‘আঁধার রজনী পোহালো। ’ এরপর ‘সকালবেলার আলোর বাজে বিদায়ব্যথার ভৈরবী। ’
ঘরের এককোণে চেয়ারে বসে আছেন শঙ্খ ঘোষ। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। কাপড়ের জুতোটা পা থেকে কিছুটা দূরে।
গানের সঙ্গে সঙ্গে তাল ঠুকছিলেন হাতে। একটা হাত একটু ছুঁয়েছে গাল। কিছুক্ষণ সেখানেই স্থির। চোখ কখনো খোলা, কখনো বন্ধ। মাঝেমধ্যে আসরে সদ্য যোগদেওয়া চার সদস্যের দিকে তাকান।
মন ভরে যায় তাতে।
১৪ অক্টোবর তাঁকে দেখব বলেই গিয়েছিলাম ধানমন্ডির একটি বাড়িতে, যেখানে তিনি উঠেছেন।
কোনোভাবেই তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না-এই ছিল শর্ত। তাই একেবারে হাতে গোনা কয়েকটি কথা, অতঃপর বিদায়-এই ছিল আমাদের ভাবনায়। ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায় বিদেশী নায়ে’ গানটি শেষ হতেই শঙ্ঘ ঘোষের কন্যা ও নাতনিদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমাদেরই সঙ্গী একজন, ‘ওরা কোথায়?’ কেউ একজন উত্তরও দেন, ‘বাইরে গেছেন।
’
এবার শুনি তাঁর কণ্ঠস্বর-বহু প্রতীক্ষিত কণ্ঠস্বর, ‘হ্যাঁ, বাইরে গেছে। ’ ধীর, গাঢ় স্বরে বললেন শঙ্খ ঘোষ।
এই মানুষটাকে দেখব, এই মানুষটাকে শুনব-সে ভাবনায় পার করেছি কত দিন!
সুযোগ পেয়ে বলি, সতেরোয় আপনার লেখার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় তখন দেখেছিলাম, ৪০ বছর বয়সে লেখা বুদ্ধদেব বসুর ‘আমি বুড়ো, প্রায় বুড়ো, কী আছে আমার আর তীব্র তেতো মত্ত ্নৃতি ছাড়া’ পঙ্ক্তিটি নিয়ে যৌবনে আপনারা হাসাহাসি করতেন। চল্লিশের কাছে এসে বলেছিলেন, সেই রসিকতাটুকু ফিরিয়ে নিতে হলো আজ।
চল্লিশেই বুড়িয়ে যাওয়া কি ঠিক? আমিও এখন চল্লিশের স্পর্শে। তবে কি চল্লিশে আমাদেরও তিক্ত ্নৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে? চল্লিশ মানেই শেষ? এই পঁচাত্তরে এসে কী মনে হচ্ছে নিজেকে?
হাসলেন। ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমি আসলে ছিয়াত্তর পার হয়েছি। শিগগিরই সাতাত্তরে পড়ব।
আমার তো এখনই নিজেকে বেশ বাচ্চা-বাচ্চা লাগছে। মনে হচ্ছে সবে শুরু। ’
শিশুদের ব্যাপারে জানতে চাই আমরা। ছোট্ট একটা স্কুল নামের বইটিতে তিনি একটি অদ্ভুত স্কুলের বর্ণনা দিয়েছিলেন। জীবনের পাঠ পাওয়া যেত সে স্কুলে।
এখন সে রকম স্কুলের কথা ভাবাই যায় না। এখনকার শিশুরা, বিশেষ করে শহুরে শিশুরা কী নিয়ে বাঁচবে? মাঠহীন অনেক স্কুল, খেলাধুলাহীন অনেক শিশু।
বললেন, ‘সমাজের চেহারাটাই পাল্টে গেছে। বাচ্চাদের জন্য খুব কঠিন সময় এসেছে। অভিভাবকেরা থাকেন খুব সতর্ক।
এরই মধ্যে যতটা ভালো তৈরি করা যায়। বহু অভিভাবকের প্রতিযোগিতার প্রতি উৎসাহ রয়েছে। স্কুলে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে-সেটাও ঠিক করে দেওয়ার প্রবণতা আছে। এই যে পাল্টে গেল শিশুদের জীবন, তাতে অভিভাবকদেরও প্রশ্রয় আছে। শিক্ষাই দেওয়া হয়, কী করে প্রথম হতে হবে।
