"আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে কর জয়" "জ্ঞান অপেক্ষা কল্পনা শ্রেয়"
বাইসাইকেল বা সংক্ষেপে বাইক কিনার পর প্রথম লম্বা রাইড দিয়েছিলাম সোনারগাঁ দেখতে যেতে- মোট ৭১কিমি ছিল তা। রাইডটা ছিল গত বছর ডিসেম্বরের দিকে খুব সম্ভবত। আর তারপর দীর্ঘ ৮ মাস কোন লম্বা রাইড দেই নাই। বাসার আশে পাশে যাতায়াতের কাজ সারতাম। বর্ষায় তাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
যাই হোক অনেকদিন পর গত ২২/২৩তারিখে দিকে প্রনব ভাই (বুয়েট'০৯, কেমি) জানালেন পূবাইল যাচ্ছেন ওনারা ৪ জন- আমি চাইলে যাইতে পারি। জানালাম যে নিঃসন্দেহে রাজি। যথাদিন মানে ২৫ তারিখ আসল। জুনিয়র তানভির (বুয়েট'১২, মেকা) সকাল ৫.৩০ এর দিকে জানালো সে হাজির বুয়েটে। সকাল ৬টার দিকে মিলনস্থল-বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে হাজির হল আমার ক্লাসমেট ত্রিশু (বুয়েট'১১, মেকা) আর ভাইয়ারা ৪জন- নাফি ভাই, অনিক ভাই, সুদিপ্ত ভাই আর প্রনব ভাই- সবাই বুয়েট'০৯ ব্যাচের।
পৌনে সাতটার দিকে শুরু হল রাইড। পলাশী মোড় হয়ে হাতিরপুলের সামনে দিয়ে সার্ক ফোয়ারার সামনে এসে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে উঠলাম। যেতে যেতে আমাদের প্রথম ব্রেক নিলাম আমরা এয়ারপোর্টের একটু পরে। কলা-কেক হল আমাদের বিরতিকালীন নাস্তা। এরপর আবার চলা শুরু এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই টঙ্গিতে পৌছলাম এবং টঙ্গি ফ্লাইওভার এর উপর নেওয়া হল আমাদের দ্বিতীয় বিরতি।
এইবারের বিরতি ছবি তোলার বিরতি।
আবার আমাদের চলা শুরু। তবে এখানে বলে রাখি যে এতক্ষন সবার সাথে তাল মিলিয়েই চালাচ্ছিলাম কিন্তু ফ্লাইওভারে উঠে সব তেল বের হয়ে গেসে- সো সাইকেলও আমার ধীর হয়ে আসতে শুরু করল। যাইহোক চলা শুরু। যেতে যেতে মাজুখান ব্রিজ আসলো।
ব্রিজ পেরিয়েই হাতের বামে যে রোডটা পড়ে তাতে আমরা ঢুকে পরলাম এবং মিনিট ১৫ এর মত রেস্ট নিলাম সবাই। কি জানি একটা ফুলকে ধুতরা ফুল বলে উপাধি দিয়ে আবার আমাদের যাত্রা শুরু। এইবার আর থামাথামি নাই। একেবারে পূবাইল- মীরের বাজার চৌরাস্তায় এসে থামলাম। এখানে এসে প্রনব ভাই জানালেন যে তার বাড়ি হল হাতের ডানে যে "ঢাকা বাইপাস" আছে তা দিয়ে ২০কিমি এর মত দূরে- আমরা যাইতে চাই কিনা।
যাওয়ার সুবিধাও জানালেন যে গিয়ে গোসল টোসল করে ঘুম দিয়ে নেওয়া যাবে। আমরাও রাজি হয়ে গেলাম। ভাবলাম কত আর আর হবে- বড় জোর এক/দেড় ঘন্টার সাইক্লিং। মীরেরবাজারে বিশাল পরটা দিয়ে ডিম আর ডালভাজি মেরে দিয়ে যাত্রা শুরু আবার আমাদের। আর বলা বাহুল্য যে এসব খানাপিনার স্পন্সর আমাদের বড়ভাইরা- কারন আমরা বুয়েটিয়ানরা বিশ্বাস করি বড়ভাইদের সাথে ঘুরতে গেলে (ঘুরতে গেলে বলসি কিন্তু- অন্য সময় পরিস্থিতি বুঝে কারন তাদের পকেটও ভবানি হইতে পারে) নিজেদের পকেটে হাত দেওয়া তো দূরে কথা- মানিব্যাগ আনাও হারাম! শুরু হল যাত্রা।
