আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিবাগী বিরিখ

কুড়াই প্রহরব্যেপে স্মৃতিলগ্ন ধূলি ১. খুব কম বয়সেই আমি দাঁড়াতে শিখে যাই মাত্র আট-নয় মাসেই হাঁটতে শুরু করি! এখনো হাঁটি, তবে দাঁড়াতেই বেশি পছন্দ আমার। স্থান-কাল ভুলে চেয়ার ছেড়ে কখন দাঁড়িয়ে যাই নিজেই টের পাই না! কারণে-অকারণে আমাকে ঘন ঘন দাঁড়াতে দেখে এক-আধজন আড়চোখে তাকায় বটে, অতোটা আমলে নেয় না কেউ। চোখে বেখাপ্পা ঠেকলে হয়তো ভাবে-- অভ্যেস! মুদ্রাদোষ! কি করে যে বলি দাঁড়ানোটা কিছুতেই সংবরণ করতে পারি না। ওটি আমার জিনোমেই সেঁটে দেয়া! ত্রিভঙ্গ হয়ে চেয়ারে, সোফায় বা বেঞ্চিতে বসলে কেমন উশপিশ লাগে, অস্বস্তির শুঁয়াপোকা কিলবিল করে। হাঁটু মুড়ে বা আসন-পিঁড়ি হয়ে বসতে গেলে তো চিৎকাত হয়ে পপাত ধরণীতল! শুলে কেবলই মনে হয়, আমার সূর্যমুখী শিরদাঁড়ার কশেরুকাগুলো নিঃশব্দ বিদ্রোহে উচাটন করছে।

২. আসলে আমি ছিলাম শালবন বৌদ্ধবিহারের পাশে একটি দীর্ঘকায় শালগাছ, ঋজু, সটান! বেশ বয়েস হয়ে গিয়েছিলো; বয়সের ছাপ পড়ে গিয়েছিলো সর্বাঙ্গে-- মোটা শেকড়, স্থূল কাণ্ড, ঈষৎ নমিত শাখা-প্রশাখা, ছালে সময়ের রেখাঙ্ক প্রকট হয়ে উঠেছিলো। লোকে ঠাট্টাচ্ছলে মহাস্থবির বিশাল বলে ডাকতো। দীর্ঘদিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খিল ধরে গিয়েছিলো পায়ে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো হেমলক শুষে নিতে নিতে পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিল হরিৎ ফুসফুস। তা, একদিন ভাবলাম আর কতো এভাবে শেকড়ের শেকলে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো নিছক নির্বাক দর্শক সেজে? একটু এদিক-সেদিক ঘুরে আসলেই তো পারি।

কি যেনো বলে হাওয়া-বদল? দরকার আছে না? আলবৎ! ৩. বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখতে কি যে ভালো লাগে! গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সব বাচ্চার মানুষের চারা হলে তো কথাই নেই! নিজের জন্ম-ভাগ্যের উপর বিরক্ত হলাম মনে মনে একচোট গালও দিয়ে নিলাম। নাহ্, আমাকে হাঁটতে হবে, ছুটতে হবে ঘুরে বেড়াতে হবে চরাচরে। বিপুলা ধরণীর বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধের অমোঘ হাতছানি আমাকে উদগ্রীব করে তুললো, মনে সংকল্প দানা বাঁধলো-- ভাবলাম মনুষ্যশাবক হতে পারলে বেশ হবে শুধু এক পায়ের জায়গায় দু’পা, উড়তে বা সাঁতার কাটতে তো পারবো না চারপেয়ে পশু হতে গেলেও বিপদ, আমার আবার ঝুঁকে পড়ার অভ্যেস নেই। ৪. একদিন ঠিক ঠিক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে চুপিসারে আমার গাছশরীর থেকে বেরিয়ে সন্তর্পণে ঢুকে পড়লাম বিহারে বেড়াতে আসা এক দর্শনার্থীর জঠরে। বলতে কি মেয়েটাকে আমার খুব মনে ধরেছিলো-- শ্যামলা।

কিন্তু স্নিগ্ধ ও মায়াবী চেহারা। একহারা গড়ন। শালগাছের সাথে বেশ মিল। এক যুবক আড়ালে শালপ্রাংশু বলে মন্তব্যও করেছিলো মনে হয়, হবেও বা। সেই বৃক্ষ-জন্মের স্মৃতি তো ঠিক মনে করতে পারছি না।

সময়ের ধুলো জমে ঝাপসা, আবছা হয়ে গেছে। ৫. হ্যাঁ, যা বলছিলাম, মেয়েটার সাথে শুধু চারটা ছোট-বড় মেয়ে-সন্তান দেখে আমার বুঝতে বাকি রইলো না তার কোনো ছেলে-পুলে নেই। তাই পুত্র-সন্তান কামনায় বুঝিবা কোনো মানস নিয়ে বিহারে এসেছিলো। কে জানে! ইশ্, মেয়ে মেয়ে করছি কেনো? ও তো আমার মা। হ্যাঁ, মা-ই তো! আমি প্রথমে নিষিক্ত পরাগ-রেণু হয়ে ব্যাঙাচির মতো সাঁতরে তার গর্ভাশয়ে পৌঁছলাম।

