আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি ব্যার্থ ভ্রমনের গল্প

...একজন সাদা-মাটা, ছোট-খাটো লোক।

পঞ্চগড় যেতে হবে একটা কাজে। থাকতে হবে টানা চার দিন। অবশ্য এর মধ্যে একদিন ছুটি আছে। সেই একটা দিন বসে না থেকে চামে চিকনে কোথাও যদি বেড়ানো যায় এই ধান্দায় এক বন্ধুর কাছে ধর্না দিলাম।

আমার এই বন্ধু আবার এমন বস্তু, পায়ের তলায় সরিষা আছে। বেশি দিন এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। ঘর থেকে গোটা বিশেক টাকা হাতাতে পারলেই চম্পট। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সব কয়টা তার দেখা শেষ। আজকে কালকের মধ্যে বিশ্বভ্রমনে বেরুলো বলে।

পঞ্চগড় যাবার কথা শুনে বললো - জিরো পয়েন্ট আছে, কিন্তু তেতুলিয়া যাওন লাগবো, মেলা ঝামেলা, পারবি না। তারচেয়ে মীরগড়ে চা বাগান আছে, খুব সুন্দর। ওইটা দেইখা আসিস। মার দিয়া কেল্লা ভেবে বের হচ্ছি, বন্ধু ঠোট টিপে হেসে বলল - একলা যাবি? আমারে সাথে নিয়া চল, চা বাগান ঘুরায়া দেখামুনে। বললাম - দোস্ত, কাজে যাইতেছি যে।

- তাইলে তিরিশটা ট্যাকা দিয়া যা। হাত একবারে খালি যাইতাছে। যাত্রার আগে মন ছোট করতে নেই, তিরিশ টাকার শোক ভুলে বাসে উঠলাম। খুজে পেতে নিজের সিটে বসার পর বুঝলাম আকাশ থেকে পড়ে খেজুর গাছে আটকে যাওয়া কাকে বলে। পাশের স্‌িেট বসেছে এক ‘আলাপ বাক্স’।

বয়স পঞ্চাশের উপরে হবে। কথার আর শেষ নেই। কারো কানের পোকার সমস্যা থাকলে এধরনের একজনকে খুজে নেবেন দেখবেন মুহুর্তেই আরাম। পাশে বসার মিনিট দশেক পরই সিটের উপর দুই পা তুলে দিয়ে, মহা আরামে গল্প জুড়ে দিলেন। আর সেও কি গল্প - কিছুদিন আগে তার বিশেষ জায়গায় টিউমার হয়েছিল।

কি করে কলকাতায় গিয়ে সেটার অপারেশন করিয়েছেন তার বিষদ বর্ননা। কেমন করে টিউমার কাটতে গিয়ে ফ্যাচ্‌চাক করে ডাক্তারের মুখে রক্ত ছিটকে কি বিশাল কেলেঙ্কারী হল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরন দিলেন। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল - টিউমার কাটার সময় আপনিতো উপুড় হয়েছিলেন, এতোসব দেখলেন কি করে? বিশেষ কৌতুহল দেখালাম না, কারন তার আলাপ ক্রমশই আধিভৌতিক গল্পের দিকে মোড় নিচ্ছিল। ‘বিলাই’ বান মেরে কি করে শত্রুর ‘তাফাল্লিং’ বন্ধ করা যায় তার গোপন তথ্য দিলেন। সব কথা মনেও নেই তবে সফরের অর্ধেকটা সময় এই লোকের গল্প শুনে কাটতে হয়েছিল আমাকে।

আর বাকি অর্ধেকটায় তার ঝড়বত ম্যারাথন নাক ডাকা। পঞ্চগড়ের পথে নেমে দেখি আমাকে নিয়ে মানুষের দারুন কৌতুহল। ঢাকার রাস্তায় সাদা চামড়া ওয়ালাদের হাটতে দেখলে আমরা যেমন ঘুরে ঘুরে তাকাই ঠিক সেইভাবেই যেদিকে যাই লোকজন দেখছে আমাকে। মজাই লাগলো বেশ। একটু ‘ফরেনার’ ‘ফরেনার’ ভাব নিতে ব্যাকপ্যাকের বেল্টটা কষে কোমরে বাধলাম।

