আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তেইশ বছর ধরে পেনশনের অপেক্ষায় একটি পরিবার

বৃষ্টি যেরকম আসতে আসতে ফিরে যায়..তেমনি বৃষ্টির মতো আমিও ফিরেছি বহুবার...

১৯৮৭ সালের ১৫ জুলাই চাকরিরত অবস্থায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন টিএন্ডটির (বর্তমান বিটিসিএল) এর লাইনম্যান সন্তোষ কুমার শুক্ল দাশ। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য,মৃত্যুর তেইশ বছর পরও তার পরিবার আজো তার পেনশন পায়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী গীতা রাণী শুক্ল দাশ দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে রাঙামাটি শহরের মাঝেরবস্তি এলাকায় যে অসহায়,নিদারুন জীবনযাপন করেছেন তা দেশের অনেক সিনেমার কল্পিত কষ্টের কাহিনীকেও হার মানাবে। মৃত্যুর সময় বিভাগীয় প্রকৌশলী(টেলিকম),চট্টগ্রাম এর অধীনে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি একচেঞ্জ এর লাইনম্যান হিসেবে কর্মরত সন্তোষ শুক্ল দাশ এর পরিবার কেনো তেইশ বছরেও পেলোনা তাদের প্রাপ্য? এই প্রশ্নের শেকড় খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরেক ইতিহাস। তার পরিবারকে জানানো হয়েছে,সন্তোষের সার্ভিস বুক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা,সেটি হারিয়ে গেছে।

আর টিএন্ডটি কর্তৃপক্ষের এই গাফিলতির দায় বহন করছে একটি পরিবার গত তেইশটি বছর ধরে। এই গ্লানি কার ? সন্তোষ শুক্লের বিধবা স্ত্রী গীতা রানী আবেগ ধরে রাখতে না পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। জানালেন-স্বামীর মৃত্যুর পর তেইশটি বছর ধরে আমি কত জনের কাছে গেছি,পথে পথে ঘুরেছি,ছেলেমেয়েদের নিয়ে না খেয়ে,না দেয়ে কি কষ্টকর জীবনযাপন করেছি,তবুও আমার স্বামীর পেনশনের টাকা পাইনি। ক্ষোভ আর আবেগের আবেশে বিলীন এই রমণী জানালেন-অফিস কর্তৃৃপক্ষ আমার স্বামীর সার্ভিস বুক হারিয়েছে,এই দায় কি আমার? এ দায় কি আমার সন্তানের ? কি অপরাধ করেছে আমার সন্তানেরা? গীতা রাণীর কান্না যেনো আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত ধরে কাঁদাচ্ছিলো পুরো প্রকৃতিকেই,চারদিকের পরিবেশকেই। তিনি আরো বললেন- আমিতো কারো কাছে ভিক্ষা চাইনি,আমি আমার স্বামীর প্রাপ্যই চেয়েছি।

স্বামী মৃত্যুর সময় চারমাস বয়সী যে মেয়েটিকে রেখে গেছে তাকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক কষ্টে। দারিদ্রতার কারণে ছেলেগুলোর পড়াশুনা চালাতে পারেননি,এই দুঃখ তার সারাজীবনের ! গীতা রানীর দেয়া কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেলো,পেনশনের এই টাকা পেতে কি করেননি এই রমণী ! টিএন্ডটির কাছে বারবার ধরণা দিয়েছেন,চিঠি লিখেছেন,গত তেইশ বছরে অন্ততঃ দশবার তিনি বিভাগীয় প্রকৌশলী,টেলিকম বিভাগ,চট্টগ্রাম বরবারে পেনশনের জন্য আবেদন করেছেন,প্রতিবারই চট্টগ্রাম টেলিকম তাদের দায়িত্ব পালন করেছে,টিএন্ডটির প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তাকে চিঠিও লিখেছে,কিন্তু মূলতঃ ঢাকার সেগুনবাগিচাস্থ টিএন্ডটির প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের গাফিলতির কারণেই যে সন্তোষ শুক্লর পরিবার পেনশন পাননি তা কাগজপত্রেই স্পষ্ট। যতবারই চট্টগ্রাম থেকে চিঠি গেছে বেশিরভাগেরই উত্তর আসেনি,যেগুলো এসেছে তাও দায়সাড়া। কখনো উত্তরাধিকার সংকট আবার কখনো সার্ভিস বুক না থাকার অজুহাত দিয়েছে,যদিও ১৯৮৭ সালেই প্রথম পেনশন আবেদনের সাথেই রাঙামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম সাক্ষরিত উত্তরাধিকার সনদ এবং ২০০৭ সালের আবেদনের সাথে নন ম্যারেজ সার্টিফিকেট সম্পৃক্ত করা হয়। তথাপি টিএন্ডটি কর্তৃপক্ষের ধানাই পানাই চলেছেই।