এরপর ভ্রূণাঙ্কুর হয়ে লেপ্টে রইলাম গর্ভকোষের দয়ার্দ্র দেয়ালে। পরে গোলাপ-কলির সুকুমার সুষমায় মানব-প্রসূন হয়ে বেড়ে উঠার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা। কষ্ট তো একটু লেগেইছিলো-- বদ্ধ কুঠুরীতে দশমাস দশদিন সারাক্ষণ কুণ্ডলী পাকিয়ে গুঁটিসুঁটি মেরে থাকা! আর জন্মদরোজা ভেদ করে উদ্ভিন্ন হওয়ার উন্মুখ, অধীর অপেক্ষা... হাত-পা নিশপিশ করতো; অত্তোটুকুন জায়গায় কতো আর হাত-পা ছোঁড়া যায়? ৬. এক সময় আমের আঁটি ফেটে অঙ্কুর ফোটার মতো যথারীতি ভূমিষ্ঠ হলাম মায়ের পায়ের জবা-কুসুম চুম্বন করে। মায়ের সে কি ভীষণ কষ্ট! এদিকে অপেক্ষার পালা শেষ বলে আমার আনন্দ ছিলো সীমাহীন, কিন্তু মায়ের কাতর প্রসব বেদনা, অসহ্য যন্ত্রণা দেখে আঁতুরঘরের মেঝেতে পড়ে আনন্দ-উল্লাস ভুলে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলাম। কিন্তু সন্তানের মুখ দেখে তার সমস্ত কষ্ট-ক্লেশ মুহূর্তেই কোথায় উবে গেলো! বিশেষ করে পুত্র-সন্তান পেয়ে নিমিষেই মা হয়ে গেলেন উষ্ণ জলের প্রফুল্ল ফোয়ারা।

৭. বাবা থাকতেন শহরে- বেশ দূরের পথ। তার কাছে খবর পৌঁছলো টেলিগ্রামে। খুশিতে ডগমগ আর হন্তদন্ত হয়ে তিনি উড়ে এলেন কাল-বিলম্ব না করে, পাড়া-পড়শীদের ভিড় তো আছেই! চারদিকে সন্দেশ, মিষ্টি উড়তে লাগলো রকমারি বাহারি বেলুনের মতো এগানা-বেগানা, শত্রু-মিত্র কেউই বাদ পড়লো না। পুত্র-সন্তানের জন্যে এতো আকুলি-বিকুলি এমন ধুন্ধুমার মাতামাতি আমার কাছে একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হলো, হয়তো আমি গাছ বলে। গাছের রাজ্যে আবার মেয়েদেরই কদর কিনা! ফলবতী আর পুষ্পিতা তো হয় মেয়ে গাছেরাই।

৮. হ্যাঁ, বলেছি না? আমি চার-চারটি বোন পেয়েছি? এবার চার-বোন-চম্পক পেয়ে ওরা মহাখুশি! যেনো বহুদিন পর ব্যালকনি আলো করে ঝুলনা টবে ফুটেছে স্বপ্নাকাক্সক্ষার বিরল পুষ্পরাজ! আনন্দে লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করলো ওরা পাখির মতো কিচির-মিচির, ঠোকরা-ঠুকরি এলোমেলো ডানা ঝাপটানি, হুড়োহুড়ি। মায়ের কোল থেকে ছোঁ মেরে লুফে নিতে টানাটানি শুরু করে দিতো, কার আগে কে নেবে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি। ৯. কিন্তু মা আমাকে কিছুতেই কোল-ছাড়া করতে চাইতেন না চোখের আড়াল তো না-ই! ওদের নাছোড় আবদারে হার মেনে কারো সাথে কোল-বদল করলেও উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হয়ে থাকতেন-- অ্যাই সেজো! ব্যাথা পাবে! পড়ে যাবে দেখিস! মেজো! খেয়াল রাখবি কিন্তু! উৎকণ্ঠা আর ওদের সাবধান করতে করতে মায়ের গলার গঙ্গা শুকিয়ে যেতো, শেষে নিজের বুকে-কোলে ফেরত পেলে তবেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন। চুমোয় চুমোয় ভিজিয়ে একাকার করে তুলতেন আমার তুলতুলে মুখের ভূগোল। আর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিতেন আলগোছে।

তার কোমল হাতের পেলব পরশে আমার চরম লাগতো। আদর-আপ্লুত হয়ে মানবজনম সার্থক ভাবতাম। ১০. এদিকে আমার আবার মাটিতে নেমে হামাগুড়ি দিতে তর সইতো না-- ইশ্ কখন যে দাঁড়াবো, হাঁটবো, ছুটে বেড়াবো! মায়ের কোলে খালি চুলবুল চুলবুল করতাম। তাছাড়া মা যেভাবে আমার আগাপাছতলা নাক ঘঁষে ঘঁষে গন্ধ শুঁকতেন, ভয়ের অক্টোপাস মনটা খামচে ধরতো ধুক করে উঠতো বুকের ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটা, পাছে কোন সময় না জানি আবার তার নাকে ভুস করে হরিৎ গেছো ঘ্রাণ ঢুকে পড়ে! কোল ছেড়ে নামতে পারলেই বাঁচোয়া। ১১. আর একটা কথা।

