দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট আজ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। সব আসনেও নির্বাচন হচ্ছে না। তিনশর মধ্যে ১৫৩ আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বি্বতায় নির্বাচিত হওয়ায় ভোট হবে ১৪৭ আসনে। যেসব আসনে নির্বাচন হচ্ছে সেখানেও পর্যাপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিও এবার কম। তবে নানামুখী সংঘাত-সহিংসতায় মানুষ শঙ্কিত। নিরাপত্তা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
ভোটকেন্দ্র ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসার বাহিনীর সাড়ে চার লাখ সদস্য এখন নির্বাচনী মাঠে। নাশকতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যে কোনো ধরনের অভিযান চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সহিংসতার ঘটনা ঘটলেই প্রয়োজনে হেলিকপ্টারে করে ঘটনাস্থলে পেঁৗছানোর মতো প্রস্তুতিও রয়েছে নিরাপত্তা রক্ষীদের। এবার ৫৯ জেলার ১৪৭ আসনে ১৮ হাজার ২০৮টি ভোটকেন্দ্রে ভোট হবে। অর্ধেকের বেশি ভোটকেন্দ্রকেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ইসি। ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে বিশেষ নিরাপত্তার জন্য থাকছে মেটাল ডিটেক্টর। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এবার পাঁচ জেলায় নির্বাচন হচ্ছে না।
নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত হয়ে ওঠা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কম পর্যবেক্ষকদের। এবারের নির্বাচনে দেশি পর্যবেক্ষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজারের কিছু বেশি। বিদেশি পর্যবেক্ষক মাত্র চারজন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে পর্যবেক্ষক ছিলেন এক লাখ ৬০ হাজার। বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিলেন ৫৮৫ জন।
আছে নিবন্ধিত ১২, নেই ২৮ দল : প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের শরিক, বিকল্পধারাসহ ইসির নিবন্ধিত ২৮ দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এর পরও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় পার্টি, জেপি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ (ইনু)সহ ১১টি দলের প্রার্থীদের সঙ্গে।
ইসি জানিয়েছেন, ১৪৭ আসনে প্রার্থী রয়েছেন ৩৯০। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ১১৯, জাতীয় পার্টির ৬৪, স্বতন্ত্র ১০৬ এবং বাকি ১০১ জন প্রার্থী ১০টি দলের। দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে কম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচন আজ।
সরকার গঠনেও হতে পারে নতুন কোনো ইতিহাস। এবার ব্যালট পেপার মুদ্রণ করা হয়েছে ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮টি। এ ছাড়া প্রতিটি আসনের জন্য ১০০০ করে পোস্টাল ব্যালট। ১৪৭টি আসনে ভোটার ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। আর ১৮ হাজার ২০৮ ভোটকেন্দ্রে থাকবে ৯১ হাজার ২১৩ ভোটকক্ষ।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন একক প্রার্থীরা। বাকি ১৪৭টি আসনে আজ ভোটগ্রহণ হবে। জানা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সামরিক বিমান এবং হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে ১৮ হাজার ২০৮ ভোটকেন্দ্রের প্রায় অধিকাংশ কেন্দ্র ও বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত ১৯ জেলা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গতকালও ঢাকা, সিলেট, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, ভোলা, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় ভোটকেন্দ্র তথা স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করছে, বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত ১৯ জেলা বেশি স্পর্শকাতর। এসব জেলায় সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে স্বতন্ত্রদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে গতকাল ইসিতে বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ এসেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। আর নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। গত শুক্রবার থেকে ৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছে ইসি।
ভোট চলাকালীন ভোটার ছাড়া বহিরাগতদের চলাচলেও থাকবে নিষেধাজ্ঞা। যান চলাচলও বন্ধ থাকবে। ভোটগ্রহণের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে প্রশিক্ষিত আড়াই লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা। এবার ভোটগ্রহণের জন্য ১৮ হাজার ২০৮টি ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্বাচনী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ২৬ ডিসেম্বর থেকে টহল শুরু করেছে সেনাবাহিনী।
থাকবে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়া র্যাব ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং বিজিবি ও কোস্টগার্ড গতকাল ৩ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত থাকবে।
এক নজরে দশম সংসদ নির্বাচন : মোট আসন-৩০০, ভোট হবে ১৪৭ আসনে (১৫৩ আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত)। ভোটার সংখ্যা ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭। নারী ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৪১ হাজার ৯০৫; পুরুষ ৪ কোটি ৬১ লাখ ২৪ হাজার ৭২।
১৪৭ আসনে মোট ভোটার ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৮ হাজার ৭২৪। পুরুষ ২ কোটি ২০ লাখ ৬ হাজার ৮২৬; নারী ২ কোটি ১৯ লাখ ১ হাজার ৯২৮। মোট ভোটকেন্দ্র ৩৭ হাজার ৭০৭, ভোটকক্ষ ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮। ১৪৭ আসনে ভোটকেন্দ্র ১৮ হাজার ২০৮, ভোটকক্ষ ৯১ হাজার ২১৩। রিটার্নিং কর্মকর্তা ৬৬ জন, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ৫৭৭ জন।