ভালোই কাজ হল দেখলাম, লোকজন এইবার আরো বেশি বেশি দেখছে। কিন্তু খটকাটা লাগলো খানিক বাদে। লোকজন আমাকে খালি দেখছেই। এই যে তাদের সামনে দিয়ে ঘুর ঘুর করছি, কেউতো জিজ্ঞেস করলো না কই যাবো কি সমাচার? দেখি এক পিচ্চি মুখে আঙ্গুল পুরে চোখ তুলে চেয়ে আছি। খাতির জমাতে তার মাথা চুলকে বললাম-‘এই বাবু খবর কি?’ উত্তরে পিচ্চি মুখের আঙ্গুল বের করে আমার কোমরের দিকে দেখিয়ে বললো -‘আমনের পুষ্টাপিশ কুলা।

’ তারপর কি হল সেটা আর বললাম না, অতিকৌতুহলি পাঠক দয়া করে আমার কাছ থেকে ফোনে জেনে নেবেন। তবে সেখান থেকে দ্রুত সটকে পড়েছিলাম এটুকু বলে দিচ্ছি। গেলাম ধাক্কা মারা ব্রিজের ওপারে। ওখান থেকে নাকি ভ্যানে করে যাওয়া যায় মীরগড় টি ষ্টেটে। ভ্যান ভাড়া করতে গেলাম, পাঁচ টাকার ভাড়া চাইলো কুড়ি টাকা।

শেষে দশ টাকা বলে ভ্যানে উঠে বসলাম। ভ্যান চলছে। পঞ্চগড় দেখতে দেখতে যাচ্ছি। বাংলাদেশ যে কতটা সবুজ, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মাঠের ধান তখনও কাটা হয় নি, কালো কালো শালিকের ঝাক তাই ডাকাতের মত ঘুর ঘুর করছে ক্ষেতে ক্ষেতে।

জায়গায় জায়গায় গাঢ় সবুজ পাটের আবাদ করেছে লোকে। সেই পাট দু পাশে সবুজ পাতা মেলে বিকেলের হাল্কা বাতাসে নুয়ে নুয়ে ছুয়ে ছুয়ে যাচ্ছে একজন আরেকজনকে। পথের ধারে দাড়িয়ে থাকা বুড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছ শেষ কিস্তির ফুলগুলোকে নিয়ে ঝুকে আছে, কখন কেউ হাত পেতে নেবে সেই অপেক্ষায়। মাঝে মাঝে বাইসাইকেলে করে এক একজন পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে টুন টুন শব্দ করে ঘন্টা বাজিয়ে। আরো খানিকটা এগোতেই ভ্যানওয়ালা ভ্যান থামিয়ে দিল।

বললো - ‘নামেন!’ ভ্যানওয়ালাকে বললাম- ‘ এসে পড়েছি? কই চা বাগানতো দেখি না!’ ভ্যানওয়ালা কিছু বলে না, শুধু আঙ্গুল দিয়ে সামনের দিকে দেখায়। শেষে দশ টাকা হাতে দিয়ে হাটা ধরলাম। হাটছি তো হাটছিই, চা বাগানের আর দেখা পাই না। শেষে একটা হাটের মতন জায়গায় দেখলাম লোকজন জটলা করে আছে। তার মধ্যে থেকে একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম-‘ চা বাগান যাবো কিভাবে?’ লোকটা পান চিবোচ্ছিল।

চাবানো বন্ধ করে বললো - ‘ চা বাগান কোটে? ওয়াতো টি এষটেট্‌, অখন থাকি দুর আছে, ভ্যান না লিয়া যাবার পারবু নানে। ’ আরেকটা ভ্যান ধরতে হলো। এবারও ভাড়া দশ টাকা। ঠিক করলাম এবার চা বাগান না দেখে ভ্যান থেকে আর নামবো না, দাঁত কামড়ে পড়ে থাকবো। আগে যতখানি গিয়েছিলাম এবারও প্রায় ততখানি দূরত্ব পেরুতে হল।

কিন্তু এবার দেখা মিলল মিরগড় এর চা বাগানের। ক্যালেন্ডারের পাতায় যেমন দেখি, ভেবেছিলাম চা বাগানে গিয়ে বুঝি দেখতে পাবো নাক চ্যাপ্টা, চোখ ছুচোলি মেয়েরা চায়ের পাতা তুলছে আর পিঠের ঝুড়িতে ফেলছে। সেরকম কিছু দেখতে পেলাম না। দেখি শুন শান নিরব একটা স্থান। সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে যেন সবুজের অবাধ সমুদ্‌্র এক।

