আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দায় কি কেবল ওদেরই?

সময়টাই এমন হয়েছে যে আমরা কেবল নিজের দিকেই দেখছি, অন্যের দিকে, সমাজের দিকে তাকাচ্ছি না। নিজের স্বার্থের কাছে দেশ-জাতির স্বার্থ একেবারেই গৌণ হয়ে গেছে। অন্যায়-অপকর্মের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা ঘটছে ঠিক উল্টো। অন্যের অন্যায়টা ঠিকই চোখে পড়ছে, কিন্তু নিজের অনৈতিক কাজের দিকে তাকানোর বেলায় আমরা একেবারেই অন্ধ হয়ে থাকছি। ও চোর, আমি সাধু—এই হয়েছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।

প্রক্রিয়াটা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে নিজের সন্তানের ক্ষেত্রেও ছাড় নেই। সন্তান যদি বখে যায়, তার দায় যেন কেবল তারই—আমাদের কোনো দায় নেই।
দেশে কিশোর-তরুণদের অপরাধ ও অনৈতিক কাজের মাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে শিশুরাও পিছিয়ে নেই। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন-ধর্ষণের সঙ্গে তরুণেরা হামেশাই জড়িয়ে পড়ছে।

এই বয়সীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের হারও আশঙ্কাজনক। তাদের এসব কাজ কোনো শিষ্টকর্মের দৃষ্টান্ত নয়, তবে তা যে আমাদের কথিত ভদ্রসমাজের অপকর্ম আর বিকৃতিরই প্রতিরূপ—তা আমরা উপলব্ধিতে আনছি না। শেওড়াগাছের বীজ থেকে শালবৃক্ষ গজায় না—সে কথাও ভুলে যাচ্ছি আমরা।
তরুণ বয়সীদের মনোজগতে এখন কোন আদর্শ খেলা করে? তারুণ্যের কাল স্বপ্নে বিভোর হওয়া আর নেশায় মত্ত হবার কাল। একসময় তরুণদের বড় অংশ দেশের জন্য, মানুষের জন্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য মিছিলে শামিল হতো।

এখন ‘যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—এ আদর্শের নেশায় মত্ত হতো তারা। আজকের তরুণদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিন্তু সে পথে নেই। তাদের অনেকেই আবার সন্ত্রাস-মাদকের নেশায় মত্ত। সেদিনের তরুণদের লক্ষ্য ছিল আত্মমুক্তি। আজ অনেক তরুণের লক্ষ্য হয়েছে আত্মসমর্পণ।

কখনো মাদকের, কখনো সন্ত্রাসের অধীন হচ্ছে তারা। স্বাধীনতা আর অধীনতা বিপরীতমুখী দুই ধারণা। এর একটি মুক্তির, অন্যটি শৃঙ্খলের—একটি সম্মুখমুখী অপরটি পেছনমুখী। পরাধীন ব্যক্তি স্বাধীন হতে চায়। কিন্তু স্বাধীন কেউ পরাধীন হতে চায় না।

অথচ এখনকার তরুণেরা মাদকশিকলে, হীন স্বার্থের শিকলে নিজেকে বাঁধতে চাইছে। আদর্শের এই উল্টো যাত্রা আজকের তরুণদের করছে ক্রমাগত পেছনমুখী। তবে আজকের তরুণদের এই পেছনমুখী যাত্রার জন্য তাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা যায় কি?
সেদিনের তরুণেরাই তো আজকের তরুণদের অভিভাবক—সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রের কর্ণধার। আজকের তরুণেরা যদি সেদিনের তরুণদের কাছে প্রশ্ন রাখে, তাঁরা তাঁদের আত্মমুক্তির আদর্শকে ধরে রাখতে পারেননি কেন, কী জবাব দেবেন সেদিনের তরুণেরা? সেদিনের তরুণেরা—মানে আজকের এই আমরা। আজকের তরুণদের কাছে আমাদের কোনো জবাব আছে কি? কী আদর্শ আমরা একালের তরুণদের সামনে স্থাপন করতে পেরেছি।

একাত্তরের আদর্শটাই তো আমরা ধরে রাখতে পারিনি। পারিনি কোনো পরম্পরা তৈরি করতে। পারলে আজকের তরুণেরা পেছনমুখী হতো না কখনোই।
অভিভাবক হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, রাজনীতিক হিসেবে আমরা ব্যর্থ। আমাদের ব্যর্থতার দায় তাই একালের তরুণদের ওপর চাপানোর সুযোগ নেই।