শুরুতেই বলে রাখি এই যাত্রার কথা আমার মেলা দিন মনে থাকবে। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই- রাস্তা আর শেষ হয় না! একটু পর প্রনব ভাই জানালেন যে উনি ভুল বলেছেন- রাস্তা আসলে ৩৫ কিমি। অলরেডি বুয়েট থেকে ৩৫কিমি মেরে দিসি- আরো ৩৫! আল্লাহর নামে আবার প্যাডেল মারা শুরু। আমার অবস্থা আস্তে আস্তে কাহিল হইয়া যাইতেসে। সবাই সামনে গিয়ে আমার জন্য ওয়েট করে।
যাই হোক নিজের ব্যর্থতার কথা আর নাই বলি। পথিমধ্যে কোন একটা ব্রিজে উঠার সময় ঢালে অনিক ভাই পড়ে গিয়ে পায়ে অল্প ছিলে ফেললেন। তারপর আবার আমাদের প্যাডেল মারা শুরু। মাঝে একবার একবাড়ির সামনে থেমে বোতলে পানি ভরে নিলাম সবাই। পানি নিয়ে পুরা ট্যাঙ্কিই খালি করে দিলাম আমরা।
প্রনব ভাই আবার জানালেন যে এবারও উনি ভুল ধারনা করেছেন- দূরত্ব আরও ৫কিমি বেশি মানে ৪০কিমি। আমি চোখে সরিষাফুল দেখা শুরু করলাম। একে তো কাউয়া-মরা-রোদ তার উপর এতখানি পথ আমি অনেকদিন চালাই না সাইকেলে। সো সবার থেকে পিছিয়ে পরতে লাগলাম। কিন্তু এবার থেকে ভাইয়াদের কেউ না কেউ আমার সাথে সাথে থাকলেন।
অবশেষে এল ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে। প্রনব ভাই এবার জানালেন- আর মাত্র(!) ৫কিমি দূরে তার বাড়ি। প্যাডেল মারা is continued again। এই ৫কিমি আর শেষ হয় না। যেতে যেতে একবার জিজ্ঞেস করলাম যে আদৌ তার বাড়ি এদিকে কিনা নাকি হুদাই নিয়া আসছেন।
অবশেষে (অবশেষে আবার বলি- আবার বলাটা আসে) অবশেষে সাড়ে ১১টার দিকে দীর্ঘ ৬০কিমি পেরিয়ে বাড়িতে পৌছলাম। আসলে মীরের বাজার থেকে ২০কিমির মতই দূরত্ব- কিন্তু ক্লান্তি আর রোদের কারণে দূরত্ব বেশী মনে হয়েছে।
প্রথমেই বলি- প্রনব ভাই এর বাড়িটা শিরাম। ঝকঝকে তকতকে বাড়ি। গাছগাছালির ছায়ায় ঠান্ডা একটা পরিবেশ।
ঢুকেই সবাই টপলেস মানে গেঞ্জি- শার্ট খুলে ফ্যানের নিচে ঠান্ডা হউয়া শুরু করলাম। একেকজনের চেহারা রোদে তেতে লাল হয়ে আছে। সবাই প্রকৃতির সাথে কথা বলতে আর হাতমুখ ধুতে বাথরুমের সামনে লাইন দিল। তানভির পিচ্চি আগের রাত ঘুমায় নাই। So পোলায় আক্ষরিক অর্থেই হেইলা পইড়া গেল বিছানায়।
বাকিরা আমরা ঠান্ডা ফ্লোরে যে যেদিকে পারলাম শয়ন-অবস্থান নিলাম। আর এদিকে শুরু হয়ে গেল- আন্টির রান্না আর টিভিতে বঙ্গ দেশীয় চলচ্চিত্র দর্শন। আধা/পৌনে একঘন্টার মত সময়ের পরে সবাই আবার বাথরুমের সামনে লাইন দিল। এবার গোসলের জন্য। ইতোমধ্যে প্রনব ভাই আর উনার আম্মা আপ্যায়নের চূড়ান্ত করেছেন।
