আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নামে যা যায় আসে

কবিতা লিখি, প্রবন্ধ লিখি, গল্প লিখি, রম্যরচনা লিখি, মানে লেখার চেষ্টা করি আর কী!

সহকর্মী হিল্লোল সবে বাবা হয়েছে। বলল, দাদা, আপনি তো লেখালিখি করেন, আমার ছেলের জন্যে একটা ভালো নাম ঠিক করে দিন না। বললাম, তোমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখো, ‘কল্লোল’। ‘দাদা, আমার জ্যাঠতুতো দাদার নাম কল্লোল, আর তার সঙ্গে মিলিয়েই আমার নাম...’, জানায় হিল্লোল। প্রায় দুম করে বলে ফেলেছিলাম, তবে নাম রাখো, ‘এগরোল’।

বহু কষ্টে হাসি আর মুখ সামলে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলাম। নাম নিয়ে এমনতরো অনেক মজা ছড়িয়ে রয়েছে এদিক-ওদিক। আমার বাবার মুখে শুনেছি, সেকালে মেয়েদের জন্যে বরাদ্দকৃত নাম রাখা হত ছেলেদের। হাতে গরম ফলাফল, বাবার জেঠুর নাম ‘অপর্ণা বোস’, বাবার এক দাদুর নাম ‘হৈমবতী’ এবং তাঁর স্ত্রীর নাম ‘সন্তোষকুমারী’। খুব বিপদে ছিলেন/আছেন আমার মা।

আমার জেঠুর নাম ‘গৌরাঙ্গ’, ফলে মা ‘নিতাই বলো’ বললেও ‘গৌর বলো’ এড়িয়ে যেতেন/যান। একটু বড় হবার পর আমি মা’কে পরামর্শ দিয়েছিলাম, ‘ভাসুর বলো’ বলার। মা’র সম্ভবত এই টোটকাটা পছন্দ হয়নি ফলে গৌরাঙ্গদেব আজও তাঁর প্রার্থনা থেকে বঞ্চিত। আমি নিজেও বহুদিন পর্যন্ত প্রয়াত বিধায়ক/মন্ত্রী শান্তি ঘটক এবং রাধিকা ব্যানার্জীকে মহিলা বলেই জানতাম। ‘কাজল’ বা ‘অপু’ এই জাতীয় নামগুলো স্ত্রী, পুরুষ দুটো দিক সামলে চললেও বিবাহোত্তর দিনগুলোতে কখনও কখনও কিছু পরিবারে অম্লমধুর ঝগড়ারও যোগান দেয়।

আমার বন্ধু সুপ্রতীক আর তনয়ার ছেলে হলো, লোকে বলল, দুজনের নাম মিলিয়ে নাম রাখো ছেলের। চিন্তিত সুপ্রতীক ধরল আমায়, কী নাম রাখা যায় বলতো? বললাম, দুজনের নামের প্রথম অক্ষর ধরে নাম রাখ ‘সুতরাং’। ক্ষিপ্ত সুপ্রতীক এরপর বলেছিল, পরে মেয়ে হলে তার নাম কী রাখব, সেটাও বলে দে। অম্লান বদনে বলেছিলাম, তখন ছেলের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখিস, ‘অতএব’। আমরা বাবার অফিস কোয়ার্টার্সে থাকতাম।

বন্ধু-বান্ধব সবার বাবা একই অফিসের, সকলের অফিস টাইমও এক। ১২১ নম্বর কোয়ার্টারের সেনকাকু সবচেয়ে দেরীতে অফিস বেরোতেন। আমরা তাঁর নাম রেখেছিলাম, ‘লাষ্ট ট্রেন’। তো, সেই ‘লাষ্ট ট্রেন’এর ছিল, সাত-সাতটা মেয়ে, কোনও ছেলে ছিল না। আমাদের তৎকালীন আড্ডায় খুব স্বাভাবিক কারনেই বারবার উঠে আসত সেনকাকু আর তাঁর পরিবার।

