শঙ্কা বাড়ছে, সরকার কি অনুধাবন করছে?
ফকির ইলিয়াস
========================================
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি বাঙালিদের মাঝে দাঙ্গা চলছে। সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার প্রক্রিয়া চলছিল। এর মধ্যে দাঙ্গায় হতাহতের ঘটনা কাঁপিয়ে তুলেছে শান্তির ভিত। সরকার বিভিন্নভাবে এ দাঙ্গা দমনের চেষ্টা করলেও তা সমাধান করতে পারছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনে আবারও সেনা মোতায়েন করবে সরকার।
এবং তা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।
এদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অফিসের সামনে ক'দিন আগে বোমাসাদৃশ বস্তু পাওয়া যায়। গেল মঙ্গলবার রাতে দুটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছে বলে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। একজন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে একুশের দিনে শহীদ মিনার থেকে পুষ্পার্ঘ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ছাত্রলীগ নামধারী পাষন্ডদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন একজন তরুণী।
বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি তীব্র শঙ্কা আর প্রতিকূলতার মুখোমুখি বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার। এই যে অশনি সঙ্কেত এর নেপথ্যে কে? বা কারা? তা খুঁজে দেখতে সরকার খুব দৃঢ় প্রত্যয় দেখাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। যদি সরকার শক্তিশালী অবস্থান নিত, তবে একের পর এক ঘটনাবলি রাষ্ট্রকে কাঁপিয়ে তুলত না।
মনে রাখা দরকার, প্রতিক্রিয়াশীলরা সব সময়ই নিজেদের খোলস পাল্টায়। তারা কেন তা করে, তা বোঝা কিংবা জানা যায় কিছুদিন পরই।
সম্প্রতি ছাত্রশিবিরের শীর্ষ ২৪ জন ছাত্রনেতার পদত্যাগের ঘটনা তেমনি জল্পনার জন্ম দিয়েছে। শিবিরের ইতিহাসে এটি একটি বড় ঘটনা। কেন এমনটি হলো? এর দুটি কারণ অনুমান করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে, মৌলবাদী জঙ্গিপনা, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদিতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ করে এসব নেতা পদত্যাগ করেছেন। তারা দলীয় শীর্ষ নেতাদের অবৈধ আধিপত্য মেনে নেননি।
আর দ্বিতীয়টি হতে পারে, রাষ্ট্র যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে উন্মুখ তখন তারা সাময়িকভাবে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে মুখোশাবরণে গিয়েছেন মাত্র। এটা তাদের কৌশল বদল ছাড়া অন্য কিছু নয়। তারা জনসমক্ষে 'পদত্যাগ' দেখালেও নেপথ্যে থেকে নিজেদের শীর্ষদের মতবাদই প্রচার এবং পালন করবেন।
কোনটা সত্য, তা জানতে-বুঝতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকে। তবে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবেই।
কারণ শিবির নেতাদের এ পদত্যাগ মোটেই ছোট করে দেখার বিষয় নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর আগে 'হিজবুত তাহরীর' নামের একটি সংগঠনকে এ তালিকায় যুক্ত করা হয়েছিল। মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রজন্মের মাঝে জঙ্গিবাদ, কট্টরবাদিতা ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা যারা করছে, তাদের ব্যাপারে সতর্ক পদক্ষেপ নিয়ে এগুচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ধর্মীয় চেতনা প্রতিষ্ঠার নামে জিহাদী উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা একটি লক্ষ্যণীয় বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু সংগঠন রয়েছে যারা নিজেদের ধর্মীয় প্রচারণা সংগঠন বলে দাবি করে। মুসলিম উম্মাহ ইন আমেরিকা (মুনা), ইসলামিক সার্কেল ইন নর্থ আমেরিকা (ইকনা), দাওয়াতুল ইসলাম প্রভৃতি সংগঠনের সংগৃহীত বড় অঙ্কের ফান্ড কোথায় যায়, কী কাজে ব্যবহৃত হয় তা নিয়ে বেশ অনুসন্ধিৎসু যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা।
এটা সবারই জানা, যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশ, যে দেশ সাংবিধানিকভাবে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। 'ফ্রিডম অব রিলিজিওন' বিষয়টি সাংবিধানিকভাবেই এখানে স্বীকৃত।
