অনিকেত নতুন আসা ইংরেজী বইয়ের খোঁজে প্রতি মাসে একবার নীলক্ষেত ঢু মারেন। পেশায় তিনি টিভি নাট্যকার। লেখালেখির প্রয়োজনে তো বটেই এমনিতেও ভীষণ বই-পোকা তিনি। তার ওপর নয় বছর আমেরিকায় পড়াশোনা করার সুবাদে ইংরেজী বই-ই বেশি পড়েন। আগে ইংরেজী গল্প, উপন্যাসের বই কিনতে এটসেটরাতে নিয়মিত যেতেন।
চড়া দাম দিয়ে অরিজিনাল বই কিনতেন। কিন্তু এক সময় আবিষ্কার করেন নীলক্ষেতে সাম্প্রতিক সময়ের প্রায় সব ইংরেজী বই-ই মেলে এবং তা খুব স্বল্প দামে। তফাৎটা ধরে ফেলেন অনিকেত। নীলক্ষেতেরগুলো পাইরেটেড কপি। এগুলোর ছাপা, কাগজ, বাইণ্ডিং-সবই নিম্নমানের।
তবে এখন এসব বই-ই কেনেন তিনি। কারণ অনিজিনাল কপি কিনতে যে দাম পড়ে সেই দামে নীলক্ষেত থেকে পাঁচটি বই কেনা যায়।
হ্যাঁ, ঢাকার নীলক্ষেত হচ্ছে এখন পাইরেটেড বইয়ের স্বর্গ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী হেন বই নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। লণ্ডন, আমেরিকাসহ বিশ্বের সমসাময়িক জনপ্রিয় লেখকদের বইও মেলে এখানে।
এ আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে
এক কথায়, বাংলাদেশে যেসব ইংরেজী বইয়ের ব্যাপক চাহিদা যেসব বইয়েরই পাইরেসি হচ্ছে। গল্প, উপন্যাস ছাড়াও এ তালিকায় আছে বিভিন্ন অভিধান; যার মধ্যে অক্সফোর্ড এক নম্বরে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বই, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অসংখ্য বই, সহায়ক নোটবই, ইংরেজী লেখার বিভিন্ন ধরনের বই ও অন্যান্য।
এবার আসা যাক বাংলা বই পাইরেসির প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে কলকাতার লেখকদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।
ওপার বাংলার বইয়ের একটি বিশাল পাঠকশ্রেণী রয়েছে এখানে। বইয়ের গায়ের মূল্য ক্রয়সীমার মধ্যে হলেও বাংলাদেশে প্রবেশের পর ট্যাক্সের কারণে সেই বইয়ের দাম অর্ধেকেরও বেশি বেড়ে যায়। আর স্বভাবতই পাঠকের ক্রয়ক্ষমতা চলে যায় সাধ্যের বাইরে। এ সুযোগটা কাজে লাগায় একটা শ্রেণী। অনুমতি না নিয়ে অবৈধভাবে সেসব বই ছাপিয়ে অত্যন্ত কম মূল্যে বাজারজাত করে।
আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন বইয়ের লেখক।
পেছনের কারণ
বিদেশী বইয়ের ওপর অত্যাধিক ট্যাক্স আরোপের কারণেই বাংলাদেশের লোকাল মার্কেটগুলো পাইরেটেড বইয়ে ভরে গেছে, জানালেন পাঞ্জেরি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান শায়ক। ফলে, আমদানিকৃত বইয়ের দাম স্বভাবতই অনেক বেশি হয়। আর এ কারণে আমদানিকারকদের একটি বড় অংশ এখন বই পাইরেসির দিকে ঝুঁকেছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, এখন প্রযুক্তি এত উন্নত যে, অবৈধ বই পাইরেসিকারকরা বেস্ট সেলিং বইগুলো রাতারাতি ছাপিয়ে বাজারে এনে ফেলছে।
