দ্রোহ আর বিদ্রোহের ফিনিক্স
তিথুন
অসময়ে বের হয়েই এই ঝামেলায় পড়ে গেলাম। এখন দুপুর আর বিকেলের মাঝের সময়টা। এই সময়ে আয়েশ করার বিলাসিতা অনেকেরই আছে। পাশেই পানের দোকানে চোখ বুজেঁ লঘু আমেজে মাথা দোলাচ্ছে দোকানি। আর পাশে রেডিওতে নীচু গ্রামে বাজছে সিনেমার গান।
আমি যাবো শাহবাগ। ওখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবে জিসান আর পাভেল। আমরা তিন জন মিলে যাবো একটা বিজনেস ফার্মে। ওরা আমাদের তৈরি করা একটা কম্পিউটার সফটওয়ার কিনবে। ডেমো ভার্সন দিয়েছি আগেই।
আজ ফাইনাল ইন্স্টলেশন।
“কিন্তু এই অসময়ে কেন?”- ফোনে জিসানকে জিজ্ঞেস করতেই ও জানালো ফার্মের এম.ডি. ভদ্রলোক নাকি এই অসময়েই সময় নির্ধারণ করেছেন। বুঝলাম কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই ফোন রেখেই বেরিয়ে পড়লাম।
চারিদিকে একটু বেশী নীরব মনে হচ্ছে।
মহাখালীতে এ সময়টাতে শব্দের মাত্রা বিরক্তিসীমা ছাড়িয়ে না গেলেও এতটা শান্ত থাকেনা কখনো। পাবলিক প্লেস বলে কথা। স্কুটার খুঁজছিলাম একমনে। কিন্তু একটাও চোখে পড়ছেনা। খানিকক্ষণ হয়ে গেল, তবুও কোন তিন চাকাওয়ালা সয়ংক্রীয় যান দেখা যাচ্ছে না।
সামনে এগিয়ে গেলাম, পরিচিত সিগারেটের দোকানে। ডেস্কের উপর দু’হাতে তাল ঠুকে গুন গুন করছিলো তাজুল। আমাকে দেখেই এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলো বরাবরের মত “কয়ডা দিমু ভাইজান?”
- লাগবেনা, আছে। ব্যাপার কি তাজুল?
- কোন ব্যাপার ভাইজান?
- এই যে, কোন স্কুটার দেখছিনা।
- ও! আর কইয়েন না ভাইজান, ফাডাফাডি হইয়া গেছে কতক্ষন আগে- উৎসাহ চকচক করে উঠল ওর চোখে।
শ্রমিকে শ্রমিকে, নিজেগো মাতা নিজেরাই ফাডাইছে। বেবীও গেছে দুই চাইরটা।
“কতক্ষন আগে?” - থামিয়ে দিলাম ওকে। একবার শুরু করলে আর সহজে থামতে চায় না।
- এই আদা ঘন্টা হইবো।
এক হালারপুতে ওভারটেক করতে নিয়া---।
- বুঝেছি; আবারো থামিয়ে দিলাম ওকে এবং সত্যিই বুঝতে পারলাম সহসা আর স্কুটার পাচ্ছি না। রিক্সা মন্দ হয় না - এই ভেবেই এগিয়ে গেলাম কয়েক গজ সামনে রিক্সার আড্ডায়।
“এই যাবে?” সামনের জনকে জিজ্ঞেস করলাম। একমনে বিড়ি টানছিল লোকটা, দৃষ্টি তাতেই নিমগ্ন।
- কই যাইবেন? ঘাড় না ঘুরিয়েই জানতে চাইলো সে।
- শাহবাগ।
- শাহবাগ কই? তার দ্বিতীয় প্রশ্ন।
- শাহবাগ মোড়।
- না যামুনা।
অনেকটা তাচ্ছিল্যের সাথেই বললো ও। রাগে গা জ্বলে গেল। বেশ ঝাঁঝের সাথেই বললাম যাবেনা যদি তবে ওভাবে জিজ্ঞেস করছিলে কেন?
- কি জিগাইলাম?
- ওই যে শাহবাগের কোথায় যাবো?