আমার মাথাব্যাথা করতেসিল। ঘরে প্যারাসিটামল নাই বলে প্যারাসিটামল আর অনিক ভাই এর পা এর ছিলে যাওয়া অংশের জন্য ব্যান্ডএইড প্রনব ভাই ঝড়ের মত কোন ফাকে যে নিয়ে আসলেন টেরই পেলাম না। আর আন্টি এদিকে রান্নার ফাঁকে আমাদের কে শরবত-বিস্কুট দিয়ে গেলেন। যাইহোক গোসল শেষ। সবাই ফ্রেশ হয়ে বাংলা সিনেমা দেখা কন্টিনিউ করলাম।
যথাসময়ে রান্নাও শেষ। বলার মত অংশ হল- কই মাছের কাটা বাছার ঝামেলা এড়াতে কই মাছ খাওয়া এড়িয়ে গিয়ে বুঝলাম মস্ত ভুল কইরালাইছি। মাছ ভাজিটা শিরাম হইসিল দেশী কই বইলা কথা যাইহোক খাওন শেষ- সবাই রেডি হয়ে বিদায় নিয়ে বাড়ির সামনে ছবি তুলে আবার আমাদের যাত্রা শুরু করলাম বেলা ৩টার একটু আগে।
এবার আমাদের ফিরতি পথ হল ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ধরে ডেমরা হয়ে। ফেরার পথে আর বলার মত কিছু নাই।
ঢাকা-সিলেট রোড সহ সারাদেশের হাইওয়ের ড্রাইভারদের স্বভাব যা- নিজের অংশের রাস্তা তাদের ভাল্লাগে না, রাস্তার ডানদিকটাই বেশী প্রিয়। ফলস্বরূপ একাধিকবার উলটা দিক থেকে আসা বাসের চাপে রাস্তা থেকে নেমে দাড়াতে হয়েছে। ডেমরা ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকলাম। তারপর যাত্রাবাড়ি-সায়দাবাদ-টিকাটুলি হয়ে মতিঝিল হয়ে আমি আমার বাসায় চলে আসলাম আর বাকিরা বুয়েটে চলে গেল। ততক্ষনে সারাদিনে মোট অতিক্রান্ত দূরত্ব ৯৩কিমি আর বাজে প্রায় ৬টা।
আর এভাবেই আমাদের ৭জনের প্রায় ১১ঘন্টার ৯৩কিমি দীর্ঘ ও মনে রাখার মত (অন্তত আমার কাছে) একটা জার্নির সমাপ্তি হল।
[পুনশ্চঃ ১. পুরা পথে ভাইয়াদের যে সাপোর্ট আর হেল্প পেয়েছি তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই আমার। বিশেষত টায়ার্ড হয়ে পড়ার কারনে বার বার পিছিয়ে পড়ায় ওনাদের বিরক্তি লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওনাদের কেউ না কেউ পথে আমার সাথে ছিলেন আর বাকিরা সামনে বেশী এগিয়ে গেলে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। আর বাসায় প্রনব ভাই এর আতিথেয়তা- এককথায় অসাধারণ!
২. বাসায় এসে গোসল করে দেখি পায়ের হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডেলে ঢাকা অংশ ছাড়া বাকি অংশ রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেসে এবং পায়ের পাতার অংশের পোড়া দাগ বেশ ভাল মত বোঝা যায়- একটু সাদা (বেল্টে ঢাকা অংশ) তারপর একটু কালো (খোলা অংশ)- পুরাই জেব্রা ক্রসিং।
আর পায়ের মাসলের ব্যাথা পরেরদিনও ছিল এতটুক বলাই যায়]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।