তখনোও বিদ্যুতের সংযোগ আসেনি এলাকায়। তখনোও ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের শরীরে হাজার হাজার ক্ষত। হিনো-টাটা অথবা অন্যকোনো নামী-দামী গাড়ি চোখে পড়েনি আমাদের কারো। লোকাল গাড়ি হিসেবে খ্যাত মুড়ির টিন ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। যা আসার নির্দিষ্ট সময় ছিলনা।
যা আজ দুঃসময়। কিন্তু সে সময়ও এক জীবন্ত সংগ্রাম ছিল। এক চলমান যুদ্ধ ছিল। আমার দেখা সেই বারুদের গন্ধ, সেই জীবন্ত সংগ্রাম, সেই চলমান যুদ্ধ...এক সংগ্রামী নাম “মা” । কেবল সন্তানদের সুখের জন্য আজও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে সে।
এখনোও মা কে বলতে শুনি, “তোরা আমায় দেখ বা না দেখ, আমায় দেখবে পাথারের ব্যাটা। ”
পাথারের ব্যাটা। যে শহরটায় আমরা থাকি তা থেকে ১২ কিমি দুরে শোলাগাড়ি গ্রাম। সেই গ্রামে মায়ের ছিল গাভিন ক্ষেত, পোয়াতী ক্ষেত, ছিল প্রসূতি ক্ষেত । কিছু পাশাপাশি কিছু এলো পাথারি শুয়ে থাকে তারা গ্রামের এখানে সেখানে।
মায়ের হাতের ছোঁয়ায় তারা পোয়াতী হয়। মায়ের শশ্রুষায় তারা প্রসূতি হয়। আর তাতে আমাদের দেহ বাড়ে। মাংস পেশি বাড়ে-শক্ত হয়। এই হলো আমার মায়ের পাথারের ব্যাটা।
শহরে মন টিকতো না মা’র। পাথারের ব্যাটাদের জন্য মন কাঁদতো। তাই প্রায় যেতো হতো গ্রামে। সেদিন পড়ন্ত বিকেলে মা আমাকে আর বড় ভাই লাবু কে নিয়ে রওয়ানা দিলো গ্রামের উদ্দেশ্যে। পীরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে বড়দরগা।
মাত্র আট কিমি। তারপর পায়ে হাটা মেটো পথ। শোলাগাড়ি গ্রাম। আমার বাবার পৈত্রিক ভিটা। সেদিন আমরা যখন বড়দরগায় পৌছিলাম তখন সন্ধ্যা হয়েছে।
চারদিকে অন্ধকার। আমাদের জন্য হারিকেন হাতে আর একটি মাত্র ছাতা নিয়ে অপেক্ষা করছিল জ্যাঠাতো ভাই গোলজার। আমাকে কোলে নিলো মা। আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ। আর সাত বছরের লাবু গোলজার ভাইয়ের পীঠে।
এলোমেলো হাটা পথ। কিছু দুর যেতে না যেতে তুমুল ঝড়ো হাওয়া, বজ্রপাত আর বৃষ্টি শুরু হলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম..মা...মা...মা। মা আমাকে ঝাপটে ধরলো বুকের মাঝে। বললো-ভয় পাসনে বাবা।
তারপর দোয়া দরুদ পড়া শুরু করলো। বড় ভাই লাবু ভয়ে কেঁদে উঠলো। বাতাসের গতিবেগ কাঁটিয়ে সামনে এগুতে পারছিলনা মা। গোলজার ভাই ছাতা ধরে আছে মায়ের মাথায়। চারদিকে বিরান পাথার।
জন-মাবনহীন। কোথাও কেউ নেই। একমাত্র সম্বল হারিকেনটাও নিভে গেলো ঝড়ের ঝাপটায়। মাঝে মাঝে আকাশে বিজলী বাতি ঝিলিক মারছে। সেই আলোতে একটু একটু করে পথ চলা।
মা বার বার বলছে, আর একটু বাবা আর একটু। আমি ভয়ে মাকে এমনভাবে পেচিয়ে ধরেছি, বুঝতে পারলাম মা’র শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। মা হাফিয়ে গেছে। বৃষ্টি ঝরছে মুসুলধারে। মা ভিজে একাকার।
ঝড়ো হাওয়া বইছে তীব্র গতিতে। মায়ের পা টলে টলে যায়। আকাশে বিজলী আর বিকট শব্দে বাজ পড়ছে। মা আরো জড়ে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে আমায়।
হঠাৎ কাছে পীঠে কোথাও বাজ পড়লো বিকট শব্দ করে।
আমরা দু’ভাই কেঁদে উঠলাম। মা এবার পড়ে গেলো অথৈ সাগরে। অধিকতর জোরে জোরে কালেমা পড়তে লাগলো। গোলজার ভাই বললো, ভয় পান না বাহে চাচী। এইতো আসি গেইছি।
আমি বুঝতে পারলাম মায়ের বুক ধড়ফড় করছে। এমনিতে আমাকে কোলে নিয়ে হাটতে হাটতে হাফিয়ে উঠছে তারপর আবার বিপদ। মা অস্পষ্ট স্বরে বললো, হে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করো। আমাকে উষ্ণতা দেবার মতো উষ্ণতা ছিলোনা মা’র শরীরে। তার গোটা শরীর ভেজা।
তারপরও যমের হাত থেকে প্রিয় সন্তানকে বাঁচাতে মা’র চেহারায় ফুটে উঠেছিল সংগ্রাম। অবেশেষে ওই ঝড়ের হাওয়া কে পরাজিত করে মা আমাদের নিয়ে পৌছিল বাড়িতে।
সে রাতে মা ঘুমিয়েছে কিনা জানিনা। আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। পরের দিন ভোরে আমার মা........মা..........মা চিৎকার শুনে মা ছুঁটে এসে বললো, কি হইছে বাপ।
আমি চোখ না খুলেই মায়ের গায়ে সদ্য প্রসূতি জমির ধানের গন্ধ পেলাম। বুঝতে পারলাম সাত সকালেই মা শুরু করেছে ধানের কাজ। চোখ খুলে দেখলাম মায়ের চোখে আনন্দের ঝিলিক। গত রাতে সব বিপদের কথা মা মনে হয় ভুলেই গেছে। মা আমাদের দুই ভাই কে ডেকে তুলে বললো, চল চল দেখবি আমার পাথারের ব্যাটারা আমাকে কত ধান দিয়েছে।
এবার আমাদের কোন অভাব থাকবেন না। মা’র হাসি মাখা মুখ দেখে আমরাও বোধ হয় ভুলে গেলাম সেই ভয়াবহ রাতে কথা।
আজ বিদ্যুতের আলোয় গোটা এলাকা ছয়লাব। আজ ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে এক সাথে পাশাপাশি চলতে পারে দুতিনটা গাড়ি। আজ আর লোকাল মুড়ির টিন চোখে পড়েনা।
আজও আমার মা আছে। কেবল আজ তার শরীর জীর্ণশীর্ণ। আগের মতো বল পায় না। আমরা তার দেখ ভাল আসলেই করতে পারিনা। তাকে দেখে তার সেই পাথারের ব্যাটা।
মা আজও সেই জীবন্ত সংগ্রাম।
সেবু মোস্তাফিজ
রচনাকাল: ৩১ মে ২০১০
পীরগঞ্জ-রংপুর
রাত ৮টা ৪৫মিনিট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।