- আরে ভাই কইলাম তো যামুনা।
কি কথার কি উত্তর! হাসি চলে আসছিল সহসা। কিন্তু গম্ভীর মুখে তা চেপে গিয়ে অন্য রিক্সাওয়ালাদের দিকে চাইলাম।
তারাও যে যার প্যাসেঞ্জার সীটে আরাম করে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। কারো মাঝেই স্থান ত্যাগ করার ইচ্ছা দেখলাম না। মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের কোন রিক্সাওয়ালাই আজ আমাকে যাত্রী করবে না। আমি আর উৎসাহ পেলাম না। মরুক ব্যাটারা।
ওখান থেকে সরে এসে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাড়ালাম।
সিগারেট ধরিয়ে ভাবছিলাম কিভাবে যাওয়া যায়। জনারন্য খারাপ লাগে না। কিন্তু টেম্পো বা বাসের ভীড় অসহ্য। তাই বাস-টেম্পো এড়িয়ে চলি।
তাছাড়া একাধিক বার পকেটমার হবার অভিজ্ঞতা আছে আমার। চলেছি অর্থ সংগ্রহের জন্য। এসময় অর্থ খোয়ানোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
ছুড়ে দেয়া ধোঁয়া কন্ডুলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছিল উপরে। ওদের অনুসরন করে চোখ চলে গেল আকাশে।
আকাশটা আজ অদ্ভুত রকমের নীল। ঠিক যেন নীল রঙের কৃস্টাল ডিসপ্লে। এই নীলের তুলনা নেই। অথচ রাতের সোডিয়ামের আলোতে এই আকাশ দেখেই মনে হয় বড় রূগ্ন, বড় কৃত্রিম। হঠাৎ দৃষ্টি সীমানায় বাধা পড়তেই নীল ঢেকে গেল।
একটা বাস এসে দাড়িয়েছে। স্টাফ বাস। এসময়ে সাধারনত স্টাফ বাস দেখা যায় না। বুঝলাম ফাউ ট্রিপ মারছে। কিন্তু যাবেটা কোন দিকে? এমনিতে বাস থামার সঙ্গে সঙ্গে হেলপার উচ্চ স্বরে হেড়ে গলায় গন্তব্য স্থলের নাম আউরাতে থাকে মন্ত্রের মত।
কিন্তু এই হেলপারের মাঝে কোন চাঞ্চল্যই নেই। সে আলস্যে দাড়িয়ে ছিলো।
“বাস কোথায যাবে?”- আমিই জিজ্ঞেস করলাম আগবাড়িয়ে।
“মগবাজার, কাকরাইল, হাইকোর্ট, ইঞ্জিনিয়ার ইনিস্টিউট, শাহবাগ, বাংলামটর, ফার্মগেট............” একনিঃশ্বাসে বলে গেল ও। ইঞ্জিনিয়ার ইন্স্টিটিউটকে যেভাবে বললো, তাতে বুঝলাম কিছুটা হলেও এলেম আছে ছোকড়ার।
কিন্তু ফার্মগেটেই যদি যাবে তবে এত ঘুরে কেন, খট্কাটা দূর করতে পারছিলাম না। যদিও আমার খুশী হবার কথা। আমি সরাসরি গন্তব্যেই নামতে পারবো। তবুও জিজ্ঞেস করলাম ওকে
“ফার্মগেট এত ঘুরে যাবে কেন?” জবাবে কিছু বললোনা এলেমদার, শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তার টু পাইস কামানোর নির্দোষ(?) প্রক্রিয়ায় আমার নীতিগন্ধযুক্ত নাসাগ্রের অনুপ্রবেশে সে বিরক্ত।
বাসটায় ভীড় নেই, বলতে গেলে ফাঁকাই। আমি দ্বিধা ঝেড়ে উঠে পড়লাম।
ঋত্বিকা
বনানী থেকে বাসটা মহাখালী পর্যন্ত আসতে অনেকটুকুই সময় নিয়েছে। পথে কি যেন একটা ঝামেলা হয়েছিল। স্টাফ বাসে আরামে যাওয়া যাবে বলে উঠেছিলাম; কিন্তু আমার সব ক্ষেত্রেই একটা না একটা ঝামেলা হবেই।
সময় মত তৃনাকে ধরতে পারলে হয় এখন। বাসটা যাবে আবার সাত রাজ্যি ঘুরে। তৃনা হলে ফিরেছে নাকি অদ্বিত ভাইয়ের সাথে ঘুরছে সারা বিকেল কে জানে। যাই করো বাবা, আমার নোটগুলো পেলেই হলো। বাসটা প্রায় ফাঁকাই যাচ্ছে।