বলতে তো ভুলেই গিয়েছিলাম। গরুবাছুরদের মায়ের পুরুষ্টু ওলান থেকে আয়েশ করে দুধ খেতে দেখে আমারও ভারি লোভ হতো লোভাতুর লিপ্সার লালা জমে যেতো নোলায়। মনে মনে কতোবার বাছুর হতে চেয়েছি! ইশ্শিরে! যদি বাছুরের দুধভাই হতে পারতাম! মানব-শিশু দুধ খায় কিনা আমার তখনো জানা ছিলো না। পরে মানুষ-জন্মের পর যখন আমি ওঁয়া ওঁয়া ওঙ্কারে তারস্বরে কাঁদতে শুরু করি, আমাকে সস্নেহে কোলে নিয়ে মা তার ডান স্তনের খয়েরি বোঁটাটি আলতো করে আমার মুখে পুরে দিলেন। আমি অভূতপূর্ব আস্বাদনের আনন্দে বিস্মিত ও শিহরিত হলাম।

মাতৃস্তন এতো কোমল আর উষ্ণ! দুধও! অপূর্ব! ১২. ওটাকে তো শালদুধ বলে, তাই না? কি শালগাছের কথা মনে পড়ছে বুঝি? আমিও বেশ মজাই পেয়েছিলাম। অবশ্য, খটকা যে একটু লাগেনি তা নয়। গাছেদের তো আবার দুধ খাওয়ার ব্যাপার-স্যাপার নেই। সেকারণেও। পরে জেনেছি শালদুধ পুষ্টিতে ভরপুর স্তন্যামৃত।

আমি, কি বলবো? পুরোটাই খেয়েছিলাম। মা কৃত্রিম বিস্ময়ের ছলে বললেন, ওমা! এ যে দেখি রাক্ষুসে হবে মা! সাথে সাথে আমার নানী মুখে তর্জনী চেপে বললেন, ছি! হতচ্ছাড়ি! কি যা-তা বকছিস? এমন অলক্ষুনে কথা মুখে আনে কেউ? তুই না মা? মা লজ্জায় চুপ হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে আদর করতে লাগলেন। আমার খুব হাসি পেয়েছিল কিন্তু, আমি তো তখনো হাসতেই শিখিনি! শিখলে নিশ্চয়ই ফিক করে হেসে ফেলতাম। ১৩. তো, আমাকে দুধ ছাড়াতে মাকে যার-পর-নেই বেগ পেতে হয়েছিলো। পুরো সাড়ে তিন বছরই খেয়েছি।

আমার জিহ্বায় মায়ের দুধের সেই নোনা স্বাদ লেগে আছে এখনো। মাংসল গন্ধটাও। নেশা লেগে গিয়েছিলো সময়-অসময় নেই যখন খুশি মায়ের ওম-ভরা বুকে মুখ গুঁজে চুক চুক করে আশ মিটিয়ে খেতাম। এই জেঁকে বসা দুধাসক্তির জের আমার ভেতরে পরেও বহুদিন থেকে গিয়েছিলো, নইলে অতোটা ডেংগা হয়েও কেউ রোজ-রোজ ননী চুরি করে? তবে আমাকে কিন্তু নাড়ু গোপালের মতো অতো মার খেতে হয়নি। মা অবশ্য মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত হতেন- কখনো বিব্রতও।

না পারতে মৃদু বকুনি বা ধমক দিতেন, তবে তখনো তার গলায় মিশে থাকতো প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের অসতর্ক আভাস, ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসির ঝিলিক তার কপট রাগের জারিঝুরি থুড়ি, জারিজুরি ফাঁস করে দিত। ১৪. এতোকিছুর পরও আমার দো-টানা ভাবটা যায় না সময় সময় বেশ উন্মনা হয়ে যাই বারবার মনে পড়ে-- আমি তো আসলে শালগাছ। মানুষ নই। মানুষের খোলের ভেতর ছাল-বাকলে মোড়ানো কাষ্ঠল সত্তার অভিবাসী আত্মার ধুকপুক, পর্যটক বাসনার বিবাগী বিরিখ! কাউকে বলাও মুশকিল! হায়! আমার মা-জননী যদি জেনে ফেলে তার নাড়ি ছেঁড়া ধনের গুমর? আহারে বেচারি! আমাকে যা আদর করে না! জানলে নির্ঘাত মূর্ছা যাবে। ভাবতেই শিউরে উঠি।

এমন পুত্র-অন্তপ্রাণ মা দ্বিতীয়টি হয় না। মায়ের মায়াজালে জড়িয়ে বিস্মরণের সরোবরে কেটে গেলো আরো বছর দুয়েক... ১৫. আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। আমার দারুণ লাগলো-- আহা কি আনন্দ নবাঙ্কুর প্রাণে! ছেলে-মেয়েদের সুর করে নামতা পড়া উচ্চস্বরে শতকিয়া, ধারাপাত পাঠের কসরত চীৎকার, চেঁচামেচি, কিচির-মিচির কল-কাকলি-মুখর এক প্রাণোচ্ছল পক্ষীশালা!-- একদিন দেখলাম পড়া না পারলে শিক্ষক পড়ুয়াদের কান ধরে একপায়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। দেখে অদ্ভুত লাগলো আমার, তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে... চমৎকার! মানুষ গড়ার কারখানায় বৃক্ষ বানানোর বুনিয়াদি শিক্ষা-- নর যদি হতে চাও, তরু হও তবে! আমারো ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার লোভ হলো ওই যে! পুরানো অভ্যেস! সুযোগে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে। বাড়ি ফিরে পেট ব্যথার নাম করে পড়া না শিখেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন খুশিতে তিড়িং-বিড়িং নাচতে নাচতে সাত-সকালেই ছুটে গেলাম স্কুলে। কিন্তু, আমার উৎফুল্ল চেহারা, ভাবসাব দেখে স্যার আর পড়াই জিজ্ঞেস করলেন না। ধ্যাত্তেরি! ভাগ্যটাই মন্দ! ১৬. আরেক দিন ক্লাসে বসে নতুন বুদ্ধি বের করলাম। স্যার হাজিরা খাতা খুলে নাম ডাকছেন-- সবাই দাঁড়িয়ে হাত তুলে ‘প্রেজেন স্যার’ বলছে আর আমি উদাসীন ভাব নিয়ে বসে থাকলাম শুনেও না শোনার ভান করে। আর যাই কোথায়? আকবর মাস্টারের শ্যেন-দৃষ্টির অব্যর্থ রাডারে ধরা পড়ে গেলাম।