এর মাঝে টিএন্ডটি বিটিসিএল হওয়ার পর আবার আবেদন করেন গীতা রানী শুক্ল দাশ। ২০০৯ সালের আগষ্ট মাসে করা এই আবেদনে সুপারিশ করেন পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারও। এই চিঠির পর দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায় প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তার কার্যালয় । এই কার্যালয় থেকে মাত্র ১০ দিন পরে নিরীক্ষা ও হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন প্রধান সাক্ষরিত পাঠানো প্রতিক্রিয়ায় পাঁচটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। এগুলো হলো-পারিবারিক পেনশনের আনুতোষিক এবং অবসর ভাতা গ্রহণ না করার স্বপক্ষে প্রত্যয়নপত্রের আবশ্যকতা,সন্তোষ কুমার শুক্ল দাশের নিয়োগ আদেশ এবং তাহার সাথে সমসাময়িক নিয়োগকৃত কর্মচারীর নিয়োগের আদেশ,সার্ভিস বহি ও কর্মচারীর ব্যক্তিগত নথি অনুযায়ী বিধি মোতাবেক চাকুরী বহি পুনর্গঠন করিয়া বিটিসিএল বোর্ডের অনুমাদন গ্রহণ এবং যোগদানের তারিখ হতে চাকুরীর শেষ পর্যন্ত যাচাই প্রতিবেদন আবশ্যক,চাকুরী কালিন সময়ে সকল বেতন নির্ধারণী বিবরণী প্রস্তৃত পূর্বক অডিট অফিসে প্রতিপাদন আবশ্যক,অডিপ প্রতিপাদনের পর শেষ মূল বেতন অনুয়ায়ী পেনশন ফরম পূরণ এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আবশ্যক, এবং পেনশন সহজীকরণ বিধি মোতাবেক সংযোজনী-৩,৬,৭,৮,শেষ বেতন প্রত্যয়নপত্র,মৃত্যু সনদ এবং পেনশনারের চার কপি ছবি ও অন্যান্য কাগজসহ পেনশন মজ্ঞুরী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পেনশন কেইস দাখিল করন।

তেইশ বছর যে পেনশনের জন্য দ্বারে দ্বারে,অফিসের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরেছেন সেই পেনশন পেতেই এখন যেসব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে তার কারণ কি? কেনইবা তেইশ বছর পেনশন পেলেন না এই দুঃস্থ পরিবারটি এই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম টিএন্ডটি(বর্তমান বিটিসিএল) এর কর্মকর্তাদের কাছে। কেউই সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে পারেননি। বিটিসিএল এর চট্টগ্রামের বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রদীপ দাশ বলেন-কি বলছেন,আমিতো জানিইনা,আমার কোন স্টাফ এর এই অবস্থার কথা। আমি এখন সন্ধীপ,অফিসে গিয়েই খবর নেব এই নামে আমাদের কোন স্টাফ ছিলো কিনা আর সমস্যাটি কি? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন,তারা তেইশ বছর পেনশন চায়নি কেনো? এই প্রতিবেদক যখন তাকে তারা অন্তত দশবার আবেদন করেছে জানালে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে নিজেই খোঁজ নিবেন বলে জানান। একদিন পর তার সাথে আবার যোগাযোগ করলে তিনি বলেন-আমি বিষয়টি খোঁজ নিয়েছি,সে আমাদেরই স্টাফ,ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক।

তিনি স্বীকার করেন-পরিবারটির কোন দোষ নাই,আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এজি অফিসে ফাইল পাঠিয়েছিলাম,কিন্তু এজি অফিস বলেছিলো ফাইল পায়নি,তাই ফাইল হারিয়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিনেও পেনশন পায়নি তার পরিবার। এখন আমি চেষ্টা করব আবার,দেখা যাক কি করা যায়। তবে সন্তোষ এর সাথে একসাথে চাকরী করেছে এমন কাউকে না পেলে সার্ভিস বুক ঠিক করা অসম্ভব বলে জানান তিনি। আর সন্তোষের ছোট সন্তান এবং তরুণ সংগীতশিল্পী প্রদীপ দাশ সেগী বলেন-আমি জানিনা,আমরা মা তার জীবদ্দশায় আমার বাবার পেনশন পাবেন কিনা ! সেই ছোট বেলা থেকেই মা আমাদের নিয়ে অফিসে অফিসে ঘুরেছেন,আমার বাবার পেনশনের জন্য। কত কষ্টে আমাদের মানুষ করেছেন,কিন্তু কেনো আমরা আমাদের বাবার প্রাপ্য পেনশনটা পেলাম না বলতে পারেন? কার দোষে পুরো একটা জীবন কেটে গেলো আমাদের? কেনো আমি টাকার অভাবে এসএসসির ফরম ফিলাপ করতে পারি নাই বলে পড়াশুনা ছেড়ে দিতে হলো ? কেনো আমার বাবা সরকারী চাকরী করা সত্ত্বেও আমরা বস্তিতে কুঁড়ে ঘরে অসহায় জীবন কাটাচ্ছি তেইশটি বছর ? সেগীর এই প্রশ্নের উত্তর এই প্রতিবেদকের জানা নেই।

খোদ টিএন্টটি কর্তৃপক্ষই জানেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু সরকারের একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী তার মৃত্যুর তেইশ বছর পরও তার পেনশন পাবেনা,এই লজ্জার দায়,কেবল টিএন্ডটিরই নয়। সরকারেরও। রাষ্ট্রকাঠামোও কি এড়াতে পারবে এই দায়? এই লজ্জা কি আমাদেরও নয় ? আর কতদিন একজন গীতারানীকে তার স্বামীর প্রাপ্যের জন্য পথে পথে ঘ–রে বেড়াতে হবে কে জানে ! মানুষের প্রয়োজন,মানুষের বেঁচে থাকা কি আইনেরও উর্ধ্বে ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।