আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পঞ্চম সংশোধনী বাতিল নিয়ে আপিল বিভাগ উচ্চারিত মডিফিকেশন শব্দটি কি আইনমন্ত্রীর বক্তব্যেরই প্রতিফলন?

Only I know what is my goal, My heart is my temple.

কাজী সায়েমুজ্জামান: সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কতটুকু বাতিল তা নিয়ে বিতর্ক আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকেই গেলো। সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রাথমিক আদেশে কিছুই স্পষ্ট হয়নি। দুটি পক্ষই আদেশকে মনগড়া ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষও এ আইনী বাক বিতান্ডার মধ্যে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন। তারও কিছু বুঝে উঠতে পারছেননা।

এর আগে বলা হয়েছিল, এ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হলে দেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। ৭২ এর সংবিধান পুণ: প্রতিষ্ঠা হবে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি যুক্ত হবে। দেশের রাজনীতিতেও একটি আমুল পরিবর্তন আসবে। আপিল বিভাগ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন খারিজ করে দেয়ায় পর সবার সামনে একটাই প্রশ্ন জেগেছে সামনে কি হবে।

এ আবেদন খারিজ করার মধ্যে মাহাত্ম্য কি তাও সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেনা। আদেশ নিজ পক্ষে নেয়ার প্রচেষ্টা: আদালতের আদেশের পর সরকার পক্ষ বলছে, এখন পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে অপর পক্ষের দাবি, তা করতে হলে অন্য সংশোধনীর মতোই সংসদে বিল আনতে হবে। কারণ প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চের আদেশে বলা হয়েছে- "পিটিশনস আর ডিসমিসড উইথ সাম মডিফিকেশন অ্যান্ড অবজারভেশন"। কি ধরনের মডিফিকেশন তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

এ আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, "সামগ্রিকভাবে হাইকোর্টের রায়টিই বহাল রাখা হয়েছে বলে বলা যায়। এর ফলে ভবিষ্যতে সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখল চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো। " এখন সংবিধান সংশোধন করতে হলে কী করতে হবে- জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "সংসদে বিল আনার প্রয়োজন নেই। অষ্টম সংশোধনীর ক্ষেত্রে যেভাবে সংবিধান পুনঃমুদ্রণ করা হয়েছিলো, তেমনিভাবে এক্ষেত্রেও সংবিধান পুনঃমুদ্রণ করা হবে। " অন্যদিকে আপিল বিভাগের আদেশের উদ্ধৃতি দিয়ে আপিলকারী খোন্দকার দেলোয়ারের কৌঁসুলি টি এইচ খান সাংবাদিকদের বলেন, "আমাদের যুক্তির যথার্থতা ছিলো বলেই আদালত 'মডিফিকেশন' এর কথা উল্লেখ করেছেন।

তবে হতাশার মধ্যেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কারণ আদালত উচ্চারণ করেছেন মডিফিকেশন। এ শব্দটা হতাশা থেকে মুক্তি দিয়েছে। তবে কি মডিফিকেশন হবে, তা জানি না। এখন সরকারকে সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে সংসদে বিল আনতে হবে।

দেলোয়ারের অপর কৌঁসুলি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, "আপিল বিভাগ মডিফিকেশন শব্দ উল্লেখ করায় হাইকোর্টের যে রায় তা পুরোপুরি বহাল বলা যাবে না। এ আদেশের ফলে আমাদের যুক্তির যথার্থতাও প্রমাণ হয়েছে। " তবে যে যাই বলুক না কেন আপিল বিভাগের আদেশের পুরো কপি পাওয়া গেলেই বলা যাবে পঞ্চম সংশোধনীর কতটুকু বাতিল হয়েছে। আপিল বিভাগ যা করলেন: ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিএনপি জোট সরকার আপিল করে ঝুলিয়ে রাখে।

বর্তমান সরকার গিয়ে সেই আপিল প্রত্যাহার করে। এর ফলে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে যাচ্ছে দেখে গত বছরের ২৫ মে বিএনপির মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার উদ্যোগী হয়ে আপিলের জন্য আবেদন করেন। তবে আপিল বিভাগ এ আবেদন খারিজ করে দেয়। আদেশের ফল: আপিল বিভাগের এ আদেশের ফলে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনি ঘোষণা বহাল থাকলো। পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সরকার পরিবর্তন সংবিধানসম্মতভাবে হয়নি বলেও হাইকোর্ট যে অভিমত ব্যক্ত করেছিল তাকেও সমর্থন দেয়া হলো।

কেচোঁ খুড়তে সাপ: মুলত ঐতিহাসিক এ রায়টি কেচো খুড়তে সাপ পাওয়ার মতো। শুধু পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করতে হবে-এজন্য কেউ রিটও করেনি। এক ব্যক্তির সম্পত্তি সরকার পরিত্যক্ত দেখিয়ে মালিকানা কেড়ে নিলে তার মালিক এর বিরুদ্ধে মামলা করে মালিকানা ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার বিভিন্ন টালবাহানা করেও মালিকানা রাখতে ব্যর্থ হলে সামরিক শাসনের ফরমানের আশ্রয় নেয় মালককে বঞ্চিত করে। আর ফরমানকে স্থায়ী করতে তা সংবিধানের অংশ করে।

আর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই এটি সংবিধানের অংশ হয়ে যায়। আদালত ওই সম্পত্তির মালিকানা ফেরত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চম সংশোধনীও বাতিল করে। আসল কাহিনী রাজধানীর ১১নং ওয়াইজ ঘাটের মুন সিনেমা হলটি ইটালিয়ান মারলেন ওয়ার্ক কোং লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদ আলমের মালকানাধীন ছিল । ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখমুজিবের শাসনামলে সরকারি আদেশের মাধ্যমে এ হলটিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সরকার এ সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে তা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রের নামে বরাদ্দ দেয়।