যাত্রীরা বসেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দেখে মনে হচ্ছে কারুরই বিশেষ তাড়া নেই। ড্রাইভারও মনে মনে একই গান না গেলেই বাঁচি। সামনে লেডি’স সীটে আমার সঙ্গী একজনই। ওপাশে সরে বসেছেন।
কারনটা বুঝতে অসুবিধা হয়না। কয়েকবার আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি এখন সামনে নিবদ্ধ। উসখুস করছেন বারবার। কথা বলার ইচ্ছে ছিল আমার সময়টা পার করে দেয়া যেত। কিন্তু ওনার অস্বস্তি দেখে সে চিন্তা ঝেড়ে ফেলেছি।
আমার দিকে চাইলে এখন আর সহজে স্বস্তি হয়না কারো। মানুষের দৃষ্টি আমি চিনে গেছি। কারো কারো ক্ষেত্রে এর সাথে কৌতুহল অথবা সমবেদনা মিশে থাকে। তখন আরও খারাপ লাগে।
আমি বা হাতের তালুতে লুকালাম মুখের বাম পাশ।
হাতের নীচে কিছু এলোমেলা, উচু-নীচু দাগ, গালের মসৃনতায় তাদের কদর্য উপস্থিতি ঘোষনা করেছে। সেই সাথে কদর্যতা লেপ্টে দিয়েছে আমার বর্তমানের মুখশ্রীতে, অতীতের অনেক সপ্রশংস দৃষ্টিকে মুছে দিয়ে। গ্রীষ্মের দূপুরের এক ঝলক হাওয়ার মত হানা দিয়ে যায় স্মৃতি..................
আমরা ঢাকায় ফিরছিলাম। আমি, ছোট আপু, দুলাভাই আর পিচ্চি অনিক। ড্রাইভ করার সময়ও আড্ডা মারতে ওস্তাদ ছিলেন দুলাভাই।
ঠিক মনে নেই কি হয়েছিল; শুধু গাড়িটা উল্টে যাবার সময় মনে হল বুঝি পৃথিবীটাই উল্টে যাচ্ছে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম; যতনা আঘাতে, তার চেয়ে বেশী ভয়ে। পরে শুনেছি আমার আঘাত ততটা গুরুতর ছিলো না, শুধু মুখের ক্ষত থেকে বের করতে হয়েছে অনেক ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো। ভাঙ্গা কাঁচের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দেখতে ঠিক হীরের মত। কিন্তু ওগুলো আমাকে সাজায়নি; কেটেছে।
আর আমি আমার সব কষ্ট ভুলে গেছি ছোটআপুর দিকে তাকিয়ে। ও আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। একা।
এরপর প্রথমে বাইরে বেরুতে সংকোচ হত। মানুষের নানা রকম জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে পড়ে হীনমন্যতায় ভূগতাম।
কিন্তু এখন সয়ে গেছে।
বাসাটা কখন চলতে শুরু করেছে টেরই পাইনি। মন কখন যে কোথায় ডুব মারে, বর্তমান হারিয়ে যায়। পলিটেকনিকের কাছাকাছি চলে এসেছি। ভেতরে ডান দিকে চাইতেই দেখলাম ছেলেটিকে।
আমার দিকেই তাকিয়ে আছে, অথচ যেন আমাকে দেখছে না। কেউ আমার দিকে তাকালে আমিও সরাসরি তাকাই। কিন্তু এখন কেন যেন আড়চোখে চাইলাম। চেহারাটি মন্দ নয়, কাধ অবধি লম্বা চুল। এখন ও চেয়ে আছে আমার হাতের দিকে।
চোখে কি যেন একটা রহস্য খেলা করছে। এ দৃষ্টি আমার অচেনা। নাহ্ এভাবে ওকে দেখা ঠিক হচ্ছেনা। কিন্তু ছেলেটিও কেমন নির্লজ্জের মত নিষ্পলক তাকিয়ে আছে, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম সামনে। আরে! এইতো উইন্ডশীল্ডের ছায়ায় ওকে বেশ দেখা যাচ্ছে।
