আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিবাগী এ মনটা....................।

সত্যি সবকিছু ততোটা সহজ না, যতটা আমরা মনে করি। জীবনা সত্যি অঙ্গুত।

হেমন্তের ছোঁয়া লেগেছে মাঠে। হৈমন্তী বাতাসে গাছের পাতা শনশন করে যেন রাগ হেমন্তের সুরে গান গাইছে। আগনের সোনালী ধানে ভরে আছে মাঠ।

আঁকাবাঁকা শ্যামল গ্রামগুলোর মাঝে ধানের সোনালী মাঠ- সবুজের মাঝে স্বর্ণ মিলে এক অপরূপ রূপ। নিসর্গের এই রূপ দু’চোখে পান করে মাঠের অদূরে বটগাছের ছায়ায় বসেছিল রাখাল। মাঠ এখনও খালি হয়নি, তাই গরুগুলোকে নদীর ধারের রাস্তায় দড়ি দিয়ে গণ্ডি বেঁধে চরতে দিয়েছে। এই সময়ে ঘরে বসেও থাকা যায়। দড়ি টেনে ছিঁড়ে ফসলের কোন ক্ষতি গরু করতে পারবে না।

তবুও রাখালের রাখালী স্বভাব। খোলা হাওয়া উদল গায়ে না লাগলে কি আর ভাল লাগে। অবশ্য এই কয়েক মাস ধরে অন্য একটি কারণও আছে। অদূরেই পরদেশী কৃষক কুদ্দুসের কুঁড়ে ঘর। প্রতি বছর আমনের মৌসুমে দূর অঞ্চল থেকে অনেক কৃষক আসে জীবিকার সন্ধানে।

এবারও এসেছে। তাদেরই একজন কুদ্দুস। আমনের জমি তৈরি থেকে শুরু করে আমন ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত তারা অস্থায়ী কুঁড়ে ঘরে দিনাতিপাত করবে। নদীর পাশে বাবুদের একখণ্ড পতিত জমিতেই ঘর তুলেছে কুদ্দুস। ছোট্ট একখানি ঘর।

অন্য সবার সাথে যার যার পরিবার থাকলেও কুদ্দুসের সাথে তার একমাত্র মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। রাখালের রাখালী স্বভাবের কারণ কুদ্দুসের এই মেয়ে। শ্রাবণ মাসের কথা। অঝোর ধারায় ঝরা বৃষ্টিতে ভিজে অভুক্ত গরুগুলোকে রাস্তার ধারের ঘাস খাওয়াচ্ছিল রাখাল। চরে খাওয়া গরু- কাটা ঘাসে তাদের মন ভরে না।

তাই বৃষ্টিতে ভিজেও তাদের দেখভাল করছে রাখাল। এমনই ঘন বর্ষায় ঘনঘটা মাখা আকাশের তলে ঘনঘটা কুন্তলে সজ্জিত এক শ্যামাঙ্গিনীর সাথে চোখের মিলন হয়েছিল রাখালের। সে অদূরের কুঁড়ে ঘরে ফিরছিল। কলার পাতা ছাতা করে মাথায় ধরে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তবুও বৃষ্টির জলে তার শরীর ভেজা।

বাড়ন্ত লাউ লতার কচি ডগার মত শ্যামাঙ্গী তনু। রাখাল তার চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইলো। চোখ যেন তার কাজলা দিঘির জল। অপ্রত্যাশিত চোখাচোখিতে থেমে গিয়েছিল শ্যামাঙ্গিনীর পা, সেও তাকিয়েছিল। তারপর চোখ নামিয়ে সে দ্রুত চলে গিয়েছিল।

একই গাঁয়ে বাস তবু- রাখালের চোখে পড়েনি এমন শ্যামশ্রী। ভাবুকের মত চেয়ে রইলো সে কন্যার পথের দিকে। ঠিক যেন লাউ লতার কচি ডগা- জলে ভিজে একাকার। কোমল তনুতে ঢেউ তুলে তার পথ চলা, যেমনটি মৃদু বাতাসে মাচাঙের লাউ লতায়ও দোল জাগে। এভাবেই শুরু।

