ভোরের তারা হয়ে একাকি পথ খুজি
প্রথম পর্ব Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব Click This Link
তৃতীয় পর্ব Click This Link
চতুর্থ ও শেষ পর্ব
ছয় মাস বন্দী থাকার পর অবশেষে আদিল হার মানল, বিয়ে করল বাবা মায়ের পছন্দ করা পাত্রী নীপাকে। বন্দী জীবন থেকে মুক্তি মিলল তার। নীপা সমভ্রান্ত পরিবারের ধার্মিক, পর্দানশীল,সুশ্রি এবং লাজুক টাইপের মেয়ে, ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছে। নীপা আদিলের অতীত ইতিহাস কিছুই জানে না। বরঞ্চ বলা যায় নীপার পরিবার আদিলের পরিবারের সামাজিক মর্যাদা দেখে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে।
আদিল ওদিকে বন্ধুদের মাধ্যমে খবর পেল সুমাইয়া এই বিয়ের খবর জেনেছে এবং মানসিক ভাবে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। সে এখন আদিলকে প্রতারক মনে করে। এর কিছুদিন পরে সুমাইয়া অস্ট্রেলিয়া চলে গেল মাস্টার্স করতে। এখনও সে অস্ট্রেলিয়াতেই থাকে, বিয়ের পিড়িতে বসা হয়নি আজও।
আদিলের সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।
নতুন বউয়ের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। চিন্তা করার সেই বোধ তখন তার নেই যে, এই মেয়েটাতো নিষ্পাপ, এরতো কোন অপরাধ নেই। সারা দিন বাইরে বাইরে ঘুরে। রোদে পুড়ে শরীর ঘন তামাটে বর্ন ধারন করেছে। ইচ্ছে করে তার সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
বুকের ভিতর জমে থাকা প্রবল জ্বালা যন্ত্রনা গুলো আগ্নেয়গিরির লাভার মত বেরিয়ে আসতে চায়। সে ভেবে পায় না কি এমন অপরাধ সে করেছে। একজনকে শুধু ভালবেসে বিয়ে করতে চেয়েছে, এতটুকুইতো। তার নিজের জীবন গড়ার অধিকার কি তার নাই? সে প্রশ্ন করে বিশ্ব বিধাতার কাছে। কেন বাবা মা এমন করল?
কবে যে আদিল বাবা মায়ের কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে এসেছে তারা কেউই টের পায়নি।
সবার অজান্তে কখন যে সে নিজের আলাদা পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখছিল সে খোজও কেউ রাখেনি। তবে কি বাবা মায়ের প্রফেশনাল জীবনের ব্যস্ততাই এর জন্য দায়ী? কিন্তু তা কেন হবে? আরোওতো অনেকের বাবা মাই পেশাগত ব্যস্ত জীবন যাপন করে। এটাকে দূর্ভাগ্য বলে মেনে নেয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে! তারা তিনজনই যার যার অবস্হান থেকে নিজেকে সঠিক মনে করে। তাদের ভালবাসার বন্ধন যে কিছুটা নাটাই থেকে ছাড়া পাওয়া ঘুড়ির মত দূরে চলে গেছে তা বুঝতে বেশ দেরী হয়ে গেল।
আদিল এখন বেপরোয়া, সে প্রচন্ড আবেগপ্রবন, জেদী আর প্রখর আত্মসম্মান সম্পন্ন মানুষ।
সে কিছুতেই তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোকে মেনে নিতে পারছে না। যাকে মনের ভালবাসার সিংহাসনে বসিয়েছিল তাকে ছাড়া আর কাউকে সে ঐ জায়গায় বসাতে পারবে না। জীবনের প্রথম ভালবাসার সবটুকু সে তাকেই দিয়েছে, অবশিষ্ট নেই আর কিছু। আজ তাই তার ভালবাসার ভান্ডার শূন্য। অন্য দিকে সুমাইয়াও তাকে প্রতারক ভেবে ভূল বুঝে আছে।
সেই কষ্টও সে মেনে নিতে পারছে না। ফোনে কথা বলল সুমাইয়ার সাথে, ভুল ভাঙল তার, অভিমানের বরফ গললো। এখন আর আদিলের প্রতি কোন অভিযোগ নেই ওর। কিন্তু যা ঘটে গেছে তা আর ফিরিয়ে নেয়া যাবে না।
উদভ্রান্তের মত দিন কাটতে থাকে আদিলের।
বন্ধুদের মাধ্যমে যোগাড় করল রিভলবার। না সে কারো কোন ক্ষতি করে না, বুকের জ্বালাটা যখন অন্তরটাকে বেশী রকম কামড়ে ধরে তখন শুধু শূন্যে ফাকা গুলি ছোড়ে। সে জানে নিজেকে নিজে কষ্ট দিলে, সেই কষ্ট তার বাবা মায়ের গায়েও লাগবে। তাই একদিন মায়ের ড্রয়ার থেকে সবার অলক্ষ্যে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ নিয়ে শরীরে পুশ করল ডেটল। যা হবার তাই হল।
