আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিবন্ধি বাসনার বোঝা বইবে কে ?



প্রতিবন্ধি বাসনার বোঝা বইবে কে ? নিজের শরীরটাই যার পাহাড় সমান বোঝা । দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেনি যে কোনদিন । এমনকি কারো সাহায্য নিয়ে সোজা হওয়ার সাধ্যও হয়নি। হামগুড়ি দিয়ে মাটিতে বুক ঠেলে ঠেলে যার এগিয়ে চলা- সে আজ বহন করছে এই সমাজের নিষ্ঠুরতার ভার ? তখন শরীরটা ভাল ছিল না বাসনার। সারা গায়ে পানি ,ফোলা।

বমি বমি ভাব ও জ্বর লেগে থাকত গায়ে। খেতে ভাল লাগত না। ঘুমও ছিল না চোখে। দিন-রাত মাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে চাইতো। মেঝেতে পাতানো চাটাইটাতে গড়াগড়ি করারো শক্তি ছিল না গায়ে।

কোন কিছু অতটা না বুঝলেও এ কষ্টের কারন সে বুঝতে পারতো । তাই মা সেলিনা বেগম মেয়ের যন্ত্রনা দেখে যখন বলতেন, জন্ম হলে বাচ্চাটা কাউকে দিয়ে দিবেন তখন বাসনা খুশি হয়ে কষ্ট ঠেলে হাসতো। এতটুকুর বেশী সে বুঝতে পারে না , তবে এ যন্ত্রনা আর থাকবে না ভেবে একটু প্রশান্তি পেত। যে যন্ত্রণা তাদের সমাজে ধিকৃত করেছে, মৃত্যুর ঝুকি ও দুঃশ্চিন্তা তাড়না করে প্রতিনিয়ত, তাকে চায় না তারা । কিন্তু কিভাবে ? বাসনা তখন ৯ মাসের অন্ত:সত্তা।

স্বাস্থ্যকর্মী এসে জানিয়েছেন অল্প বয়স ও শারিরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় সন্তান প্রসবের সব ধরনের ঝুঁকি তার মাথায়। তবুও চিকিৎসা-ঔষধ কিছূই জোটে নাই । আর এই মৃত্যু ঝুঁকিতেও সন্তান প্রসব হয়েছে বাড়িতে। বাবা বাতেন অবশ্য মনে মনে দোয়াই করেছেন বাসনা ও তার সন্তান যেন না বাঁচে। এত কষ্ট আর দেখতে চাননি বলে।

তা ছাড়া বাচিয়ে রাখারও তো সামর্থ লাগে, যা বাতেনের নাই। বাসনা শারিরিক ও মানষিক প্রতিবন্ধি একটি কিশোরী মেয়ে। আজ সন্তানের বোঝা (অবৈধ) নিয়ে সে আর নড়তেও পারে না। অথচ সেই সন্তানের জন্মদাতা আব্দুল জলিল (৫৫) সমাজে অধিষ্ঠিত আছেন। আর বাসনার অসহায় মা-বাবা ন্যায় বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

বাসনার বাড়ী রাজার হাটের ঘড়িয়ালডাঙ্গার চেতনা গ্রামে। বাবা বাতেন রিক্সা চালক । একটি র্দূঘটনায় বাতেন মিয়ার বুক ও পাজরের কয়েকটা হাড় ভেঙ্গে গেছে। অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি রিক্সা চালান। তাই তিন মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে পাঁচ জনের সংসার চালানো তার পক্ষে দায় ।

বাসনার মা সেলিনা নিজের ও সন্তানদের পেট ভরানোর জন্য বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে কাজ করেন । সন্তানদের মধ্যে বড় বাসনা শারিরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধি । দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে অবশ নিয়ে জন্ম হয়েছে তার । শরীরের সাথে তাল মিলিয়ে পা দুটো বাড়তে না পেরে মাছের পাখনার মতো হয়ে গেছে। চলাফেরা বলতে হামগুড়ি দিয়ে কোমর থেকে ছেঁচড়ে চলা।

সহজ সরল কথা ছাড়া তেমন কিছু বুঝতে পারে না। কখনো কান্না তো কখনো হাসি। এর মাঝামাঝি থাকতে পারে না সে। গোসল করা , পায়খানা-প্রস্রাব করে পানি নিতেও মায়ের সাহায্য ছাড়া তার চলে না। ছোট দুই বোন রওশন ও রুমা স্বাভাবিক ।