এরপর থেকে পিতার শাসক চোখের আড়ালে পথের ধারে দাঁড়িয়ে রাখালের সাথে হত তার দৃষ্টির বিনিময়। কোন কথা হয়নি- চোখের ভাষায়ই রচনা হয়ে যেত মহাকাব্যের- মনের মহাকাব্য। ‘কাজল দিঘির জল’ চোখে চেয়ে রাখাল বুঝে নিত মনের কথা। আকাশে চাঁদ উঠলে যেমন কাজল দিঘির জল হেসে উঠে, রোদের ছটায় যেমন জ্বলে উঠে; আর আষাড়ের ঘনঘটা আকাশের তলে যেমন বিষণ্ন হয়ে যায়- তেমনি শ্যামাঙ্গিনীর চোখেও ভাসে সুখ-শিহরণ, মান-অভিমান। তবু কোন কথা হয়নি কোনদিন।

চোখের কথায় যদি হৃদয়ের কথা বলা হয়ে যায়- কি আর প্রয়োজন বাক্য ব্যায়ের। একদিন কাজের ঝামেলার রাখালের আসতে দেরী হয়েছিল। শ্যামাঙ্গিনী পথ চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়েছিল। অপেক্ষার প্রহরে প্রতি পলে পলে যে মরতে হয় তা সে তখন বুঝেছিল, আর সেইজন বুঝতে পারবে যে কখনও এমনিভাবে প্রতিপলে মরেছে। কাজ শেষে রাখাল গরু নিয়ে নদীর ধারে এসেছিল।

সেদিন শ্যামাঙ্গিনীর অন্য এক রূপ দেখেছিল সে। আলুথালু কেশে কলা ঝোপের আড়ালে দাঁড়ানো সে। দখিনের বাতাসে চুলগুলো উড়ছে। রাখালকে দেখে তার চোখে জেগেছিল অভিমানের আগুন। চোখের ভাষায় যেন তর্জন-গর্জনের পর নেমেছিল ঢল।

আর রাখালের বুকেও ডেকেছিল বান। মেয়েকে না দেখে পিতার উচ্চস্বরের ডাকে সেই দৃশ্যের সমাপ্তি হয়েছিল সেখানে। শ্যামাঙ্গিনী আঁচলে চোখ মুছে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু রাখালের মনের আকাশে যে ঘনঘটা সূর্যকে আড়াল করেছিল তা সারাদিন-সারারাত আকাশের সাথে সাথে রাখালের পৃথিবীকেও পাংশুটে করে রেখেছিল। হায় প্রেম!- চোখের জলে তোমার অঞ্জলি, বিরহের স্তব; চোখের জলেই সুখ।

চোখের কথায় কথায় চোখে চোখে চোখাচোখি, চোখে চোখে কানাকানি- প্রেমের বয়স বেড়েছিল আমন ধানের চারার মত। তারপর সময়ের স্রোতে হেমন্তের সোনার ছোঁয়া এসে লাগলো। মাঠে মাঠে পড়ে গেল সাড়া। ধান কাটো- ঘরে তুলো। এই ব্যস্ততার দিনেও কষ্ট করে হলেও রাখাল বটের ছায়ায় এসে দাঁড়াত।

আর কোন অজুহাতে শ্যামাঙ্গিনী চোখেতে চোখের দর্শন দিয়ে যেত। যে কোলাহলে শুরু হয়েছিল মাঠের নবান্ন, কিছুদিন যেতেই শান্ত হয়ে গেল। গৃহস্থের গোলায় উঠে গেছে সোনার ধান। কুদ্দুসের যাবার সময় হয়ে গেছে। রাখাল জানে না কিছু।