বরাদ্দ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সম্পত্তির দখল স্বত্ত্ব বুঝে নেয়। ১৯৭৪ সালে মাকসুদ আলম এ সরকারি আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত তার পে সিনেমা হলসহ সম্পত্তির মালিকানা ঘোষণা করেন। তবে আদালতের ডিক্রি পেয়েও মাকসুদ আলম তার জমির মালিকানা বুঝে নিতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের পর মাকসুদ আলম আবারো সম্পত্তির দখল স্বত্ত্ব বুঝে নেয়ার জন্য আদালতে রিট করেন।

১৯৭৭ সালে রিটের নিষ্পত্তি শেষে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ আবেদনকারীর পে রায় দেন। তিনি হলটির মালিকানা মাকসুদ আলমকে বুঝিয়ে দিতে আদেশ দেন। তবে ১৯৭৭ সালে সরকার সামরিক শাসনবিধি ঘোষণা করে যার ৭ ধারায় এ ধরনের সম্পত্তির মালিকানা ফেরত না দেয়ার আইন করা হয়। এ ফরমানে উল্লেখ করা হয় আগে সরকারি আদেশের মাধ্যমে যেসব সম্পত্তি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত করা হয়েছে, সেসব সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে কেউ মামলা করতে পারবে না। আদালত কারো পে ডিক্রী জারি করলেও তা কার্যকর হবে না।

পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে উক্ত ফরমানকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর কারণেই মাকসুদ আলম মুন সিনেমা হলের দখল স্বত্ত্ব বুঝে নিতে পারেননি। মুন সিনেমার মালিকপক্ষ পরে ১৯৯৪ সালে এই রেগুলেশনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ফের রিট আবেদন করেন। তবে আদালত পঞ্চম সংশোধনীর আওতায় সব সামরিক রেগুলেশনের বৈধতা আদালতের চ্যালেঞ্জের আওতাবহির্ভূত বিবেচনা করে আবেদনটি খারিজ করেন। মাকসুদ এ আদেশেও দমে যাননি।

এবার তিনি ২০০০ সালে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে তিগ্রস্ত হয়েছেন উল্লেখ করে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রীট মামলা দায়ের করেন। ওইদিনই হাইকোর্ট সংবিধানের ৫ম সংশোধনী ও এর আওতাধীন সকল ফরমানের বৈধতার প্রশ্নে সরকারের প্রতি রুলনিশি জারি করেন। দীর্ঘ ৫ বছর পর ২০০৫ সালের মে মাসে এ রুলের ওপর শুনানি শুরু হয় এবং জুলাই মাসে এ রিটের শুনানি শেষে ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ অভিমত দেন, ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেনারেল জিয়ার দায়িত্বগ্রহণ সংবিধান বহির্ভূত এবং অবৈধ, একইভাবে জেনারেল জিয়ার গণভোট সংবিধানের আওতার বাইরে। এসময় সরকারের প্রতি ২২ দফা নির্দেশনাও দেয় আদালত।

কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে ওই রাতেই চেম্বার জজের বাসায় গিয়ে মৌখিক আবেদনে তৎকালীন এ্যাটর্ণী জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী তা স্থগিত করান। দুই দিন পর ৩১ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া রায় দুই মাসের জন্য স্থগিত করেন। একইসঙ্গে আদালত এ সময়ের মধ্যে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপীল দায়ের করার জন্য এটর্নি জেনারেলের প্রতি নির্দেশ দেন। ওই সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন মোদাচ্ছের আলী। মজার বিষয় হলো এজে মোহাম্মদ আলী এ মামলার শুনানিতে একসময় বাদী মাকসুদ আলমের পে অংশ নিয়েছিলেন।

তিনি ওই সময় মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। তবে এটর্নি জেনারেল হওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে নিজেই নিজের বিরোধিতা করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মতায় এসে বিএনপি সরকারের করা আপিল তুলে নিতে আদালতে আবেদন করে। গত ৩ জানুয়ারী আদালত সরকারের আবেদন মঞ্জুর করে। পাশাপাশি হাইকোর্টের স্থগিতাদেশও স্থগিত করে।

তবে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং জামায়াতে ইসলামী সমর্থক তিন আইনজীবীর দায়ের করা অপর দুটি 'লিভ টু আপিল' আবেদনের শুনানির জন্য তাদের কৌঁসুলিরা সময়ের আবেদন করায় পঞ্চম সংশোধনী সংক্রান্ত মামলার অবশিষ্ট আপিল আবেদনের শুনানির অনুমতি দেয়া হয়। অবশেষে গত ২ ফেব্রুয়ারী সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এসব আপিলের আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চের আদেশ দেন। এর ফলে ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট দেওয়া হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকলো। মডিফিকেশন শব্দটি কি আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন? কয়েকদিন আগে আইনমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন,আদালত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেও ওই সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল হবেনা।

যেমন সংবিধানের শুরুতে বিস্মিল্লাহির-রহমানির রহিম শব্দটি অপরিবর্তিত রাখা হবে। অথচ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই এই বিসমিল্লাহ অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ৩৮ নং অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে সংঘ বা সমিতি গঠনের যে স্বাধীনতা আছে তা পরিবর্তিত হয়ে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ হচ্ছে। এছাড়াও সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদ পুনঃবহাল হবে। এ ধারা ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে।

এখন প্রশ্ন হলো আপিল বিভাগের মডিফিকেশন শব্দটি আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিফলন কিনা তা সময়ই বলে দেবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।