছেলেটার হাতে থাকতো ডিকশনারী কিংবা দু’একটি দেশি-বিদেশী বই। ওর বড়ভাই প্রায় সময় স্কুলে আসতো, তার খোঁজখবর নিতো।
পাশাপাশি শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা। কিন্তু এত তদারকির পরেও তাকে বাইরের বই পড়ার তীব্র নেশা থেকে নিবৃত্ত করা যায় নি। ফলে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বই পড়ার তীব্র নেশা তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এস.এস.সি’তে আকাংক্সিক্ষত এ+ এর পরিবর্তে জিপিএ ৪.২৫ পাওয়ায় তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের কবর রচিত হলো।
বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে তার অদম্য কৌতুহলের কারণে আবার বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলো ককসবাজার সিটি কলেজে।
গ্রামে শুভাকাংক্ষীদের সাথে কথা প্রসংগে বলেছে, এবার তার স্বপ্ন সে ব্যারিস্টার হবে। আইনের ম্যারপ্যাঁচে কষ্ট পাওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে লড়বে। এত মানবিক চিন্তা যার মনে, সে কিন্তু বরাবরের মতই প্রাতিষ্ঠানিক বই পড়ায় নিমগ্ন থাকার চেয়ে বিভিন্ন মনীষী ও লেখকের দেশী বিদেশী বইয়ে ডুবে থাকলো। ইংরেজী সিনেমাও দেখতো প্রচুর। আমির আকবরের দোকানে গিয়ে মাঝে মাঝে মেমোরিতে লোড করে নিতো।
একদিন আমির তাকে বলে, ‘শওকত, তুমি ছোট ছেলে। এত ইংরেজী ছবি দেখো, এসবের মাথামুন্ডু কিছু বুঝো?’ শওকতের হ্যাঁ সূচক দৃঢ় জবাব। আমির একটি ইংরেজী সিনেমা প্লে করলো। ১০ মিনিট প্লে হবার সময় শওকত তাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে আমিরকে অবাক করেছিলো। আমি জানি, আমির কথাটা বাড়িয়ে বলেনি।
যার হাতে সব সময় ডিকশনারী থাকতো, শেখার প্রবল আগ্রহ ছিলো, সে তো ভাল ইংরেজী বুঝবেই। ফেসবুকে আমার স্ট্যাটাসে এসে কদাচিৎ কঠিন কঠিন ইংরেজী শব্দ ব্যবহারে কমেন্ট করে যেতো শওকত। ফেসবুক ব্যবহার সংক্রান্ত সমস্যায় পড়লে আনিসুল মোস্তফা সোহাগকে ফোন করতো, কখনো বা দোকানে গিয়ে ফেসবুক ব্যবহারের খুঁটিনাটি নিয়ম শিখে নিতো।
তবে, প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের চেয়ে অন্যসাইটে বেশি সময় দেওয়ার ফলে এইচ.এস.সি’র ফলাফলটাও আশানুরূপ হয়নি তার। জিপিএ ৩.৭০ পায়।
আরেকবার শক খেলো সে। তাই বলে অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী ছেলেদের থেমে থাকা চলেনা। তাই ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া চাই। ঢাকার ফোকাস কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলো। টিভি রিপোটিং, পত্রিকা এবং ফেসবুক নিউজ ফিডে সে দেখতে পাচ্ছে, মিশরের বিক্ষোভ সামাল দিতে মুসলিম ব্রাদারহুর্ড সমর্থকদের উপর দমন অভিযান চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী।
মারা পড়ছে শত শত মানুষ। চাপা ও অনেকটা একগুয়ে স্বভাবের শওকতের মনে তা ভয়ংকর প্রভাব ফেলে কিন্তু কাছের কারো সাথে বিষয়টি নিয়ে কোন কথাবার্তা বলেনি সে। ‘মুরসী সমর্থকদের উপর দমন পীড়ন বন্ধ না হলে উড়িয়ে দেওয়া হবে ঢাকার মিশরীয় দূতাবাস। ’ মঙ্গলবার দূতাবাসের মেইল বক্সে এ হুমকি দিয়ে চিঠি দেওয়ার অভিযোগে চিঠিতে উল্লেখিত মোবাইল নাম্বারের সূত্র ধরে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দাদের নিকট মুরসী সমর্থক এবং মুরসী ফলোয়ার্স ইন বাংলাদেশ গ্রুপের সদস্য বলে দাবী করা শওকতের জীবননাশক কর্মের কারণে পরিজনরা স্তম্ভিত, বিস্ময়ে হতবাক।
আসলেই কি সে কাজটি করেছে? ডিবি কমিশনারের বিবৃতি অনুযায়ী শওকত তার অপরাধ স্বীকার করেছে। অন্যদিকে, ফেসবুকে মোহাম্মদ শওকত ওসমান নামে একটি একাউন্ট আছে। যে একাউন্ট দিয়ে সে কদাচিৎ আমার স্ট্যাটাসে কমেন্ট করতো, এটি সে একাউন্ট। টাইলাইন ঘুরে দেখা যায়, ‘আগামীকাল মিশর দূতাবাস যাবো। আমার সাথে কে কে যাবেন? - ১৮ আগস্টের স্ট্যাটাস।