’ এবার বুঝি একটু গল্প করার ইচ্ছে হয় শঙ্খ ঘোষের। বলেন, “সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানে আমাদের সুভাষ দা বাচ্চাদের খুব ভালো বাসতেন। চারজন মেয়ে আর একটি ছেলেকে পালতেন, মানে মানুষ করছিলেন তিনি। তো, ছেলেমেয়েদের তিনি বলতেন, ‘এ্যাঁই, স্কুলে যাবি ঠিক আছে-কিন্তু খবরদার-ফার্স্ট হবি না। যদি ফার্স্ট হয়েছিস, তো গেছিস গোল্লায়।
’ কথাটা হালকাভাবে বলতেন, কিন্তু তারও একটা মানে আছে। ফার্স্ট হওয়ার ভাবনাটা মাথায় না থাকলে টেনশনগুলোও সরে যেতে পারে। নিচের ক্লাস থেকেই ফার্স্ট হওয়ার চাপ থাকলে মাথা বিগড়ে যায়। ’’
কলকাতায় প্রতিদিনই শিল্প-বিজ্ঞান-সাহিত্য নিয়ে কিছু না কিছু হচ্ছে। ভরে যাচ্ছে সেমিনার হল।
২০০ জনের বসার আয়োজন, সেখানে অন্তত ১৫০ জন শ্রোতা পাওয়া যায়। ‘কিন্তু শ্রোতা হিসেবে আমরা কাদের পাই? সবচেয়ে অল্পবয়সী শ্রোতাটির বয়স হয়তো ৫৫। ১০০ জনের মধ্যে খুঁজলে হয়তো ১০ জনের দেখা মিলবে, যাদের বয়স ৪০-৫০। ’
তরুণেরা যাচ্ছে কোনদিকে? গোটা পৃথিবীতেই তো মনের জন্য অন্য ধরনের রসদ চলে এসেছে। তার সব নিশ্চয়ই খারাপও নয়।
যখন ব্যাধি-লক্ষণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন অন্যদিকের আয়োজন তো একটু বাড়িয়ে দিতেই হয়।
তাহলে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা?
‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা যে পদ্ধতিতে হয়, তাতে যে ফল পাওয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গে তা ভাবাই যায় না। এই যে দুদিন হলো এসেছি, ঘরে বসেই গান শুনছি, তা অন্যরকম। কলকাতায়ও গান শুনি- সিডিতে শুনি, বাইরে এসে অনুষ্ঠানে শুনি। প্রভেদটা হলো-কলকাতায় ভালো গান গাইলেন হয়তো একজন, তারপর চলে গেলেন; শিল্প থেকে গেল শিল্প হয়েই।
বাংলাদেশে এসে গান শুনলে মনে হয়-গানটা আর শুধুই শিল্প থাকছে না, জীবন হয়ে উঠছে। আমার মনে হয়-ওয়াহিদুল, সন্জীদার যে আয়োজন, তার তুলনা নেই।
আবার শুরু হয় গান। এবার ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালী মালা’। একজন একজন করে অনেকেই গলা মেলায় তাতে।
সেই গানের সুর ছাপিয়ে মনে ভাসতে থাকে শঙ্খ ঘোষেরই কয়েকটি পঙ্ক্তি-‘তবে কি অস্তিত্ব বড়, অস্তিত্বের বেদনার চেয়ে’, ‘রাত্রির কলস ভেঙে প্রভাত গড়ায় দিকে দিকে’, ‘আমি যে আমিই এই পরিচয়ে ভরে না হৃদয়’, ‘শূন্যতাই জানো শুধু, শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে সেকথা জানো না?,’ আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’···।
ফিরে আসার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেন তিনি। আমরা-তাঁরই ভাষায়-স্মানের আনন্দ- নিয়ে ফিরে আসি
জাহীদ রেজা নূর
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।