বিদায় - পথের নয়, পথিকের...
এক. শঙ্খাবৃত হুহু বেতার
শঙ্খটা এক কানে ঠেকিয়ে বসে আছে আদ্রিত, কেবল একটা মিষ্টি হুহু শব্দ কোন বিরতি ছাড়াই শুনতে পাওয়া যায়, হু হু হু হু... বেশ লাগছে ওর, গত দু'দিন ধরে ক্লান্তিহীন ভাবে এই হুহু নিয়েই পড়ে আছে সে। শঙ্খটা তাকে দিয়েছে অর্পা, প্রথমে এটা হাতে নিয়ে আদ্রিত অবাক হয়েছিল, কি করবে সে এটা দিয়ে? অর্পা তখন শঙ্খটা ওর কানে বসিয়ে দিলো, প্রথমে সে খেয়াল করেনি তারপর যখন হুহু শুনতে পেল, কেমন যেন একটা "এই আছি,এই নেই" অনুভূতি পেয়ে বসল ওকে।
এই পাঁচ তলার ছাদটি শহরের বিদঘুটে কোলাহলে বন্দী। গাড়ির প্যাঁ প্যাঁ, ইঞ্জিনের শব্দ সব কিছুই যেন ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে এখানে, ছাদের কার্নিশে পা দুলিয়ে বসে পুরোটা শহর ফ্রেমে বন্দী করে কানে শঙ্খ নিয়ে বসে থাকে আদ্রিত। আরেকটি শঙ্খ থাকলে বেশ হতো! সব কোলাহল হুহুর মাঝে হারিয়ে যেতো।
আদ্রিত আবিস্কার করেছে এই একটি হুহু ক্ষনে ক্ষনে রুপ বদলায়, শব্দের রুপ নয় আদ্রিতের মনে যে হুহু প্রতিধ্বনি তোলে তার রুপ, ভোরের কুয়াশা মাখা হুহু, দুপুরের উন্মত্ত রোদের হুহু, বিকেল পার হয়ে গোধূলি রঙের হুহু আর রাতের তারা গোনা হুহু, এক শব্দের মাঝের এই অনেক গুলো অনুভূতিকে বন্দী করে রাখা যায় শঙ্খের মাঝে। এর নাম দিয়েছে সে "হু হু বেতার"
চিলেকোঠার যে ঘরে আদ্রিত থাকে সেখানের জানালায় কোন পর্দা নেই, তাই ভোর পার হয়ে সকাল হতেই সূর্য্যের ঘুম ভাঙানো রোদ ওর জানালা চুইয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে, ঘুমটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, তখন বিছানায় আলস্য-গড়াগড়ি ছাড়া কিছুই করার থাকে না। না পেরে শেষে উঠে পরতে হয়। নিত্য-নৈমিত্তিকতার মাঝে যোগ হয়েছে হুহু বেতার। প্রতিদিন কিছু নির্দিষ্ট সময় মেপে হুহু বেতার শোনে আদ্রিত, সেই কার্নিশে পা দুলিয়ে বসে পড়ে মেপে দেখে আগের দিনের আর আজকের হুহুর অনুভূতির রঙ বদল কতটুকু! প্রতিদিন এটি নতুন অনুভূতি দেয়! আজব একটি বেতার কেন্দ্র!
দুই. হুহু মোহ
~ অর্পা তুমি ওটা কোথায় পেলে?
** কি, কোথায় পেলাম?
~ হুহু বেতার।
** হুহু বেতার! এই জিনিশটা কি?
~ উপস! মানে শঙ্খটা কোথায় পাইছো?
** একটা গাছে ঝুলেছিল পরে ওখান থেকে পেড়ে নিয়া আসছি! গাধা কোথাকার, কিছুদিন আগে না ট্যুরে গেলাম? কেন বলোতো?
~ হুমম, শঙ্খ গাছটা চিনাই দিবা, আমার আরেকটা শঙ্খ লাগবে। একটায় স্টেরিও সাউন্ড আসে না! মনো মনো লাগে, অসম্পূর্ণ মনে হয়।
** মানে কি!
~ তুমি এইটা কানে নিয়ে বসে থাকছো অনেকক্ষন কখনো? অনেকক্ষন এক কানে নিয়ে বসে থাকলে, বাকী কানটা আরেকটা শঙ্খের প্রয়োজন অনুভব করে, এই জন্য আরেকটা লাগবে!
** হুমম! বুঝছি শঙ্খ উপাখ্যান কি শ্যাষ করা যায় না?
( অর্পা কৌতুকের দৃষ্টিতে আদ্রিতের দিকে তাকিয়ে রইল)
~ যায় তো! কিন্তু আমার যে আরেকটা লাগবেই, তুমি বুঝতেছ না। বুঝলে, বুঝতা ব্যাপারটা আসলে কি। চলো হাটি...হাটবা?
** আমার হাত ধরে হাটতে হবে!
~ (আদ্রিত হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো!)
