বিকট
*
সম্প্রতি একটা টেপরেকর্ডার কেনার কথা ভাবছি। পুরোনো আমলের..ছিলোনা ঢাউস সাইজের? গান শোনা যেতো, রেডিও শোনা যেতো, আবার কথা রেকর্ডও করা যেতো! বৃথাই গুণকীর্তন করছি ওই রদ্দিমালের! ইদানিং কত উন্নতমানের, চমৎকৃত করার মত যন্তর বের হয়েছে! আমাদের অনুজেরা কানে অলংকারের মত সজ্জিত করে রাখে প্রযুক্তির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিস্ময়! কিন্তু আমার এখন আর কিচ্ছুতেই বিস্ময় জাগেনা। কেউ যখন কোন নব্য আবিস্কৃত বিস্ময় আমার সামনে তুলে ধরে তার গুণকীর্তন করা শুরু করে, তখন আমি ভদ্রতাবশত যথেষ্ঠ উচ্ছাস দেখালেও মনের চরে চড়ে বেড়ায় মরা বক। মনটা মরে গেছে আমার। না..এখনও মনে হয় মরেনি।
তাই তাকে বাঁচানোর জন্যে শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে আমি প্রস্তুতি নিলাম হাওয়াবদলের। দীর্ঘভ্রমনের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্বল সঙ্গে নিলাম।
আমি হাঁটি
আমি হেঁটে চলি
শহরের পীচঢালা পথ কখনও আমার কাছে পলিমাটির মত নিবিড় মনে হয়।
এই দীর্ঘযাত্রার ফলশ্রূতিতে আমি একদিন শহরের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলের যন্ত্রপাতি সারাই করার দোকানে এসে উপস্থিত হই। প্রৌঢ় দোকানি বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো।
আমাকে দেখে তার চোখ চকচক করে উঠলো। আমাকে মোহিত করার জন্যে সে তার পুরোনো, প্রায় বিকল সরঞ্জামগুলোর স্থায়ীত্ব সম্পর্কে বলা শুরু করলো।
"কুনো চিন্তা করবেননা ছ্যার। এইডা ন্যাশনাল কোম্পানির জিনিস। দশ বচ্ছরেও কিছু হৈবোনা।
আর কিছু হৈলে নিয়া আসবেন..আইজকাল কি সব জিনিস বাইর হইছে দুইদিন পরপর নষ্ট হয়.."
তার সাথে আলাপে মেতে উঠতে আমার কোন আগ্রহ ছিলোনা। আমি গিয়েছিলাম অসুস্থ্য একজনের জন্যে পথ্য কিনতে।
*
বাসায় থরে থরে সাজানো আছে পুরোনো দিনের গানের এ্যালবাম। আর আছে কিছু ব্যক্তিগত কথোপকথন। আমি ধূলো জমতে দেইনি ওসবের উপরে।
সযতনে পরিস্কার করেছি সবসময়।
-তুমি সুস্থ্য বোধ করছোতো? আমি আমার মনটাকে জিজ্ঞেস করলাম। তার প্রফুল্ল হাসি দেখে অনেকটাই আশ্বস্ত হলাম। ওকে শুইয়ে দিলাম একটা আরামদায়ক স্থানে। পরিচর্যার জন্যে ব্যবস্থা করাটাই বাকি এখন।
-বল তোমার কি চাই? আমি শুধোলাম তাকে।
-কি না, বল কাকে।
-আচ্ছা বল কাকে চাও। দেখা যাক এনে দিতে পারি কিনা।
-আচ্ছা তোমার কি মনে আছে ওই গুট্টুস গাট্টুস বাবুটার কথা? ওই যে পানিপিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়তো? কি যেন নাম তার.. ওকে একটু এনে দাওনা..ওর কথা শুনতে ইচ্ছে করছে খুব..