যেসব জেলায় ভোট নেই_ চাঁদপুর, রাজবাড়ী, জয়পুরহাট, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর। অংশ নেওয়া দলের সংখ্যা ১২। মোট প্রতিদ্বন্দ্বী (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ১৫৩ জনসহ) ৫৪৩, এর মধ্যে পুরুষ ৫১৬, নারী ২৭, স্বতন্ত্র ১০৪। ১৪৭ আসনে প্রার্থী ৩৯০ জন। ১৪৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১২০ জন, স্বতন্ত্র ১০৪ জন, জাতীয় পার্টির ৬৬ জন, জেপির ২৭ জন, বিএনএফের ২২ জন, জাসদের ২১ জন, ওয়ার্কার্স পার্টির ১৬ জন।
এ ছাড়া ন্যাপের ৬ জন, তরীকত ফেডারেশনের ৩ জন, খেলাফত মজলিসের ২ জন, গণতন্ত্রী পার্টির ১ জন, গণফ্রন্টের ১ জন এবং বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ১ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া ১২৬ জন আওয়ামী লীগের, ২০ জন জাতীয় পার্টির, ৩ জন জাসদের, ২ জন ওয়ার্কার্স পার্টির, ১ জন জেপির। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী_ আনসার ২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০, পুলিশ ৮০ হাজার, সশস্ত্র বাহিনী ৫২ হাজার ১০০, বিজিবি ১৬ হাজার ১৮১, র্যাব ৮ হাজার ৪০৪, কোস্টগার্ড ২০০। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৮ জন করে নিরাপত্তা রক্ষী থাকবে। ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি ১০৩টি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক ১০ হাজার ৩৫৫ জন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন ও ঝুঁকিপূর্ণ ১৩ হাজার কেন্দ্র : ইসি কর্মকর্তারা জানান, ভোটকেন্দ্র ১৮ হাজার ২০৮ এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্র ১৩,০০০। নিয়োজিত রয়েছে ব্যাটালিয়ন আনসার ও অঙ্গীভূত আনসার ২ লাখ ২০ হাজার ১০৮। বিজিবি ১৬ হাজার, র্যাব ৮ হাজার, কোস্টগার্ড ২০০, পুলিশ ৭৯ হাজার, সশস্ত্র বাহিনী ৫০ হাজার। ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি ১০৩টি।
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৭। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ২৯৪।
ইসির নিরাপত্তা জোরদার : ভোটকে সামনে রেখে ৪ থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত শেরেবাংলানগরের ইসি কার্যালয়ে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছে ইসি। সেই সঙ্গে ভোটের ফলাফল ঘোষণারও প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনী ও র্যাব হেলিকপ্টার ব্যবহার করবে : দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাচন কর্মকর্তা, নির্বাচনী মালামাল পাঠাতেও হেলিকপ্টার প্রয়োজন হয়।
এ লক্ষ্যে নির্বাচনের কয়েক দিন আগে থেকে নির্বাচনের পরের দিন পর্যন্ত হেলিকপ্টার সার্ভিস দিতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গতকাল তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম ৩৩টি কেন্দ্রে হেলিকপ্টারে পেঁৗছেছে নির্বাচনী মালামাল।
'ঝুঁকিপূর্ণ' এলাকায় মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেকিং : ভোটারদের নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে আসার পরিবেশ তৈরি করতে ভ্রাম্যমাণ সব ইউনিটকে নিবিড় টহল দিতে হবে। যে কোনো ধরনের অশুভ কার্যকলাপ প্রতিরোধে সজাগ থাকতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রয়োজনে মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রচারণা শেষ ও নিষেধাজ্ঞা : শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হয়েছে ভোটের প্রচারণা। গতকাল রাত ১২টা থেকে ভোটের দিন আজ ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত অননুমোদিত যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। মোটরসাইকেল চলাচলে মানা ৩ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি। লাইসেন্সধারী অস্ত্র নিয়ে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ২২ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। ভোট শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় কোনো সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা করা যাবে না।
ভোটে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মপরিধি, প্রশাসন ব্যবস্থাপনা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও প্রার্থীর এজেন্ট নিয়োগ, ফলাফল প্রকাশ বিষয়ে ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের আইনানুগভাবে কাজ করতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কেন্দ্রের বাইরে নিরাপত্তা বলয় : ভোটের আগের দিন গতকাল প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা ব্যালট পেপারসহ মালামাল গ্রহণ করে কেন্দ্রে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ অবস্থান করছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সুবিধাজনকভাবে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
ভোটে বাধা দিলে দুই থেকে সাত বছরের দণ্ড : ইসির জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান জানান, নির্বাচনী আইন মেনে শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোনো সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা করা যাবে না। এ সময় বিশৃঙ্খল আচরণ, ভোটে বাধা ও নির্বাচনী কাজে দায়িত্বরতদের ভয়ভীতি দেখানো, অস্ত্র ও শক্তি প্রদর্শন করা যাবে না।
"কেউ বিধান লঙ্ঘন করলে নূ্যনতম দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দেওয়া হবে। "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।