শুধু শ্যামাঙ্গিনীর চোখে অজানা ভয়। মনে মনে ভেবেছিল রাখাল এসে তার সাথে কথা বলে যাবে। চোখের ভাষার সাথে মুখের কথার স্বাদ নিতে সাধ জেগেছিল তার মনে। শেষে শরমের মাথা খেয়ে পণ করেছিল- কাল সকালেই বলবে সে রাখালকে। - যা করার তাড়াতাড়ি করো- আমার যে যাবার সময় হয়ে এলো, তোমার মুরুব্বী কাউকে পাঠিয়ে দিও বাবার কাছে।

এই কথাগুলো কিভাবে বলবে তা নিয়ে কত জল্পনা-কল্পনা করেছিল সে। ভেবেছিল, মাথা নিচু করে আঁচলে মুখ ঢেকে কথাগুলো বলেই পালাবে সে। পরক্ষণে ভেবেছিল- কথা বলার পরে একটু রাখাল্র চোখে চেয়ে দেখবে। তারপরে তার জবাব শুনবে। এভাবেই ভাবতে ভাবতে বিকেল হয়ে গেল।

সূর্য পাটে গেল- সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সন্ধ্যা হতেই কুদ্দুস বাড়ি ফিরলো। বাবুদের কাছ থেকে সকল পাওনা সে আজ পেয়েছে। বাড়ি এসে মেয়েকে বললো- কই রে মা; সবকিছু গুছাই নে। কাইল সকালেই দেশের পথে পা বাড়ামু।

এই কথাগুলো শ্যামাঙ্গিনীর কানে বজ্রপাতের মত লেগেছিল। সে শুধু মৃদু স্বরে বলেছিল- আর কিছুদিন থেকে গেলে হয় না বাপু? না রে মা; কাইল সক্কলে রওয়ানা দিব। কাজ-কাম সবই শেষ; কি আর করুম এইখানে থাইক্কা। পরদিন দ্বিপ্রহর বেলায় রাখাল দ্রুত পায়ে এসেছিল বটগাছের তলায়। আজ আসতে একটু দেরী হয়ে গেছে।

সে মনে মনে শঙ্কিত আজ- এই দেরীর জন্য কি যে জবাব দেবে। সে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু আজ আর কেউ গাছের আড়াল থেকে চোখে চোখে কথা বলতে আসেনি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাখাল কুদ্দুসের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। দূর থেকেই দেখতে পেল কুঁড়েঘরের বাঁশের দরজায় তালা দেওয়া।

রাখালের বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। সে তড়িত পায়ে এগিয়ে গেল। কুদ্দুস মিয়া কুদ্দুস মিয়া বলে ডাক দিল- কারও কোন সাড়া নাই। তার সেই ডাকগুলো চারপাশে প্রতিধ্বনিত হয়েই ফিরে এলো। রাখাল ঘরের পাশে কলা গাছের ঝোপের দিকে এগিয়ে গেল- যেখানে দাঁড়িয়ে থাকত তার শ্যামাঙ্গিনী।

শ্যামাঙ্গিনীর পায়ের দাগ সেখানে রয়ে গেছে, শুধু মানুষটা আর নেই। হঠাত চোখ পড়লো মাটিতে লেপে দেওয়া দেওয়ালে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতে সেখানে কিছু লেখা রয়েছে। বানান করে করে রাখাল পড়ে নিল। শ্যামাঙ্গিনী লিখে গেছে- আমাকে মনে রাখিও তুমি।

পরদেশীর সাথে কখনও মনের বিনিময় করো না। এই কথা বহুবার শুনে এসেছে রাখাল। কেন যে মানা করে গেছে পূর্বজ জন তার কারণ আজ খুঁজে পেল। ফিরে এসে আবার বট গাছের ছায়ার তলে বসলো। তার শুধু মনে হতে লাগলো সেই ‘কাজল দিঘির জল’ চোখের কথা।

তার চোখদুট জলে টলমল হয়ে গেল। রাখালের মনে হতে লাগলো শ্যামাঙ্গিনী বিহনে তার জীবন বৃথা। পরদিন সকালে সেই বটগাছ আর কলাগাছের ঝোপকে সাক্ষী রেখে রাখাল শ্যামাঙ্গিনীর খুঁজে দেশান্তরী হলো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।