প্রতিবেদন:
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের দুই বছর
দেনার দায়ে জর্জরিত জেলেদের মানবেতর জীবনযাপন
এম জসীম উদ্দীন, বরগুনা | তারিখ: ২২-১১-২০০৯
সূর্যটা তেজ হারিয়ে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। উত্তুরে ফুরফুরে বাতাস। ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছিল। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর তীরের জেলে অধ্যুষিত গ্রামগুলোয় মনে হয়, একটু আগেই শীত আসে। পদ্মা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিমে এগোতেই চোখে পড়ে অসংখ্য খুপরি।
এগুলো কোনো বেদেবসতি নয়। ঘূর্ণিঝড় সিডরে বিধ্বস্ত হওয়ার দুই বছর পরও তাঁদের ঘর তোলার সামর্থ্য হয়নি। চারপাশে শুধু ছেঁড়া সংসারে মানবেতর জীবনযাপনের দৃশ্য। নারকেলপাতা, পলিথিন, তালপাতা, খড়-কুটো দিয়ে ছাপড়া বানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর নদের জেলে অধ্যুষিত গ্রাম পদ্মায় গিয়ে এমন অসংখ্য মলিন চেহারা চোখে পড়ে।
শুধু পদ্মা নয়—লাগোয়া রুহিতা, জিনতলা, হাজিরখাল, হরিণবাড়িয়া, চরলাঠিমারা, জ্ঞানপাড়ায় গিয়ে এমন অসংখ্য পরিবারের হতশ্রী অবস্থা দেখা যায়। এই গ্রামগুলোতে বাস করে ১০ হাজারের বেশি পরিবার। যাঁরা পেশায় জেলে। ঘূর্ণিঝড় সিডরে তাঁদের ঘরদোর আর জীবিকার বাহন নৌকা, ট্রলার, জাল সব শেষ হয়ে গেছে।
দিনভর গ্রামগুলো ঘুরে হতাশার চিত্র দেখা গেলেও পাশাপাশি বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কঠিন সংগ্রামের দৃশ্যও চোখে পড়ে।
পদ্মা গ্রামের জেলে আবদুল আলীম জানান, তাঁর দুটি ছোট্ট ট্রলার ছিল, যা সিডরে ভেঙে গেছে। ভেঙে যাওয়া ট্রলারের ধ্বংসাবশেষ কুড়িয়ে এনে এক বছর পর একটা ট্রলার তিনি ঠিক করে পানিতে ভাসিয়েছেন। এ জন্য তাঁকে ঋণ নিতে হয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর আগের মহাজনী দাদন আছে এক লাখ টাকা। সব মিলিয়ে তাঁর ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এই ঋণের অনুকূলে মাসে তাঁকে সুদ গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা।
চড়া সুদে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে একইভাবে নৌকা-জাল তৈরি করেছেন পদ্মা গ্রামের মিজান, রুহিতার জয়নাল, হাবিব, ফারুক সরদার, বেলায়েত মোল্লা, কামালসহ অনেকে। তাঁরা জানান, সরকারি-বেসরকারি কোনো সহায়তা তাদের ভাগ্যে জোটেনি। পদ্মা ও আশপাশের গ্রামের কয়েক হাজার জেলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছেন দিন-রাত। আর এতে আবার মুখর হয়ে উঠেছে গোটা এলাকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, বলেশ্বর তীরের মত্স্য ঘাটগুলোতে অসংখ্য ইঞ্জিনচালিত নৌকা মাছ ধরে কিনারে ফিরছে। জেলে আর পাইকারদের মধ্যে মাছ বেচা-বিক্রি নিয়ে কথাবার্তা চলছে। আবার কেউ নৌকা-ট্রলার মেরামত করছে। নিঃস্ব এসব মানুষের সাহস, সংকল্প আর সংগ্রামের চিত্র অবিশ্বাস্য। জেলে আবু জাফর বলেন, ‘মোগো বাঁচা মোগোই বাঁচন লাগবে।
সব গ্যালেও মোগো শরীলডা আছে, শরীলে শক্তিও আছে। দেইখেন আবার মোরা মাজা তুইল্লা খাড়ামুই। কেউর সাহায্য লাগবে না’।
বঙ্গোপসাগর তীরের তালতলী থানার নিদ্রা, সখিনা, নলবুনিয়া, জয়ালভাঙা, তেতুলবাড়িয়া, ফকিরহাট এলাকায় গিয়েও জেলেদের কঠোর জীবন-সংগ্রাম আর মানবেতর দিনযাপনের দৃশ্য চোখে পড়ে।
তেতুলবাড়িয়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ আ. রহমান বলেন, ‘বাবা সিডরে আমারে এমন নিঃস্ব করছে যে, বাঁচনের উপায় নাই, পোলাডায় (সরোয়ার) মাসে দেড় হাজার টাকা বেতনে মানষের নৌকায় মাছ ধরে, হেই দিয়া ছয় জনের সংসার চলে।
নিজের জাল-নৌকা সব সিডরে গ্যাছে, হ্যার পর আর গড়াইতে পারি নাই’।
জয়ালভাঙার জেলে আশরাফ আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘সিডরে সব গ্যালহে হ্যারপর একটু যেই কোমর সোজা করছি, তহনই আবার আইলায় দেছে মাজা-কোমর ভাইঙ্গা। এহন ক্যামনে যে আবার খাড়ামু কইতে পারি না। ’
তালতলী থানার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী তেতুলবাড়িয়া, নলবুনিয়া, জয়ালভাঙা, মরা নিদ্রা, খোট্টারচর, ফকিরহাট, আঙ্গারচর, মৌপাড়া জেলে পল্লী ঘুরে মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশার দৃশ্যই কেবল চোখে পড়ে।
জেলা মত্স্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বরগুনা জেলার জেলেদের সহায়তার জন্য ৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল।
কিন্তু দুই বছরেও সে প্রস্তাবের অনুকূলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পাথরঘাটা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘অধিকাংশ জেলে নিজেদের চেষ্টায় আবার কাজে ফিরতে পারলেও তাঁদের কাঁধে যে ঋণ চেপেছে, তা শোধ করে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে এমন ধারণা করা যায় না।
পাথরঘাটা জেলে সমিতির সভাপতি দুলাল মাস্টার বলেন, ‘জেলেদের দুর্দশার সীমা-পরিসীমা নেই। ’
জেলা মত্স্য কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডু বলেন, ‘মূলত সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা সরকারি-বেসরকারি তেমন কোনো সহায়তা পায়নি। কিছু বেসরকারি সংস্থা সহায়তা দিয়েছে, তবে সেসব বিষয়ে আমরা অবহিত নই, যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্নভাবে।
’
(প্রথম আলোতে গত ২২ নভেম্বর -২০০৯ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।