কিন্তু সে স্বাধীনতার অপব্যবহার করে কেউ যদি কট্টরবাদের আশ্রয় নেয়, যুক্তরাষ্ট্রের আইনি বিধিকে চ্যালেঞ্জ করে তবে তা হতে পারে জঘন্য অপরাধের শামিল। যুক্তরাষ্ট্র এখন গোটা বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নিজ ভূমির অভ্যন্তরে বিষয়টির বিস্তার সম্পর্কে বেশ সতর্ক হয়ে উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কারাগারে যেসব মুসলিম ধর্মাবলম্বী বন্দি রয়েছেন, তাদের মাঝে ধর্মীয় বাণী প্রচারের জন্য ইমামরা দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেশ কিছু ইমাম প্রকারান্তরে এসব বন্দির মাঝে কট্টরবাদিতা ছড়ানোর প্রয়াসী হয়েছেন। এ নিয়ে 'চ্যানেল ফাইভ' একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে।
মিশিগান অঙ্গরাজ্যে এফবিআই কর্তৃক তল্লাশির সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ইমাম নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন গোয়েন্দাদের গুলিতে। এ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি উত্থাপিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী মহলে। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি প্রশাসনকে শঙ্কিত করে তুলেছে তা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় পদে আসীন মুসলিম কর্মজীবীদের কারও অপতৎপরতার আশঙ্কা। সে সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ধর্মীয় মৌলবাদ ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা।
এখানে বিভিন্ন মসজিদ কর্তৃক পরিচালিত যেসব ইসলামি স্কুল রয়েছে তাদের শিক্ষা ক্যারিকুলাম সরকার কর্তৃক অনুমোদিত।
তারপরও ধর্মীয় অনুশাসন (কোরআন-হাদিস) পড়ানোর নামে কোন ছাত্রছাত্রীর ব্রেন ওয়াশ করা হচ্ছে কি-না সে বিষয়টিও পরখ করে দেখছে শিক্ষা বিভাগ। বিশেষ করে নিইউয়র্ক, নিউজার্সি, শিকাগো, ক্যালিফোর্নিয়ার মতো বহুল মুসলিম অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্যে বিভিন্ন ইসলামি স্কুলগুলোর প্রতি গোয়েন্দা নজরদারি সে সত্যই প্রমাণ করছে।
বর্তমান এ সময়ে ওসামা বিন লাদেন বেঁচে আছেন কি-না তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেও। অনেকে মনে করেন, একটি জুজুর ভয় বাঁচিয়ে রাখতেই বিন লাদেন ইস্যুকে স্থায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বিন লাদেন এবং তার অনুসারীরা বারবার বলছেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের রক্তে আমাদের বীজ পুঁতে দিয়েছি।
প্রকারান্তরে তারা নতুন প্রজন্মের আমেরিকান মুসলিমদেরই বুঝাতে চাইছেন।
ধর্মের মৌলবাদী উন্মাদনা কিংবা কট্টরপন্থি ধারা, সমাজের কল্যাণে কি প্রকৃতপক্ষে কোন কাজে আসে? এ প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন সম্প্রতি একটি নিবন্ধে ,যুক্তরাষ্ট্রের একজন সমাজ বিশ্লেষক ড. ওয়ারেন নিগেলস। তিনি বলেছেন, 'কট্টরপন্থিরা প্রথমে শান্তির বাণীর দোহাই দিলেও পর্যায়ক্রমে তারা নিজেদের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লিপ্ত হয়। আলজেরিয়া, সোমালিয়া এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অথবা শিয়া-সুন্নীদের মাঝে যে কলহ, দাঙ্গা চলছে সেটা কি প্রমাণ করে না এরা আসলে শান্তি নয় বরং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষকেই লালন করছে।
'
বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে যে জঙ্গিবাদী গ্রুপগুলো নানা অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে এরা মূলত একাত্তরের পরাজিত শক্তির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা। ১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এরা নানা প্রকারে, নানা আবরণে আবির্ভূত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এসব বিভিন্ন গ্রুপকে চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টাই করছে মাত্র। নিজ নিজ ভূমিতে এসব অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে-সেসব দেশের গণমানুষকেই।
নিউইয়র্ক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০
----------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ ।
ঢাকা। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- সেলী ফর্ড
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।