বুঝলাম স্মৃতিবৈকল্যে ভুগছে সে।
আমার ছোটভাইটার নামটাই ভুলে গেছে! অসুস্থ্যতার চরম পর্যায়। আমি খুঁজতে লাগলাম ওয়ার্ডরোবে সাজানো গল্পবলা ফিতে গুলো। পেয়েও গেলাম। মনে আছে, অনেকদিন আগে, অনেক অনেক..দিন আগে, যখন আমরা দলবেঁধে বনভোজনে যেতাম আর কাগজের স্মৃতিতে বন্দী হতাম হাস্যমুখে.. আমরা তখন ছড়া বলতাম, কেউ কোন লাইন ভুল করলে হেসে ফেলতাম। আমাদের ছোট্টভাইটা একবার ভুল করেছিলো, "ঐ দেখা যায় তালগাছ, ঐ আমাদের গাঁ", বলতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলো পরের লাইনগুলো বেমালুম! সে নিয়ে আমাদের কত হাসাহাসি! স্মৃতি অবিনশ্বর করার উৎসাহে আমরা তা রেকর্ড করে রেখেছিলাম যন্ত্রের সহায়তায়।
আমি এখন ওটাই খুঁজছি। একজন রোগাক্রান্ত মানুষকে সহায়তা করার সামান্য প্রয়াস আর কি! কোথায় গেল! কোথায় গেল! সেইসময়ের চরম জনপ্রিয় হওয়া লম্বা চুলের গায়কটাকে দেখছি, যাকে ইদানিং সবাই ব্যাকডেটেড বলে, তা বলুকগে! এইতো পেয়েছি। স্পষ্ট করে লেবেল সাঁটানো আছে, "গুট্টুসের কবিতা"।
-"এই, এত দেরী করছ কেন! জানোনা আমি অসুস্থ্য!" আকুতি প্রকাশ পেল তার কন্ঠে। আমি দ্রুত গুট্টুসের কবিতা চালিয়ে দিলাম জরাজীর্ণ টেপরেকর্ডারে।
-মনে আছে তোমার? স্মিত হেসে বলল সে।
- কি যে বল! থাকবেনা! আমার ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠলো সম্ভাব্য অতীত অবগাহনের আনন্দে।
প্লে বাটনটা টিপে দিলাম। কিছুক্ষণ খসখস শব্দ। তারপর আমাদের প্রিয় গুট্টুসকে আবার শুনবো আমরা।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি আমি আর আমার মন।
*
বেজে উঠলো টেপরেকর্ডার।
হাউয়ার পুলারে এমন ছ্যাচা দিতে হৈবো যে জীন্দেগিতে আর দিল্লাগি করবার পারবোনা।
ঐ দেখা যায় তালগাছ
খানকির পোলার হাইট ছয় ইঞ্চি কমায় দিতে হইবো।
ঐ আমাদের গাঁ
টেপরেকর্ডারে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকা রোগীর দিকে তাকালাম।
"আরে বোঝোনা! পুরোনো জিনিস, একটু আকটু সমস্যা করবেই!" আশ্বস্ত করলাম তাকে। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি আমার যাবতীয় দক্ষতা দিয়ে বেতাল জিনিসটাকে ঠিক করতে। এইতো হয়ে এল বলে, এইতো হয়ে গেছে।
এবার আর কোন সমস্যা হবেনা।
আমি আবার চালিয়ে দিলাম যন্ত্রটাকে।
-"আরে বাল..সমস্যা তো একটু আকটু হইবোই, তারলিগা অত ভয় পাইলে চলবো? আমগো নেতারা আছে কিল্লিগা?"
আমাদের গুট্টুসেরই কন্ঠ।
-ও এরকম করে কথা বলছে কেন? ওর কন্ঠে মানুষের রক্তের নোনতা স্বাদ কেন?
-এটা আমাদের গুট্টুস না
-এটা আমাদের গুট্টুস না, কিন্তু ওই তো একসময় আমাদের গুট্টুস ছিলো, তাইনা?
আমি আর কোন কথা খুঁজে পেলামনা। "আরে বাদ দাও পুরোনো জিনিস, দোকানদার ব্যাটা একটা আস্ত ধড়িবাজ" বলে কোনমতে কেটে পড়লাম।
প্রেসক্রিপশনে আর কি কি লেখা আছে দেখছি...."একটি পুরোনো পারিবারিক এ্যালবাম"। তা বেশ। খুঁজে পেতে নিয়ে আসলাম একটা।
স্টুডিওর সাগর বা পর্বতের পাশে কেতাদুরস্ত হয়ে দাঁড়ানো সেসব ছবি! নিশ্চিত প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে। প্লাস্টিক।
কাগজ। অতঃপর মানুষ। আমাদের প্রিয় মানুষ। আমাদের প্রিয় হাসি! তাই বা কম কিসে!
"দেখ দেখ, মা কি সুন্দর হাসছে!" আমি সাগ্রহে তাকে দেখাতে গেলাম।
"কোথায় মা?" আমি তো দেখতে পাচ্ছি শুধু হাড়গোড়।
আমার মাথায় রাগ চেপে গেল। এরকম ভুল কেউ বকে!
"ভালো করে দেখ, হাড়গোড় কোথায় পেলে? এই যে দেখনা, মায়ের কোলে ছোট্ট তুমি!"
"আমার চোখ মিথ্যা দেখেনা। আমি অসুস্থ্য হলেও আমার চোখটা নষ্ট হয়নি" সে সদম্ভে বলল।
"আর তুমি কখনও সুস্থ্য হবেনা এও বেশ জেনে রাখো হাহাহা! অট্টহাসি হেসে সে হূমকি দিলো আমাকে।
আরে... কি বলে!
"অসুস্থ্য তো আমি না, তুমি!" প্রতিবাদ জানালাম আমি।
"কে অসুস্থ্য সেটা খুব ভালো করেই জানা আছে আমার। অনেক হয়েছে এ অভিনয়, আর না" বলে সে গা ঝাঁড়া দিয়ে উঠলো, উঠে গেলো শয্যা থেকে।
"প্লিজ যেওনা। প্লিজ!" অনুনয় করলাম আমি।
কিন্তু সে কোন কথা বলছেনা আর।
দৃপ্তপদে এগিয়ে আসছে আমার দিকে..একসময় সে আমার মধ্যে মিশে গেলো।
*
কিছুদিন পরে আমি আবার সুস্থ্য হয়ে উঠি। অফিসে আমার ইনক্রিমেন্ট বেড়ে যায়। আমি আরো বাড়ানোর চেষ্টায় মশগুল থাকি। আর স্মৃতিনগরীতে ক্রমাগত হাঁটার ফলে হাঁটুতে যে ব্যথা হয়েছিলো সেটাও কমে গেছে।
আমার আছে জীবন্ত হাড়গোড় আর মাংস। আমি বেঁচে থাকি। আমি সুস্থ্য হয়ে উঠি..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।