বোধহয় গ্রেফতার হওয়ার আশংকা থেকেই সে একই দিন লেখে, ‘আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি এরেস্ট হতে পারি। ’ যে ছেলেটা নিজের কিছু কাউকে জানাতো না, ঢাকায় পৌঁছেই সে কী করে এত ভয়ংকর সিদ্ধান্ত ফেসবুকে প্রচার করতে পারে ভেবে পাইনা। তাছাড়া, গ্রেফতারের আগের দিন সে লিখে দেয়, ‘সৌদি ও মিশর দূতাবাসে কড়া স্মারকলিপি দিয়ে এলাম। ’ ১০ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট বিনয়ী ছেলেটা কত মানসিক ভারসাম্যহীন হলে এমন করতে পারে তা অননুমেয়।
শিবিরের সাথে তার জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। তবে, স্কুল জীবনে তাকে কোন সংগঠনের সাথে কোনদিন সম্পৃক্ত দেখা যায়নি। তারপরও ভাল ছাত্র হিসেবে কেউ যে তাকে টানতে চায়নি তাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ককসবাজার সরকারী কলেজের শিক্ষক সোলতান আহমদের ভাষায়, ‘শওকতের ব্যাপারটি একটি অনাকাংঙিক্ষত দুঃখ। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি বই পড়ে সম্ভবত সে ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে।
তবে, শিবিরের সংগে অনেকের জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি অনেক সময় স্কুল লেবেল থেকে শুরু হয়। তখন তাদের চোখে মুখে রঙ্গিন স্বপ্ন, হৃদয়ে সারল্য। এ সময় মন ভাল করা বিষয় দিয়ে সহজেই তাদের বাগে আনা যায়। মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে তাই সুযোগ বুঝে কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ জীবনের বিনিময়ে বেহেস্তের টিকিট নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। তালিম নেওয়াটা বড় বয়সে হলে সত্য মিথ্যা এবং উপযোগিতা বিবেচনায় ভাল নির্যাসটুকু গ্রহণ করতে পারতো।
কিন্তু ছোট বয়সটা আবেগের। এই বয়সে ধর্মীয় বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে তাকে কাবু করা হয়। তাই স্কুল আওয়ারের বাইরে শিক্ষার্থীরা কোন সংগঠনের অপরাধপ্রবণ মানুষের সাথে জড়িয়ে পড়তেছে কি না তা লক্ষ্য রাখা দরকার। পাশাপাশি, এলাকার জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের সমন্বয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ক্ষতিকর প্রভাব শীর্ষক সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, লক্ষ্য বিচ্যুতি ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে শিক্ষার্থীরা রক্ষা পাবে। এ ধরনের অনাকাংক্সিক্ষত ঘটনা হ্রাস পাবে।
’
ককসবাজার নিউজ ডট কমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ককসবাজার পুলিশ সুপারের নিকট থেকে এখন পর্যন্ত শওকতের ব্যাপারে ঢাকা থেকে কোন তথ্য চাওয়া হয়নি। ব্যারিস্টার নূরুল আজিম এ প্রসংগে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাইরের কোন দূতাবাসও সম্ভবত বলেনি, উয়ী আর ডিপলী কনসার্ন। ছেলেটা বাইরের বেশি বই পড়তো বলে মিশরের সাম্প্রতিক ঘটনায় স্প্যায়াড হয়েই হয়তো হুমকি দেওয়ার কাজটি করেছে। এ পর্যন্ত যা শুনেছি তাতে মনে হলো শওকত সাধ্যের চেয়ে অনেক বেশী আশা করতো, অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন এবং হতাশায় নিমজ্জ্বিত ছিলো। নয়তো এ যুগে কেউ হুমকি চিঠির শেষে মোবাইল নং দিয়ে রাখে!’
কিছুদিন পরেই ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা।
শওকত এখন চার দিনের রিমান্ড হেফাজতে। সহপাঠিদের আশংকা, শওকত স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু বলে দেবে। মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করবে, হয়তো গোয়েন্দাদের প্রশ্নের জবাবে যুক্তি দিতেও ভয় পাবে না। আর এদিকে ফিকে হয়ে যাচ্ছে তার লালিত স্বপ্ন। যে শিক্ষার্থীর বুকে ছিলো ডাক্তার হয়ে গরীবের সেবা করা কিংবা ব্যরিস্টার হয়ে নির্যাতিতের পাশে দাঁড়িয়ে আলোকিত সমাজ গড়ার স্বপ্ন, সে শিক্ষার্থী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে এমন ভয়ংকর কাজ করবে ভাবতে কষ্ট হয়।
আমরা চাইনা, আর কোন শওকত পরিবারের স্বপ্নসাধ জলাঞ্জলী দিয়ে এভাবে মিডিয়ার শিরোনাম হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।