ব্ল্যাঙ্ক
০১.
সেই কবে থেকে একটা বহু আরাধ্য ছন্দময় সুর কন্ঠে তুলতে আমি প্রাণপাত করে যাচ্ছি কেবলি - হয়ে ওঠে না কিছুতেই! অদ্ভুত রকমের বেসুরো আমার গলা বরাবরই, আর খেয়ালী - কেবল অদ্ভুত সব সৃষ্টিছাড়া সুর তুলতে ব্যস্ত। তখন থেকেই মনে মনে একটা বেহালা খুঁজে বেড়াই শুধু অহর্নিশ। তাতে ক্ষ্যাপাটে আর ছন্নছাড়া সুরগুলো সব সাজিয়ে রাখতাম নিজের মতন করে। সেই বেহালা আর পাওয়া হলো না কখনো- অদ্ভূতুড়ে সুরগুলো সব ভেসে রইলো অনিঃশেষ শূন্যকে পরিব্যাপ্ত করে, নিঃসঙ্গ ছায়ার মত তারা দিবানিশি ঘুরতে লাগলো আমার চারপাশ ঘিরে - এলোমেলো,বিস্রস্ত হয়ে.......
সেই থেকে একটা ছোট্ট ফিনিক্স হয়ে গেছি আমি। আচমকা ধেয়ে আসা একেকটা ধূমকেতুর আঘাতে কেবলি পুড়ে পুড়ে ছাই হই- তবু অপার্থিব কোনো মিথস্ক্রিয়ায় অবিনাশীর মতন জেগে উঠি পুনর্বার......
০২.
পূর্ণতা সবসময় প্রাপ্তিতে হয় না, কিছু কিছু অপ্রাপ্তিরও পূর্ণতা থাকে।
আমি পূর্ণ হয়েছি আমার অপ্রাপ্তিতে। আমি নিঃসঙ্গ হয়েছি, দলছুট হয়েছি, বিক্ষিপ্ত উপগ্রহের মত বাঁধনছাড়া হয়ে একাকী ঘুরে বেড়িয়েছি শত শত দলবদ্ধ উজ্জ্বল গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝে, কখনো সংঘর্ষ হয়েছে - আমি পরোয়া করিনি, প্রচ্ছন্ন বিষাদের সিম্ফনি আঁকড়ে ধরা আমার খেয়ালী সুরগুলো নিয়ে আমি দুহাতের আঙ্গুলে খেলা করেছি অবিরত, তাকে ভেঙ্গেছি,গড়েছি,তাকে নতুন করে করেছি সৃষ্টি, করেছি বিনাশ - আর সেই সাথে আমি পূর্ণ হয়েছি..........পূর্ণ হয়েছি.........পূর্ণ হয়েছি.........
০৩.
কিছু কিছু অন্ধকার কেবল অন্ধকারই রয়ে যায়। যেমন কিছু পাপ বড় বেশি মৌলিক আর অপ্রতিরোধ্য! তার বিস্তার সর্বব্যাপী আর সর্বগ্রাসী তার প্রকৃতি। পৃথিবীতে পদার্পণের পর একটা ত্রিমাত্রিক চতুষ্কোণ দেয়ালঘেরা আবদ্ধ ঘরে ছিল আমার বসবাস। কঠোর সুরক্ষা আর নিশ্ছিদ্র সতর্কতার শৃঙ্খলে সীলমোহর করা ছিল তার প্রতিটি কোণ - আমি সেই নিরাপত্তাব্যূহের মধ্যিখানে ছিলাম নীলকান্তমনির মত।
তবু সেই সর্বগ্রাসী অন্ধকার ব্যূহ ভেদ করে ছুঁয়ে ফেলল আমায়.......আমি হতচকিত হলাম,বিব্রত হলাম,অবশেষে অন্ধকারের তীব্রতা দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হলাম। কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলাম পদতলের মাটি আর উদ্ভ্রান্ত হয়ে এক জন্মান্ধ সারসের মত কেবলি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম আকাশ বাতাস পাতাল - বিশ্বাসের খোঁজে,আশ্রয়ের খোঁজে........
হঠাৎ, একেবারে হঠাৎই বিদ্যুতের মত চমক দিয়ে জেগে উঠলো আমার ক্রমশ নিস্তেজ হতে থাকা প্রাণ.........আমি ফিনিক্স......অবিনাশী ফিনিক্স এক......কে যেন বলে গেল কানে কানে........
নিঃসঙ্গতার পরাক্রমশালী ঘন অন্ধকারে আমি পুড়ে পুড়ে,জ্বলে জ্বলে,শুন্য হয়ে হয়ে অবশেষে হয়েছি সোনা। অন্ধকার দেখে আমার তাই আতঙ্ক হয়না আর এখন ,শুধু অদ্ভুত নির্লিপ্ততা ঘিরে থাকে আমার চারপাশ - মায়ার মত......ছায়ার মত........নিঃশব্দ বাঁশির সুর হয়ে.....
০৪.
কিছু ভাষা,কিছু সুর থাকে হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। আমার তেমনি কাছাকাছি - নৈঃশব্দ্য। শব্দহীনতার অদ্ভুত নিস্তব্ধ জগতে আমি হাজার ভাষা সাজিয়ে রাখি,নিয়ত তাদের দেখি মুগ্ধনয়নে আর ভালবাসি নিঃশ্বাসেরই মত....... প্রতিদিন অজস্র যান্ত্রিক ও মানবিক শব্দ কোলাহলের নিয়ত চিত্কারের মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই ভাষাহীন স্থিরকায়া বৃক্ষদের দলে।
শব্দরা সর্বদা কেবল সরবই নয়,মাঝে মাঝে বিধ্বংসী আর হিংস্রও বটে! সেই বর্ণলিপি পড়ার কালে যখন থেকে শব্দের ঝংকারময়,মোহাবিষ্ট,বর্ণিল বৈচিত্র্যের জগতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমার - অন্তর্ভেদী সব তীব্র শব্দবাণের আঘাতে জর্জরিত আমি কেমন করে যেন শব্দের বদলে ক্রমশ আঁকড়ে ধরেছি নৈঃশব্দ্যকে, আরো বেশি, আরো তীব্র করে। ঝাঁকে ঝাঁকে শব্দবাণ নির্ভুল লক্ষ্যভেদে বিদ্ধ করেছে আমার ক্ষয়িষ্ণু আত্মাকে, আমি নির্বিকার এক বৃক্ষের মত নিস্তব্ধতার সুরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ক্রমশঃ হয়ে গেছি নিশ্চুপ,আরো নিস্তব্ধ,আরো নিঃশব্দ.......
আমার ক্লান্ত দৃষ্টির সামনে একেকটা আলোর পৃথিবী পুড়ে হয়ে গেছে ছাই, আমি নির্লিপ্ত নিরোর মত ধ্বংসস্তুপের মাঝে বসে বাজিয়ে গেছি অনিবার নিস্তব্ধতার বাঁশি......শ্রান্ত হয়ে,অবসন্ন হয়ে,ভাষাহীন অক্ষম হয়ে........
অবশেষে নিঃশব্দেই করেছি দগ্ধ পৃথিবীর সত্কার!
কেননা আমার জন্ম মানুষের নয়,ফিনিক্সের...........এক নির্লিপ্ত অবিনাশী ফিনিক্সের...........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।