মানে স্যার টোপ গিললেন, পা দিলেন আমার পাতা ফাঁদে! কিন্তু এতই ঘটলো বিচ্ছিরি বিপত্তি। আমাকে ডেকে নিয়ে টেবিলের ওপাশ থেকে কান ধরে টান দিতেই আমার পা-জোড়া মাটি থেকে আলগা হয়ে গেলো পট পট করে উঠল কানের গোড়া! ভাগ্যিস পা! শেকড় হলে কানটাই ছিঁড়ে যেতো। মনে হলো দক্ষিণের ডালটি মড়াৎ করে ভেঙে পড়লো গোড়া থেকে। ধারালো নখ বসে গেলো কানে। কবোষ্ণ কষ, লাল ক্ষীর, রক্ত! আমার ছুটি... ১৭. টলতে টলতে ইতস্তত পা ফেলে কোনো রকমে বাড়ি ফিরলাম।

মা-বোনেরা কেঁদে-কেটে পাড়া মাথায় তুললো-- আশ-পাশের তো বটেই আন-পাড়া থেকেও ছুটে এলেন শুভার্থী, সমব্যথীরা; ঢুঁ মারতে এলো উৎসুক উটকো মানুষের দঙ্গল, বাড়িটা ছোটো-মোটো জঙ্গলে রূপ নিলো-- মাস্টারের নিন্দে-মন্দে রেগে-মেগে টং হলেন অনেকে। কেউ কেউ আমার জখম হওয়া কানটি নেড়ে-চেড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করলেন ঘা-টা উঁকি দেয় কিনা দেখতে। সঙ্গত সংশয়ে আড়ষ্ট। আমার কান বোঁটা আলগা হয়ে ঝরে গেছে বলে গুজবের উলঝুল ডাল-পালা ছড়িয়ে পড়লো দিগ্বিদিক অনেক তুলকালাম, হাঙ্গামা-হুজ্জত আর বিস্তর জল ঘোলা হলো... কিন্তু পরদিন সবার মুখে ছাঁই দিয়ে আমি ঠিকই স্কুলে হাজির! ১৮. সে বছর ছাত্র পেটানোর কারণে কোথায় জানি বাপ-ভাই মিলে রাগ ঝাড়তে গিয়ে একটা মাস্টারকে পিটিয়ে মেরেই ফেলেছিলো-- শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাকলেন। তিন মাস স্কুলে তালা... লাগাতার বন্ধে বন-বাদাড়ে ঘুরলাম প্রচুর কিন্তু, মনটা খারাপ হয়ে গেলো বৃক্ষের ওপর মানুষের উদাসীন অবিচার দেখে।

চারদিকে নির্বিচার বৃক্ষ হত্যার মহোৎসব আর সমানে সবুজ সংহার দেখে নিদারুণ ব্যথিত হলাম। হায়রে ধরণী! আপনা কাষ্ঠে বিরিক্ষ বৈরী! কই বৃক্ষহত্যার প্রতিবাদে তো কাউকে এতো সরব-সোচ্চার হতে দেখি না? এমনকি চারিদিকে যখন ধুমসে বৃক্ষমেধযজ্ঞ চলছে বিরান হয়ে যাচ্ছে বেশুমার বৃক্ষবসতি উজাড় হচ্ছে গাছেদের অজস্র গণ্ডগ্রাম, তখনো সবাই কেমন নির্লিপ্ত, নির্বিকার! মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ করে বৃক্ষ-নিধন, লুণ্ঠন, বৃক্ষাধিকার লঙ্ঘন কিম্বা বৃক্ষবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে কাউকে তো ফুঁসে উঠতে দেখি না? গাছেদের নিজস্ব আদালত নেই বলে? বিচার বটে! ১৯. জানি না আমার এ বৃক্ষকাতরতা কে-কিভাবে নেবে। কেউ আবার আমাকে তথাগত ভেবে বসবে না তো? আমি স্রেফ শাল, বোধিসত্ত্বের ভদ্রশাল নই। জন্ম-জন্মান্তরে অযুত যোনিভ্রমণে বুদ্ধত্ব লাভের ইচ্ছেয় মানুষ হইনি আমি। তেমন কাঙ্ক্ষর আগাছা আমার ডালে-আবড়ালে তো নয়ই ছায়ায়ও কুঁড়ি মেলেনি কখনোই।