অভিভাবকের শাসন ও স্নেহ-ভালোবাসায়, শিক্ষকের পাঠদানে, রাজনীতিকের সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় আজ কোনো আদর্শ কাজ করে না। কাগজে-কলমে যে আদর্শ আছে আমাদের জীবনাচরণে ও রাষ্ট্রাচারে, তার কোনোই প্রতিফলন নেই। আমরা আদর্শকে আজ ধারণ করি না, ক্ষমতা আর লোভভোগের প্রয়োজনে আদর্শকে ব্যবহার করি। তরুণেরা আজ তাই দিশাহীন, বিভ্রান্ত। উদারতার নাম করে এদের এক দলকে আমরা ঠেলে দিচ্ছি লোভ-ভোগ-নেশার কাতারে।

আর ঈশ্বরের দোহাই পেতে অন্য দলকে নিয়ে যাচ্ছি উগ্রতা আর হিংস্রতার পথে। অথচ উভয় দলের পথই পেছনের পথ, অন্ধকারের পথ। এদিকে আলোর পথে যারা যেতে চায়, চলতে চায় সম্মুখে, তাদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে আমরা তাদের ওপর প্রয়োগ করছি আস্তিক-নাস্তিক আর তেঁতুলতত্ত্বের মতো অসংখ্য ধাঁধা।
অভিভাবক হিসেবে আমরা আমাদের সন্তানদের ব্যাপারে হয় উদাসীন, না-হয় অতিমাত্রায় সক্রিয়। সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য প্রকৃত করণীয় এভাবে থেকে যাচ্ছে অবহেলিত।

আমরা আমাদের ইচ্ছা সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দিই—সন্তান কী চায় সেদিকে তাকাই না। ফলে সন্তান ধীরে ধীরে হতাশ এবং জীবনবিমুখ হয়ে পড়ে। আমরা নিজেদের অসততা ও বিকৃতিকে সন্তানের কাছে আড়াল করি, অথচ সন্তানদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি সততা ও শোভন আচরণ। অভিভাবকের এই মুখোশ অবশ্য সন্তানদের কাছে দ্রুতই উন্মোচিত হয়। মুখে কিছু না বললেও এতে সন্তানেরা ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ে; কখনো আবার অনুসরণ করতে শুরু করে অভিভাবকেই।


সন্তানের কাছে আমরা দূরের কুয়াকাটার সূর্যোদয়কে মডেল করে তুলি। অথচ সে নিজের বাড়িতে থেকে কখনো সূর্যোদয় দেখেছে কি না, ভোরের পাখির গান শুনেছে কি না, কখনো পা রেখেছে কি না হেমন্তের শিশিরভেজা ঘাসে—এ কথা জানার প্রয়োজন অনুভব করি না কোনো দিন। আমাদের সন্তানেরা অতিথিকক্ষে রাখা অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছদের খেলা দেখে বড় হয়। কীটনাশক আর রাসায়নিক সারের প্রভাবে বিল-ঝিল থেকে দেশি ট্যাংরা-পুঁটি কীভাবে উধাও হয়ে যাচ্ছে—সে খবর রাখে না। তারা গাছে চড়তে পারে না, সাঁতার জানে না, বনের বৃক্ষশাখায় বাঁধা বাসায় পাখিরা গভীর মমত্বে কীভাবে ওম দিয়ে নিজের ছানাদের বড় করে তোলে, সে অভিজ্ঞতাও হয় না তাদের।

কোন ঋতুতে কোন ফসল ফলে, জলবায়ু কীভাবে পাল্টে যায়, প্রাণীজগতের বৈচিত্র্য রক্ষা পেল কি পেল না ইত্যাদি কোনো বিষয়েই সুস্পষ্ট বাস্তব ধারণা তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় না। ফলে এসব বিষয়ে পাঠ্যবইয়ের পাঠ শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে থেকে যায় ধোঁয়াশাই। কেবল মুখস্থবিদ্যা হয় তাদের প্রধান ভরসা। এই বিদ্যা দিয়েই সে অর্জন করে স্বর্ণখচিত এ-প্লাস। বিদ্যাপীঠের শিক্ষক ও অভিভাবকেরা এতে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন।

তবে এই তৃপ্তির দায়টা শেষ পর্যন্ত সন্তানকেই বহন করতে হয়। যে জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই, সেই নড়বড়ে জ্ঞান তাদের করে তোলে অহংকারী। এভাবে তারা নিজেদের নিয়ে যায় অলীক এক কল্পনার জগতে।
আজকের তরুণদের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো অন্যের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা। অথচ এর জন্য তারা নিজেরা বিন্দুমাত্র দায়ী নয়।