ক্ষতিকর ক্যামিকেলের প্রভাবে সারা শরীরে প্রচন্ড জ্বলুনি শরু হল, সেই সাথে শরীর ফুলে ঢোল। যন্ত্রনায় আদিল চিৎকার করে উঠল। টেবিলে পড়ে থাকা ব্যবহৃত সিরিঞ্জ দেখে মা সব বুঝতে পারলেন। তাড়াতাড়ি কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়ালেন। মাস তিনেক লাগল শরীর স্বাভাবিক হতে।
খাওয়া দাওয়া একরকম ছেড়েই দিয়েছে আদিল। কিচ্ছু যে তার ভাল লাগে না। সারাদিন খালি পেটে একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে চলেছে আর সেই সাথে চলে চা। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। ফলে চোখ আশ্রয় নিয়েছে কোটরে, শরীর হয়েছে জীবন্ত কঙ্কাল।
এরই মধ্যে ঢাকাতে একটা প্রাইভেট সফটওয়্যার ফার্মে যোগ দিল। সবার পিড়াপিড়িতে বউকে সাথে নিতে হল। দুই রুমের নতুন বাসা নিল ঢাকার পান্হপথে। বাবা মা চিন্তা করলেন কাজের মধ্যে থাকলে সব ভুলে যাবে। এর কিছুদিন পর নতুন এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সুযোগ মিলে যায়, বেতন তেমন একটা বেশী না, কিন্তু এমন প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পারাটাও একটা ব্যাপার।
রাত দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে নীভৃতচারী, মুখচোরা আদিল সেখানেই অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছে। এ যেন নিজেকে অত্যাচার করার আরেক উপায়।
ততদিনে নীপা সুমাইয়ার কথা সব জেনে গেছে। স্বাভাবিক ভাবে এইসব কথা জানার পর সেও কষ্ট পেয়েছে। কুচি কুচি করে ছিড়েছে আদিলের কাছে থাকা সুমাইয়ার সব ছবি গুলো।
তার প্রতি আদিলের অবহেলা তাকেও আদিলের প্রতি উদাসিন করে তোলে। প্রকৃতির নিয়ম মেনে আদিল ছেলে সন্তানের বাবা হয়। এখন ছেলেকে নিয়েই নীপার দিন কাটে। আদিলের উদভ্রান্ত জীবনের খুব একটা পরিবর্তন হয় না। মাঝে মাঝে কদাচিৎ ই-মেইলে সুমাইয়ার সাথে যোগাযোগ হয়।
কখনও খুব মন চাইলে ফোনে কথা হয়।
নিজেকে কিছুতেই শান্তি দিতে পারছে না আদিল। তখনই পরিচয় হল কিছু দরিদ্র মেধাবী ছাত্র ছাত্রীর সাথে, অর্থের অভাবে যাদের পড়াশোনা বন্ধ হবার উপক্রম। আদিল ঠিক করল এদের সে সাহায্য করবে। এই পর্যন্ত পনেরো থেকে বিশ জনকে সে সাহায্য করেছে।
এদের মধ্যে কয়েক জন ঢাকা ইউনিভার্সিটির, কয়েক জন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি সহ বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। বেশ কয়েক জন আবার চাকরি জীবনেও প্রবেশ করেছে। এদের অনেকের চাকরি পাবার বিষয়ে আদিলের বিরাট ভূমিকা আছে। এই অসহায় মুখ গুলোতে হাসি ফোটাতে পারলে আদিলের মন অন্য রকম এক আত্মতৃপ্তিতে ভরে যায়। এই অর্থের যোগান দিতে যদিও তার কষ্ট হয় তবুও এই অনাবিল শান্তির প্রত্যাশায় সে পরিশ্রম করে যায়।
এই কারনে নিজের সংসার চলাতেও অনেক সময় তাকে হিমসিম খেতে হয়। গুলশানে, ওর বাবার চার কাঠা জমির উপর নির্মিত তিনটি দোকান থেকে আসা আয় সাধারনত সে এই কাজে ব্যায় করে।
অন্যমনস্ক ভাবে হোন্ডা চালাতে গিয়ে এর আগেও কয়েক বার সে এ্যাকসিডেন্ট করেছে। কিন্তু এবারের এ্যাকসিডেন্টটা মারাত্মক। অপারেশনের পর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জীবনটাকে নিয়ে এবার ভেবেছে ,অনেক অত্যাচার হয়েছে নিজের উপর, এবার থেকে শরীরের যত্ন নিতে হবে।
আদিলের ভিতর লুকিয়ে থাকা বাবাটা জেগে উঠে, ছেলে তার বড় হচ্ছে, আড়াই বছর বয়স হল। ওর জীবনটা সুন্দর ভাবে গড়িয়ে দিতে হবে। মনে মনে ভাবে সে ছাড়া তার ছেলেটার আর কেইবা আছে। এবার বাড়ী ফিরে ছেলেটাকে সে অনেক সময় দিবে, নতুন করে আবার জীবনটাকে শুরু করবে।
সমাপ্ত............
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।