লুম্বিনী উদ্যান নয়, ময়নামতির অরণ্যেই ছিল অদমের সবুজ অধিবাস, বৃক্ষধাম। মঙ্গলবৃক্ষ বেশে কারো পূজা-অর্চনা আমি নেইনি, আমার কাণ্ডে বেড় দিয়ে কোনো বরপ্রার্থী এসে উপবীত বাঁধেনি কোনোদিন। আমার গাছজীবন ছিল আর দশটা গাছের মতোই নিতান্ত সাদামাটা, আলাদা কোনো স্বকীয়তা ছিলো না। ২০. রবি ঠাকুরের গল্পের বলাইয়ের কথা মনে পড়ছে-- আমার ভাবতে ইচ্ছে করে আমি ও বলাই সহোদর, একই বৃক্ষমাতার বীজাণু থেকে অঙ্কুরিত হয়েছি। আমার মাও অবশ্য খুব গাছ ভালোবাসতেন গাছ পেটে ধরেছিলেন বলেই কিনা জানি না তবে গাছের প্রতি ছিলো তার প্রগাঢ় মমতা।

জগদীশ বসু পড়েছিলেন কিনা বলতে পারবো না তবে তিনি ঠিকই জানতেন গাছেরও প্রাণ আছে, ওরাও ঘুমায়। রাতে গাছের কাছে বিনীত অনুমতি প্রার্থনা ছাড়া একটি পাতাও ছুঁতে দিতেন না। মা ভিটে-বাড়ির আনাচে কানাচে খালি জায়গা পেলেই গাছ লাগাতেন আর নিয়ম করে জোগাতেন প্রাণ-রসায়ন। তার বৃক্ষলক্ষ্মী করাঙ্গুলির মায়াবী ছোঁয়া পেলে যেমন চারাই হোক শালের কোঁড়ার মতো তরতর করে বেড়ে উঠতো সবল সতেজ হয়ে, আর রূপ-লাবণ্যে অন্য গাছের ঈর্ষা কুড়াতো। ২১. মায়ের আদর, বোনদের সাথে সারাদিন খিটিমিটি, খুনসুটি, হৈ-হুল্লোড়, গোল্লাছুট আমাকে আবার গাছজীবনের কথা ভুলিয়ে রাখলো।

এরই মাঝে দেখলাম গ্রামের ছায়াতরু বর্ষীয়ান বটতলায় শীতল ছায়ার বদলে প্রখর রোদের প্রবল প্রতাপ। বারাউলিয়ার দরগার ডাল-পালা ছড়ানো বিস্তীর্ণ তেঁতুলগাছটি আর তুলাতুইল্লা মুরার সাতোয়াঁ আকাশের সাথে মিতালি পাতানো মামা-ভাগ্নে গর্জন-জোড় গাছাশী মানুষের করাল গ্রাসে কবেই বিলীন। আমার চোখ শিশিরে টলমল করে। সারা শরীর পান্থপাদপের মতো করুণ রসে টসটসে, টইটম্বুর হয়ে ওঠে। মনে হয় আমার গায়ে টোকা দিতেই ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে স্বচ্ছতোয়া অশ্রুধারা।

কিন্তু, আমার বৃক্ষজন্মের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ভয়ে নিজের ভেতর সেঁধিয়ে যাই। মনের অলিন্দে জমে ওঠা বিক্ষুব্ধ মেঘেরা চোখের চৌহদ্দি পেরিয়ে বুকের বারান্দায় নেমে আসে সদলে। ২২. কেনো জানি কারো সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারি না। ধীরে ধীরে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি নিজেকে কেমন উচক্কা উড়োমানুষ মনে হতে থাকে। একাকিত্ব ছায়ার মতো আমার পিছু নেয় আমাকে খুবলে খায়, ছোবল মারে-- একাকী বিষণ্ন নদীলতিকার মতো বয়ে চলি অজানা গন্তব্যে... ২৩. ইদানীং আয়নার সামনে দাঁড়ালে পলকেই আমার বিম্বিত চেহারাটা মুছে গিয়ে সহসা বনসাই গোছের একটি গাছের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে পুরো দৃশ্যপটজুড়ে, নানা ভঙ্গিমায় ভেংচি কেটে বিদ্রুপমাখা সুরে গান ধরে-- বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথা এক বৃক্ষ বসত করে... ভড়কে গিয়ে সামনে-পেছনে নিজের ছায়া খুঁজে বেড়াই-- ওটাও আবার গাছের সিলূয়েট হয়ে গেলো না তো! আয়না-মহলে কে বিরাজে? আমি? না বৃক্ষ? ২৪. কি করবো ভেবে পাই না-- আমার একদম দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