তারা চলে, খেলে। আর ' বাসনার শুধু ক্ষিদে পায়, সবার চেয়ে অনেক বেশী। ভাত, নয়তো অন্য কিছু । খেতে দিতেই হয়। না দিলে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়।

তাই বাবা মায়ের কষ্ট বেড়ে যায় তার খাবার জোগাতে। কাজের খোঁজে বাবা মা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায় । ফাঁকা বাড়িতে পড়ে থাকে বাসনা। বাড়ীর তালা বদ্ধ ঘরের দরজার সামনে বসে মাটিতে লুটোপুটি করে সারাদিন কাটে বাসনার। এই সুযোগে প্রতিবেশী আব্দুল জলিল বিস্কুট - চকলেটের লোভ দেখিয়ে তার সাথে শারিরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে ।

পাচঁ সন্তানের জনক জলিল ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এক পর্যায়ে বাসনা গর্ভবতি হয়ে পড়লে ঘটনাটি জানাজানি হয়। তখন বাসনা জলিলের সাথে তার শারিরিক সম্পর্কের কথা জানায়। গ্রাম্য সালিশীতে জলিলও স্বীকার করে বাসনাকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে সেখান থেকে চলে যায়। অদ্যবধি আর কোন খোঁজ নেয়নি।

“তোমার ব্যাগে কি খাওয়ার কিছু আছে ? মোক(আমাকে) কিছু দিবেন ? খুব ভোক(খিদে) নাইগছে (লেগেছে) কিছুটা অস্পষ্ট ভাষায় নিজের মতো করে কথাগুলো বলে বাসনা। তার বাড়ী গেলে প্রথমে সে ভয় পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। অভয় দিয়ে কাছে গিয়ে কথা বললে প্রথমেই সে খাবার চেয়ে হাত বাড়ায়। বাড়িতে লোক এসেছে খবরে পড়শির বাড়ী থেকে ছুটে আসে মা সেলিনা। ধমকে দেয় বাসনাকে।

বলে, ‘খালি (শুধু) খাই খাই করা , ভোক ভোক (খিদে খিদে) করে আজ ওর এই দশা তবু এতো খাই খাই । বাড়ীর সবাই একবেলা খাইলেও ওকে দুইবেলা খাওয়াই। তাও ওর ভোক আর ভোক । ওরে পেটের ভাত জোটাতে পারি না কোলের বাচ্চাটার খাবারো জোগাতে হয়। ’ তিনি আরো বলেন, ‘অভাবের সংসারে আমাকে সারাদিন নানা জায়গায় কাজ করতে যেতে হয়।

বাসনা নিজেই চলতে ফিরতে পারে না ,তার উপর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়া সারাদিন এভাবে পড়ে থাকে। ’ মাটিতে পড়ে কেঁদে কেটে মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়ে মা ও শিশুটি। ঝড়-বৃষ্টি-রোদেও করার কিছু থাকে না। বাসনার বাবা বলেন, “ আইনি আশ্রয়ের জন্য কাজীর কাছে বিয়ে রেজিস্ট্রির নকল চাইতে গেলে তিনি দিতে রাজী হননি। ” তিনি আরো বলেন, “জন্মের পর থেকে বাচ্চাটাকে পোষ্য দিতে চাইছি কিন্তু অবৈধ সন্তান বলে কেউ নেয় না।

” প্রতিবেশী আকবর আলী জানান, “শালিসিতে জলিলকে শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে। ” আব্দুল জলিলের বাড়িতে গেলে তিনি কোন কথা বলতে রাজী হন নি। তবে তার স্ত্রী ঘটনাটির ব্যাপারে জানায়, আমার স্বামীর রুচির কথা ভেবেই আমার ঘৃণা লাগে। এ ব্যাপারে স্থানীয় কাজী মতিয়ার পাটোয়ারী বলেন, বাসনার বয়স কম ছিল কিন্তু সালিশীর মাধ্যমে বিয়ের সিদ্ধান্ত হলে আমি রেজিস্ট্রি করি। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী বিয়ে না হওয়ায় আমি কোন কাগজ দিতে পারিনি।

ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস প্রামানিক বলেন, সালিশীর মাধ্যমে বিষয়টি মিমাংসা করে দেয়া হয়েছে। তবে বাসনার দুর্ভোগের ব্যাপারে তিনি জানেন না বলে জানান।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.