আমরা খুব চিন্তায় থাকতাম, এক বাড়িতে এতগুলো লোক, সবাই ঠিকঠাক বাড়ি ফিরেছে কিনা, এটা সেনকাকু কী করে বুঝতেন। এই বিষয় নিয়ে বড় তেঁতুল গাছের নীচে আমাদের একাধিক মিটিং হয়েছিল। বেশ কয়েকটা মিটিংয়ের পর আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌছেছিলাম, যে রাতে যদি দেখা যায় এক বা একাধিক বালিশ খালি পড়ে আছে, তবে ধরা পড়ে যাবে ব্যাপারটা। আমাদের মিটিংয়ে আরেকটা বিষয় ছিল আলোচনার জন্যে। অতগুলো লোকের ব্রেকফাস্ট এবং তার বিলি ব্যবস্থা কীভাবে সম্পন্ন হয়।

আমরা সক্কলেই একমত হয়েছিলাম, যে সকালবেলায় সেনকাকীমা মেয়েদের একটা করে স্লিপ ধরিয়ে দেন এবং সেগুলো দেখিয়ে মেয়েরা খাবার সংগ্রহ করে। তবে মেয়েদের নাম রাখার ব্যাপারে কাকু (এবং কাকীমা) খুব বুদ্ধিমত্তা দেখিয়েছিলেন। মেয়েগুলোর নাম, ইন্দিরা, মন্দিরা এইভাবে মিলিয়ে রাখা ছিল। ফলে নামগুলো নামতার মতো ওনাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। মানে এখানে আমাদের কোনও নাম বিভ্রাটে পড়তে হয়নি।

তবু, তবু, আমাদের এক বন্ধু আদর করে একদম ছোট মেয়েটার নাম রেখেছিল, ‘ল্যাজা’ (না, বড় মেয়েটার নাম কেউ ‘মুড়ো’ রাখেনি)। আর ছিল আমার দুই বন্ধু শঙ্কর আর সোমনাথ। প্রথমজনের পেটটা ওই বয়েসেই এতটা ফোলা ছিল, যে তার নাম হয়ে যায় ‘টায়ার’ এবং অন্যজন ক্রিকেট মাঠে নিজের তৈরী করা ষ্টাইলে ব্যাট ধরার ভঙ্গির জন্যে বিখ্যাত হয়ে যায় ‘হানড্রেড’ নামে। সবচেয়ে মজার কথা, দুজনেই নিজেদের পিতৃদত্ত নামগুলো ভুলে গিয়ে ওই দুটো নামকেই আগলে ধরে। ফলে, প্রায়ই আমরা শুনতে পেতাম, ‘অমুকটা না করতে পারলে আমার নাম টায়ার/হানড্রেড না।

হ্যাঁ আজও দেখা হলে ওদের ওই নামেই ডাকি। জানি না, ওদের ছেলেমেয়েরা ওদের এই উপাধিগুলোর খবর রাখি কিনা। আমার আরেক বন্ধুর বাবার নাম ছিল ‘শ্রীদাম কর্মকার’। একবার আমরা দুজন তখন সেলুনে চুল কাটানোর লাইনে, ওখানে উপস্থিত একজন বয়স্ক ভদ্রলোক হঠাৎ বাংলা সিনেমার পুরোনো অভিনেতাদের নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল।

বললাম পুরোনো দিন মানে তো, দুর্গাদাস, ছবি বিশ্বাস, প্রমথেশ বড়ুয়া, ‘শ্রীদাম কর্মকার’ এঁরাই। ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, যথার্থ বলেছ তুমি। আমার বন্ধুর মুখ তখন রাগে লাল। উত্তেজিত ও আমার বাবার নাম নিয়ে বলেই ফেলল, কেন উনি? আমি সময় নষ্ট না করে বলে দিলাম, উনি তো সুরকার ছিলেন। ভদ্রলোক এবারেও বললেন, হ্যাঁ উনি ভালো সুরকার ছিলেন।

এরপর আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সেই বন্ধুর গালাগাল, ইত্যাদি। সেকাল থেকে একালে এসে সেদিন অরকূটে একজনের ব্যক্তিগত সংগ্রহে দেখি এক অনবদ্য ছবি। কলকাতার এক বড় শপিং মলের সিঁড়ির কাছে বড় বড় করে লেখা, কেনাকাটা করে দ্রুত মলত্যাগ করুন। শোনা যায় অমনটা পড়ে কেউ একজন সিঁড়ি থেকে পড়ে যান এবং তাঁর পা মচকে যায়। এও শোনা যায় ওই ‘সিঁড়িয়াস’ ঘটনার পর তাঁর এখন ‘পায়ে হলুদ’ পর্ব চলছে।

তা বাপু, অমন নাম রাখার কী দরকার যা ত্যাগ করতে গেলে...। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.