বুক ভরে বিমল বাতাস নিতে নির্জনে খোলা প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়াই আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে চোখ বুঁজে। শিরশিরে হাওয়ার শিহরণে আচ্ছন্ন হয়ে যাই... মনে হয়, আমার শরীর ঘিরে বল্কল জেগে উঠছে মাথার ঝাঁকড়া চুলের গোছা বদলে পাতা হয়ে কাঁপছে, হাত আর আঙুলগুলো ডাল-পালা হয়ে যাচ্ছে আর পদযুগল শেকড় হয়ে দ্রুত বিস্তৃত হয়ে পড়ছে মাটির ভেতর ঘাড়ের উপর আস্ত মাথাটি গাছের চূড়া এবং অস্থি-মজ্জা, মাংস ক্রমশ কঠিন কাঠ হয়ে যাচ্ছে... ২৫. বিপন্ন গাছেদের বোবা কান্না, অরণ্যের নিঃশব্দ রোদন আমার আর সয় না-- তাবৎ গাছগাছালির ক্রন্দন রোল এক হয়ে আমার চারপাশ ঘিরে ঘুরপাক খেতে থাকে। হাজারো প্রশ্নের সুচালো অঙ্কুশ, বিষকাঁটালি আমার হৃদয়টাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে নিরন্তর। ভেবে পাই না এমন শান্ত, নিরীহ সুহৃদের উপর কিভাবে খড়গ তুলতে পারে এরা? জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফল খেয়ে স্বর্গচ্যুত হয়েছিল বলে মানুষের মনের অহল্যা কন্দরে কোথাও কি তবে সুপ্ত আছে বৃক্ষ-বৈরিতার শুক্তো বীজ? ২৬. অচেতনে আমার কেমন জানি ভয়ভয় লাগে-- মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে বৃক্ষহন্তার দল এসে আমাকে করাত দিয়ে কাটবে, কুড়োল দিয়ে চিরে ফেলবে গাছের গুঁড়ির মতো গড়াতে গড়াতে নিয়ে যাবে স’ মিলে, করাতকলে, তুলে দেবে ভারায়, ইটের ভাটায়... আতঙ্কে আমার কলিজা পানি হয়ে যায়, কোত্থেকে জানি স’ মিলের বিদঘুটে আওয়াজ ভেসে আসে সর্বক্ষণ, কান ফেটে যেতে চায়-- অমূলক বিভ্রাট-বিভ্রমে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। ২৭. তবে এসব কথা আমি ঘুর্ণাক্ষরেও কাউকে বলি না, এমনকি আমার বাবা, বোনদেরও না।

আমার এ দোলাচল, অন্তর্দাহ একান্তই আমার কাউকে এর শামিল করার সুযোগ নেই। কারো কাছে বলে বুকের বোঝাটা হালকা করতে পারলে খানিকটা স্বস্তি পেতাম। শশব্যস্ত জীবনে কার কথায় কে মন দেবে? মনের দুঃখে বনে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গাছগাছালির কাছে মুখ দেখাই কি করে? ওরা যদি আমাকে বৃক্ষ-বিদ্বেষী বাউণ্ডুলে বিগাছা বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়? একটি উন্মূল চলন্ত গাছকে বিশ্বাস করবে কেনো? আস্থায় নেয়ারই বা দরকার কি? ওরা যে এতোদিনে আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা দিয়ে বসেনি তা-ইবা বলি কি করে? আপন ভাবা তো দূরের কথা! না, গাছেদের দ্বারস্থ হয়ে কোনো ফল-ফুল হবে না। ২৮. আচ্ছা, বাবা যদি জানেন? তাকে কি বলা যায়? তিনি মাঝে মধ্যে বেকায়দা রেগে গেলে আমাকে গাছ-বাঁশের পয়দায়েস বলে গাল-মন্দ করতেন।