এসব বই কেবল ফুটপাতেই নয়, বড় বড় নাদী-দামি বইয়ের দোকানেও সরবরাহ করা হয়। পাঠকরাও কম মূল্যে কিনতে পারছে বলে খুশি। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, তিন বছর আগেও বছরে ২৫ থেকে ২৬ কোটি টাকার বই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। অথচ ২০০৩-০৪ অর্থবছরে আমদানি নেমে এসেছে ১৩ কোটি টাকায় এবং ২০০৪-০৫ অর্থবছরে সেটা নেমে এসেছে মাত্র ৮ কোটিতে। নিউমার্কেটে ‘বুক ভিউ’ দোকানের মালিক সাদাত ফারুক, যিনি নিজেও একজন বিদেশী বইয়ের আমদানিকারক, গভীর হতাশার সঙ্গে জানালেন, আমরা বাইরে থেকে বই আনার কয়েকদিনের মধ্যেই সেসবের পাইরেসি কপি বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়।
এসব কারণে নিউমার্কেটের তিনটি বিদেশী বইয়ের দোকান বইয়ের ব্যবসা বাদ দিয়ে গিফট ও কার্ডের ব্যবসা শুরু করেছে।
কে কী বলেন
বই পাইরেসি সম্বন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্টাডিজের ছাত্র অর্ণব বললেন, বিষয়টা অনৈতিক হলেও এক কথায় ভালো। কারণ বাইরের অনেক দামি দামি বই আমরা খুব সস্তায় কিনতে পারছি। তরুণ কবি ফেরদৌস মাহমুদের মতে, কলকাতার বইয়ের পাইরেসিকে সমর্থন করা উচিত। কারণ ওরা আমাদের দেশের বইকে সেখানের বাজারে প্রবেশ করতে দেয় না।
আর বড় কথা হচ্ছে, বেশি দামের চেয়ে কম দামে যদি পাঠক বই পায় তো খারাপ কী? বই পাইরেসির বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর ছাত্রী সালিমা। বললেন, এটাকে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। একে তো বিষয়টা অবৈধ, সরকার এ থেকে রাজস্ব হারাচ্ছে এবং বড় কথা হচ্ছে, বইয়ের লেখক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পাইরেসির বিরুদ্ধে অভিনব পদ্ধতি
ইংরেজী সাহিত্যের বই ও সহায়ক গ্রন্থের জন্য দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নীলক্ষেতের উপর নির্ভরশীল। ছাত্রদের প্রয়োজনীয় বই সবই এখানে মেলে।
সম্প্রতি তারা ইংরেজী সাহিত্যের বই পাইরেসির বিরুদ্ধে এক অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। ধ্রুপদী ইংরেজী সাহিত্যের বইগুলোর তারা নিজেরাই ভূমিকাসহ প্রকাশ করছে। পেঙ্গুইন, নরটনসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর ক্লাসিকাল বইগুলো আগে অন্যরা তো বটেই তারা নিজেরাও পাইরেসি করে বিক্রি করতো। কিন্তু লেখকের মৃত্যুর ৫০ বছর পর যেহেতু বই ছাপানোর কোনো বিধিনিষেধ থাকে না তাই কেউ কেউ সেসব বই এখন নিজেদের প্রকাশনী থেকে ছাপিয়ে বাজারজাত করছে। আর পাঠকরাও কম মূল্যে কিনতে পারছে।
এ ধরনের আরেকটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে নোট বইয়ের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে ইংরেজী সাহিত্যের ওপর ভারতীয় যেসব লেখকের নোট বই বেশি চলে তাদের প্রকাশনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট রয়ালটি ও অনুমতির মাধ্যমে বাংলাদেশের এজেন্ট হয়ে তারা ওসব নিজেরা ছেপে বিক্রি করছে। এতে সাপও মরলো না, লাঠিও ভাঙল না- বললেন, ফ্রেণ্ডস বুক কর্নারের কর্মকর্তা সোহেল হাসান। তিনি বলেন, আমাদের এ কার্যক্রমে বই পাইরেসিও হলো না, আবার বইয়ের দামও পাঠকের হাতের নাগালের মধ্যে থাকে। মনে হয়, এ পদ্ধতি অন্যান্য বিদেশী বইয়ের আমদানিকারক যারা তারা ভেবে দেখতে পারেন।
এছাড়া পাইরেসি ঠেকানোর আর কোনো সহজ উপায় আছে বলে আমার জানা নেই। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।