এক হাটু উচু হবে চা গাছগুলো। সব এক সমান হয়ে বেড়েছে। বুক খামচে ধরার মতন সুন্দর সেই বাগান! মনে হচ্ছিল ঘন সবুজ কার্পেট বেছানো চারদিকে, তার উপর দিয়ে বুঝি হেটে হেটেই চলে যাওয়া যাবে অনেক, অনেক দূর। মাঝে মাঝে বুনে দেয়া একহার j¤লম্বাv গাছ, পাশে দাড়িয়ে বাধুক প্রেমিকের মতন দাড়িয়ে দাড়িয়ে ছায়া বিলোচ্ছে চা বাগানে। তবুও ফাক ফোকর গলে রোদ পড়ছে সমুদ্রের উপর।

কিন্তু আকাশ থেকে মর্ত্যে নয়, যেন মর্ত্য থেকে রোদের আলো একটা ভিষন j¤লম্বা হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে। কোন দিকে গেছে এই পথ? এই পথ দিয়ে বুঝি ¯স্বর্গে যাওয়া যায়? কি হল জানি না, হঠাৎ সেই সুন্দরের বিহ্বলতায় পেয়ে বসলো আমাকে। আচ্ছন্নের মতন হেটে হেটে ঢুকে যাচ্ছিলাম চা বাগানের মধ্যে। সবুজ পাতায় সোনা রোদের আলো খেলে যাচ্ছে। মনে হল- আচ্ছা এগুলো সত্যি সত্যি চা গাছতো? নাকি হাটতে হাটতে কোন গোপন দরজা দিয়ে অলৌকিক এক বাগানে ঢুকে গেলাম? অমন সুন্দরকে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হল খুব।

আবার মনে হল কি জানি কি, যদি ছুতে গেলে স্বপ্নের‡cœi মতন ভেঙে চুরে যায়! আবার যেতেও ইচ্ছে করল। অন্যরকম এক ভ্রম পেয়ে বসলো আমায়। সেই অলৌকিককে ছোয়ার জন্য ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি আমি। আর একটু, আর মাত্র এক কদম...! ঠিক তখখুনি পেছন থেকে গেঞ্জী খামচে ধরলো কে যেন। ঘুরে দেখি এক বৃদ্ধা।

আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন - ও বাবু !ওদিক যায়ো না বাবু, ওইটা ইন্ডিয়া বাবু। বি এস এফ গুল্লি দিবো। ওদিক যায়ো না বাবু!’ -কি? -টি এষটেট্‌ ইন্ডিয়ায় পড়ছে। বি এস এফ ওই দিকে বন্দুক পাতিয়া বইস্যা থাকে। ওদিকোত ঢুকলি তোমাক্‌ গুল্লি দিবো।

তোমার কান্ধোত ক্যামেরা ঝোলে। - কি বলেন এই সব? - হ বাবা। তিনদিন আগে গরু ঢুইকছিলো একজনার, চা পাতা খাইতে। সে বিটি গরু আনতি গিয়া বি এস এফ এর হাতত ধরা পইড়লো। তাক মারি, বুট দিয়া পাড়াই, চোপা ভাঙ্গি ফেইলছে।

তোমার কান্ধোত ক্যামেরা আছে, তোমাক দেখলি একদম সাতে সাতে গুল্লি দিবো। যেখানে দাড়িয়ে ছিলাম আমি সেটা বাংলাদেশের শেষ সীমানা। চা বাগান আসলে ইন্ডিয়ার ভেতরে পড়েছে। এই তথ্যটা আমার জানা ছিল না। সরে এলাম সেখান থেকে।

সবুজের সাথে বুক মেলানো আর হল না। এখানে দাড়িয়ে থাকাও অর্থহীন। তাই ফিরে এলাম। ফেরার পথে মনে হল, আমরা মানুষ, কি অদ্ভুত তাই না? প্রকৃতি আমাদের একই মাটি, একই পানি থেকে বানিয়েছে। বাইরের রঙ সাদা কিংবা কালো, ভেতরে কিন্তু লাল রক্তই বইছে সবার শরীরে।

তারপরও মানুষে মানুষে কত বিদ্বেষ, কত ব্যাবধান! ধর্মের দিয়ে, জাত দিয়ে, গায়ের রঙ দিয়ে গন্ডি টেনে একজন আরেকজনকে দূরে সরিয়েই রাখছি কেবল। সীমানার মত তুচ্ছ অলীক ধারনা কত সহজেই আমাদের একজনকে আরেকজনের কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দেয়। কাছে কেন টানতে পারি না আমরা? কেন পারি না কাছে যেতে? সবুজ ধরতে ধরতেও ধরা হয় না, ¯স্বর্গ© দেখতে দেখতেও দেখা হয় না, কেন? কিন্তু জানি, জানি এ ব্যাবধান একদিন ঘুচবেই। সারা পৃথিবী সেদিন একটা দেশ হবে। সে আমি থাকি কিংবা না থাকি!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.