তিনি কি হতবিহ্বল হয়ে পড়বেন শেষমেশ তার বেফাঁস কথাটাই সত্য হলো বলে? নাকি আল্লা-খোদার কাছে ফরিয়াদ, কাকুতি-মিনিতি আর দরগায়-মসজিদে শিন্নি-মানতে পাওয়া সবেধন নীলমণি একমাত্র পুত্র-সন্তানটিও হারালেন বলে তার মাথায় আকাশপাত হবে? হায় আল্লাহ! বলে কপালে হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়বেন দাওয়ায়? নাকি বজ্রাহত স্থানু হয়ে যাবেন চিরতরে? ২৯. আমার সহোদরা বোনেরা? ওরা যদি জানে তাদের আদরের ছোট ভাইটি আসলে একটি ছদ্মবেশী শালগাছ, তাহলে? তারা কি আমাকে কেটে-চিরে তক্তা বানাতে চাইবে? অলংকৃত দুর্লভ আসবাবে ঘর-গেরস্থালির সাজসজ্জা আর শখের ড্রয়িং রুমের শোভা বাড়াতে আমার কর্তিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খোদাই করে বিচিত্র লতা-পাতা, ফল-ফুলের সুচারু নকশায় ফুটিয়ে তুলবে নিপুণ শৈলীর নান্দনিক দারুকলা? নাকি ভাইয়ের অভাব মেটাতে আমার শরীর থেকে কলম বানিয়ে পুকুরের কিনারায় পুঁতে দিয়ে নিবিড় পরিচর্যায় পরীক্ষা করে দেখতে চাইবে এরকম আরো গাছভাই জন্মানো যায় কিনা উঠোনের ধারে কিম্বা বারান্দার টবে? ৩০. ভাগ্নে-ভাগ্নিরা? সাত কান ঘুরে কথাটা তো ওদের কাছেও পৌঁছে যেতে পারে! ওরা কি তখন আমার গা বেয়ে কাঁধে-পিঠে চড়ে শাখামৃগের মতো দৌঁড়-ঝাঁপ শুরু করে দেবে? আমার ডালে দোলনা ঝুলিয়ে দোল খাবে? (সেই শৈশবে নানার দেয়া কাঠের দোলনাটায় মা যখন ঘুম-পাড়ানি গান শুনিয়ে আমাকে দুলাতেন তখন নিজেকে আমার ক্ষণিকের উড়ালবৃক্ষ মনে হতো বৈকি!) ওরা আমাকে আগের মতোই মামা ডাকবে তো? ডাকলে কি নামে ডাকবে? গাছমামা? না শালমামা? বৃক্ষ, বিটপী বা অটবিমামা ডাক শুনতে হবে? আমাকে দেখলেই আনন্দে ছড়া কাটবে-- আয় আয় গাছমামা, ফল দিয়ে যা? নাকি নাই মামার চেয়ে গাছ মামাই ভালো বলে মনকে সান্ত্বনা দেবে ওরা? বলবে, মামা তোর নাম কি? -আদরেই পরিচয়! ৩১. আমার সুশীল বন্ধুরা কি করবে? এমন বিরল ঘটনায় কৌতুহলী হয়ে উঠবে তারা? নাকি কৌতুক বোধ করবে? একটা চমৎকার ঠাট্টার বিষয় পাওয়া গেলো বলে ইউরেকা! ইউরেকা! বলে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠবে সমস্বরে? ওদের মজ্জায় মিশে যাওয়া নাগরিক সন্দেহের তীর শাঁই করে ধেয়ে আসবে আমার দিকেও! আরএনএ’র অস্তিত্ব প্রমাণে আমার দেহের নমুনা নিয়ে পাঠাতে চাইবে ভিনদেশী পরীক্ষাগারে? নাকি কেউ বিজ্ঞানের বিস্ময় কেউবা অসম্ভব বলে জড়িয়ে পড়বে তুমুল বিতর্কে? বিভক্ত হয়ে পড়বে দু’শিবিরে? নাকি একটি বিচরণশীল বৃক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা নিজেদের বৃক্ষপ্রেমের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে জাহির করতে চট জলদি খবরটা ফলাও করে চারিদিকে চাউর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে? ৩২. আচ্ছা, আমি এসব ছাঁইপাশ ভাবছি কেনো? আমিতো গাছই। শালগাছ। কি জানি! এতোদিন মানুষের সাথে থাকতে থাকতে সঙ্গদোষে হয়তো আমি মানুষই হয়ে গেছি! গাছমানুষ বা মানুষগাছ কোনটা বলা যায়? নাকি নরকল্পতরু? না তরুকল্পনর? হয়তো বা দুটোই। নাকি কোনোটাই না!? মানুষ আর গাছের সঙ্কর ‘নৃক্ষ’ বললে খুব একটা ভুল হবে? না, না! তারচে’ গৃহপালিত উড়নচণ্ডী তরুপ্রবরই মানাবে ভালো! ৩৩. মাঝে মাঝে ভাবি আগে আমার শরীরে ছিলো ক্লোরোফিল, সেটা এখন হিমোগ্লোবিন হয়ে গেছে। তেমন তফাত কি? সবুজ আর লাল বাহিরে কেবল, ভিতরে সবার রংধনু প্রাণ! আবার ভাবি-- মিছেমিছি মানুষ হতে চেয়েছিলাম কেনো? অভিশপ্ত উলট গাছের কথা ভুলে বসেছিলাম কোন দুঃখে? কেনো বেমালুম বিস্মৃত হয়েছিলাম দুরন্ত ছেলে-মেয়েদের ডিগবাজি খেতে দেখে পুলকিত হওয়া নিশ্চল অবলা গাছেদের মোটেই সাজে না? ৩৪. আমার তো এতোটা অপরিণামদর্শী হওয়ার কথ ছিল না? তবে কি আমার বৃক্ষশরীরে একটা মানুষ্যমন ছিলো? আবার ভাবি, মানুষ হয়েছি তো কি হয়েছে? তাই বলে গাছের খাতা থেকে আমার নাম কাটা গেছে নাকি? তাছাড়া মানুষের শরীরও তো অসংখ্য জীবাণুর অভয়াশ্রম! কোথায় যেনো পড়েছিলাম জীবন মানে বিচিত্র প্রাণের বর্ণিল উৎসব-- প্রাণেপ্রাণে বাঁধা অদৃশ্য সেতু, পারাপারের চিরায়ত পার্বণ।

৩৫. যাক, সেসব কথা। গাছমাত্রই তো ভুল, তাই না? বলছিলাম কি, শুলে বা বসলে আমার ফেলে আসা শরীরটার কথা মনে পড়ে যায়। বুকের ঝোঁপে-ঝাঁড়ে একটা ভুতুম পেঁচা ডেকে ওঠে অশুভ শঙ্কার ঝড় ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় মনভূমির শ্যামল সৌকর্য। আমি দাঁড়িয়ে যাই দাঁড়িয়ে যাই সজ্ঞানে-অজ্ঞানে-নির্জ্ঞানে। যদ্যপি আনমনা থাকি, ভুলে যাই গাছস্য পরিবেদনা, তাতে কি? তখনো মনের মনে থাকে ঠিকই! সটান ঋজুতায় ফোটাতে চাই বৃক্ষজন্মের সুখদ স্মৃতি।