ভালোমন্দের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সক্রিয় অভিভাবকেরা সন্তানদের কেবল প্রকৃতি পরিবেশ থেকেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন না, তাদের বাস্তব সমস্যা মুখোমুখি করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রক্রিয়া থেকেও দূরে রাখছেন। ছোটখাটো কোনো ভুলও যেন সন্তানেরা করে না ফেলে, সে ব্যাপারে অভিভাবকেরা খুবই সচেতন। পিছে সন্তান ভুল করলে মা-বাবার শাসন করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, এই ভয়ে শুরু থেকেই তারা কোরো না, যেয়ো না, খেয়ো না—এমন অসংখ্য ‘না’-এর বেড়াজালে সন্তানকে বড় করে তুলছেন। এই শ্রেণীর অভিভাবকেরা হয়তো মানতে চান না যে ছোটরা ছোট ছোট ভুল থেকেই সমস্যার সমাধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শেখে।
সন্তানদের নির্ভরশীল করে তোলার দৌড় এখানেই শেষ নয়।

দৌড়ের পরবর্তী চক্রটি শুরু হয় প্রাইভেট টিউটর ও কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে আবার অভিভাবকদের সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কার সন্তান কতজন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠ গ্রহণ করল, সেই সংখ্যা দ্বারা নির্ণীত হয় অভিভাবকের মর্যাদা। সার্বিক এই ব্যবস্থায় জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব কাজই করে দেন অভিভাবক বা প্রাইভেট টিউটররা। ফলে খাওয়া-ঘুমানোর মতো কাজ আর অভিভাবকদের নির্দেশিত পথে চলা ছাড়া সন্তানদের নিজে থেকে কিছুই করার থাকে না।


এই অভিভাবকেরাই তো আবার বিদ্যাপীঠের শিক্ষক। তাই বিদ্যার্থীদের জ্ঞানদান-প্রক্রিয়ায় গতানুগতিক রীতির অন্যথা কমই ঘটে। নিজেদের দুর্বলতার জন্যই হোক, অথবা ব্যক্তিস্বার্থের ব্যস্ততার জন্যই হোক, অধিকাংশ শিক্ষক নির্ধারিত সিলেবাস, গুটি কয়েক পাঠ্যবই আর নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষার্থীদের গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলেন। এর বাইরেও যে জগৎ আছে, জ্ঞান আছে এবং তার সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে না পারলে যে জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং কখনো কখনো সে জ্ঞান যে ভয়ানক হয়ে ওঠে—এ বিবেচনা শিক্ষকেরা কমই করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষার পাট তো প্রায় চুকেই গেছে।

আছে যেটুকু তা-ও শেষ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের অভাবে। খেলার মাঠ আজ প্রায় শূন্য। ঘরে বসে টিভিতে খেলা দেখে অভ্যস্ত সন্তান হঠাৎ করে তো খেলোয়াড় বনে যেতে পারে না। জ্ঞানচর্চাকে অর্থবহ করার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন উদাসীন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে তা করতে গেলেও রয়েছে বিস্তর বাধা।

প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের পাশাপাশি অভিভাবকেরাও সংস্কৃতিচর্চাকে আজকাল ভালো চোখে দেখেন না। ফলে পা বাড়ানো যায় না সেদিকেও।
বাকি থাকে মিছিলে যাওয়া। কিন্তু তারুণ্যের এই শ্রেষ্ঠ কাজটি এখন হয়ে গেছে স্বার্থবাদীদের আজ্ঞাবহ। আদর্শবাদিতার পথ ছেড়ে আজকের মিছিল ককটেলবাজি চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি ক্ষমতাবাজির পথে ধাবমান।

ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও নির্ভরশীল তরুণের পক্ষে তার ভালোমন্দ যাচাই করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পিছু হটে সে, অথবা জ্বলে উঠতে না-উঠতেই নিভে যায়।
আমাদের সন্তানেরা আজ একা, অসহায়, দিশাহীন। অথচ ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেদের কৃতকর্মের দিকে কি আমরা আজও ফিরে তাকাব না? কী রেখে যাচ্ছি আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য?
আমাদের সন্তানেরা আজ দিশাহীনসমুদ্রে নিমজ্জমান।

তীরে দাঁড়িয়ে আমরা আর কতকাল নীরব দর্শক হয়ে থাকব? হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সময় কি এখনো আসেনি?
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।