"হুহু বেতার" এর ব্যাপারটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না, এই যেমন এখন অর্পার হাত ধরে হাঁটছে, তবু আদ্রিতের মনে হচ্ছে, কানে হুহু শব্দ হয়েই যাচ্ছে।
এই ফাঁকা হুহু ভাল লাগছে না, মনে হচ্ছে শঙ্খটার হুহু তার এখন খুব দরকার, খুব বেশি দরকার..
তিন. রোদ স্বীকৃতি
গরমের দুপুরে চিলেকোঠার ঘরটিতে প্রচন্ড গরম পড়ে, অস্থির লাগে খুব! তার উপর বৈদ্যুতিক নাশকতা, মানে লোডশেডিং। জানালাগুলো দিয়ে একটা নিরানন্দ বাতাস আসছে, ঘরে ঢুকে সব কিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আদ্রিত যেটা করছে তা হলো একটা ঘুড়ি বানাচ্ছে, লেজ বিহীন ঘুড়ি, দুপুরের কড়া রোদকে কাঁধে চড়িয়ে বসিয়ে ঘুড়িটাকে উড়াতে হবে, কিছুক্ষন পর রোদটা আর অতটা উত্তপ্ত মনে হবে না, আসলে তখন আর কিছুই মনে হবে না। মানুষ কোন কিছুকে স্বীকৃতি দিলে সেটা নিজস্ব পর্যায়বৃত্তিক হয়ে যায়, প্রচন্ড এই রোদটাকে স্বীকৃতি দিতে হবে এখন, সাথে ঘুড়ি উড়ানো। অর্পাকে একটা খোঁজ দিতে হবে, কখনো ঘুড়ি উড়িয়েছে কিনা কে জানে! ঘুড়ি উড়ানোর সঠিক সময় হলো দুপুর বেলা, ওকে বেঁধে ধরে কিছুক্ষন বসিয়ে রাখতে পারলেই হয়, ঘুড়িটা উড়িয়ে নাটাই দিয়ে দিতে হবে অর্পার হাতে, ঘুড়িটা ফোকাসে থাকলে অর্পাও দুপুরের কড়া রোদটাকে অবচেতন ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলবে...
চার. ঘুড়ি উড়ি উড়ি
~ অর্পা কই তুমি?
** এইতো ভার্সিটিতে, ক্লাসে।
~ ক্লাস হয় নাকি আড্ডা মারো?
** আড্ডা মারি! ক্লাস হইছে দুইটা।
~ তুমি এখন আসতে পারবা এইখানে? জরুরী কথা ছিল।
** তোমাকে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে! কি হইছে?
~ তুমি আসতে পারবা কিনা বলো? এখনই!
** আরে বাবা! আমারে আধা ঘন্টা সময় তো দিবা।
~ ওকে, সোজা ছাদে চলে আসবা, আমি ছাদে আছি।
লেজবিহীন ঘুড়ি বানানোরও একটা ব্যাখ্যা আছে, লেজ যুক্ত ঘুড়িও বানানো যেত, যদিও লেজা ঘুড্ডি সহজে উড়ে কিন্তু ওটা একটু ধীর প্রকৃতির, আকাশে উড়াতে পারলেই কম্ম সাড়া আর কোন কিছু করা লাগে না কেবল নাটাই হাতে নিয়ে বসে থাকা, সুতা ছাড়া আর সুতা গোছানো।
কিন্তু লেজবিহীন ঘুড়িকে প্রতি মূহুর্তে নিয়ন্ত্রনে রাখতে হয়, এটা একটু ত্যাদড় টাইপের। সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়, অর্পা মজা পাবে ভেবেই লেজবিহীন ঘুড়ি বানানো হয়েছে।
ঘুড়িটাকে আকাশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ওড়ার আগে অনেক ত্যাদরামি করেছে, শেষ মেষ ওড়ানো গিয়েছে, ওটা এখন অর্পার হাতে, অর্পা খুব হাসছে, এখানে আসার পথ টুকুতে খুবই চিন্তিত ছিল, কিনা কি হয়েছে! এসেই দেখে আদ্রিত আকাশে তাকিয়ে আছে, অর্পাকে দেখে এত সুন্দর একটা হাসি দিল যে অর্পার ক্লান্তি নিমেষে মিলিয়ে গেল, আদ্রিত নাটাই অর্পার হাতে দিয়ে দিল, অর্পা এত মজা কখনোই পায় নি!
পাচ. অবশেষ
রোদটা কিছুক্ষন আগেই স্বীকৃতপ্রাপ্ত হয়েছে। রোদটায় যে মোহ জড়িয়ে আছে তা থেকে অর্পা আর আদ্রিত কেউই বেরুতে পারছে না...
আদ্রিত শঙ্খটা এবার অর্পার কানে দিলো, অর্পা শুনতে পেল আদ্রিতের এত দিনের জমানো সব অনুভূতি গুলো হুহু বেতারে প্রচারিত হচ্ছে...
আরেকটা শঙ্খ আসলেই খুব প্রয়োজন...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।