৩৬. অনুশোচনা হয় আমি একটা সপ্রাণ জীবন ছেড়ে এসেছি বলে। আমার ডাল-পালা, পত্র-পল্লব জুড়ে ছিলো পাখ-পাখালির কলরব, কোলাহল কতো কীট-পতঙ্গ, পোকা-মাকড় ঝিঁঝিঁর ঝঙ্কার, ভ্রমরের গুঞ্জণ কাঠবিড়ালীর চাঞ্চল্য প্রজাপতির উড়াউড়ি পাখির বাসা, ডিম, ছানা-পোনা সাপের নিঃশব্দ চলা। আলোর নাচন, ছায়ার সোহাগ, আলোছায়ার লুকোচুরি, জ্যোৎস্নার কেলি, আরো কতো কি। সব ছেড়ে শুধু চরাচরে চরে বেড়ানোর লোভে মানুষ হয়ে আমি অযথা চরৈবেতি বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম। ৩৭. আমি আবার সত্যি সত্যি গাছ হয়ে যেতে চাই নির্লোভ নির্মোহ নিঃস্বার্থ গাছ; নিরালম্ব নরকল্পদ্রুম নয়, শুদ্ধাচারী মহীরুহ।

গরল যবক্ষারজান পরিপাক করে অম্লজান বিলিয়ে আকাশ অম্লান করাই হবে আমার অবিচল ব্রত, পরম বৃক্ষধর্ম। কোনো বেয়াড়া বাসনার শতদল দল মেলবে না আমার সবুজ মনের অবুঝ শাখায়। শালবনে ফেলে আসা আমার ছলম, সেই শালগাছটার জন্য মনে বেদনা উথলে ওঠে। কিন্তু মায়ের অপত্য আদর-স্নেহ আমাকে আবার সবকিছু বিলকুল ভুলিয়ে রাখে। ভাসমান শৈবালের মতো সময়ের গড্ডালিকায় ভেসে ভেসে আমি স্কুল পেরিয়ে কলেজ, ভার্সিটি... ৩৮. মায়ের খুব অসুখ হলো: ঘুণপোকা তার বাকলটা ছাড়া পুরোটাই খেয়ে ফেলেছিল।

আমি শহরে। ১৯ এপ্রিল ১৯৯১। ২৬ রমজান, আল-বিদা জুমা, শবে কদর। খবর পেয়ে ছুটে পৌঁছার আগেই রোজাদার মুসল্লি-মুরব্বিদের হাঁসফাঁস মোল্লা-মৌলবী-মিয়াজীদের পীড়াপীড়িতে দারোগা মসজিদের কবরস্থানে দাফন শেষ, নানা-জানের কবরের পাশে। শোকাহত সঙ্গীহারা বাবা গলিত পাথর।

কাঁদলাম জবাই করা পশুর মতো গর গর আওয়াজ করে। নিষ্ফল। ৩৯. আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে কাহিল; চোখের জলের ঘূর্ণিপাকে তলিয়ে যেতে যেতে দেখি, কবরের মাটি ফুঁড়ে মা বাঁশের পরুলের মতো গজিয়ে উঠেছেন। ভোঁ দৌড়ে হুমড়ি খাই মায়ের কবরপাড়ে-- চারদিক বাঁশের বেড়ায় ঘেরা, চার কোণে চারটে খেজুরের বাইল পাতা বিজখানে বুকের উপর এরেণ্ডার একটি ঝাঁকড়া ডাল পুঁতে দেয়া। দৃশ্যপট মুছে যায় কুহক কুয়াশায় মেঘের ভেলায় নভোতরু আমি ভেসে ভেসে উড়ে চলি আটারো ভাটির দেশে।

রূপবান বাদাবন মোহনায় বনবিবির উদ্ভাসে উজালা মনমহলে বাক্সময় মায়াবী সবুজের উদ্বেল সিম্ফনি-- দুঃখী! বাচা আমার! ভাবিস না। দেখিস, কফিনের মার্কিন থান মাকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারবে না। মাটির মমতায় ঠিক ঠিক অঙ্কুরিত হয়ে উঠে আসবেন কবরের কবাট ঠেলে। ওই তো জলপাই-কিশলয় ঠোঁটে নূহের পায়রা... না, আমি কিছুতেই এখান থেকে যাবো না আবার বুক-ফাটা কান্না, ধড়ফড়, গড়াগড়ি... ৪০. ক’দিন পর এলো সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল। লাখ লাখ মানুষের সাথে অসংখ্য বৃক্ষের মৃত্যু আমাকে আবার অনিবার্যভাবে বৃক্ষ-জন্মের, জীবনের কথা মনে করিয়ে দিলো।

হায় বৃক্ষ! আজ কোথায় তুমি আর কোথায় তোমার শেকড়! অবশেষে নাড়ির টানে একদিন সোজা লালমাই পাহাড়ে, শালবনে গিয়ে হাজির হলাম। দেখি কি! আমার আবাস, সেই শাল-- যাকে আমি অবহেলায় ছেড়ে এসেছিলাম-- মর্মান্তিকভাবে শেকড়-বাকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়ে আছে। সবুজ পিরহান নেই, আছে শুধু নিরাবরণ কঙ্কাল। আর করাত, কুঠার নিয়ে কিছু কসাই-জল্লাদ... নাহ্, আর বলতে পারছি না। হায়! শ্যামাঙ্গী জননী আমার! আজ তুইও নেই আমারও আর বৃক্ষ-জীবনে ফিরে যাবার উপায় রইল না... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।