যুবক তুমি জানিলেনা, দর্পনে তোমার ছায়া পড়িয়াছে।
তিথুন
সামনেই সিট পেয়ে গেলাম। সিগারেটটা এখনো শেষ হয়নি। শেষ বারের মত ধোঁয়া শুষে নিয়ে ফেলে দিলাম বাইরে। বাস অন্তত অর্ধেকটা ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত হয়তো অপেক্ষা করতে হবে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ড্রাইভার অল্পক্ষন পরেই বাস ছেড়ে দিল। জানালা দিয়ে রাজপথ দেখছিলাম। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছিল কি যেন একটা চোখের আড়ালে রয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম না ঠিকমত। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলাম।
পৌনে চারটা। হঠাৎ চোখ চলে গেল পাশে। আশ্চর্য! আকাশের একটা টুকরো এখানে এলো কি করে! অবশ্য এ হলো জোছনা রাতের আকাশ। সত্যিই চমকে উটেছিলাম প্রথমে। মেয়েটা নাইট ব্লু রঙের জামা পড়ে আছে।
গ্র্যাডিয়েন্টের মত ফিকে হয়ে এসেছে ধীরে ধীরে। রাতের আকাশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আমি পুর্ণ দৃষ্টিতে চাইলাম। ওর মুখ দেখতে পারছিনা। বা হাতের উপর মুখের ভার চাপিয়ে তাকিয়ে আছে সামনে।
কিছু একটা ভাবছে আনমনে। এ্যাই মেয়ে, কি ভাবো তুমি? আভরনের নীল কি তোমার মনকে ছুঁয়েছে বিষন্নতায়?
ও এদিকে চাইছেই না। ওকি বুঝতে পারছে কেউ একজন ওকে দেখছে; বুঝুক গে। কখনো কোন মেয়ের দিকে এত আগ্রহ ভরে তাকাইনি। এ নিয়ে বন্ধু মহলে গুডবয় বলে বদনাম আছে।
কিন্তু এখন আমি ওকে দেখছি। বা’হাতে ধরে আছে ছোট পার্টস। কি অপুর্ব ভঙ্গিমা তার নিখুত আঙ্গুলের। আলতো করে রাখা কোলের উপর। আমি পিকাসো, রাফারেল, কিংবা ভ্যানাগগ বা সুলতান বুঝিনা।
কিন্তু মনে হচ্ছে শুধু ওটুকুই হতে পারে অসাধারন কোন শিল্পকর্ম। ওই হাত কি পিয়ানোতে বইয়ে দেয় ডি মাইনর এর মেলোডির স্রোত? অথবা ক্যানভাসে বুলিয়ে দেয় সপ্তবর্নের প্রলেপ?
এত কি ভাবছো তুমি আকাশ কন্যা? তোমার ভাবনার সীমানা কি অসীমে বিস্তৃত? এই দিকে দ্যাখ ফিরে- পূর্ণতা পাবে সুন্দর এক জোড়া স্থির চোখ। অন্তরালে তুমি কি---
- ভাই কই যাইবেন?
চমকে উঠি সহসা। ব্যাটা বেরসিকের বাচ্চা। মনে মনে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে উদ্যত হই কনডাক্টরের।
বাইরে তাকিয়ে দেখলাম মগবাজার পেড়িয়ে পার্ক অ্যাভিনিউ ধরে ছুটে চলেছে বাস। মুখ ফিরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলি শাহবাগ।
- ভাড়াডা দ্যান
মানিব্যাগ বের করে ওর হাতে একটা বিশ টাকার নোট গুঁজে দেই। ”ভাংতি নাই?”- তার মৃদু আপত্তি সবুজ নোটে । এ তো মহা জ্বালা! তুই ব্যাটা এমনিতেই অপরাধী হয়ে আছিস।
তার উপর-----
এবার গম্ভির গলায় ওকে “না” শুনিয়ে দিলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাদ বাকি টাকা ফেরত দিয়ে ঘুরে দাড়ালো ও। হঠাৎ আশান্বিত হয়ে উঠলাম। ব্যাটা এবার বা’ দিকে ভাড়া চাইবে। মুহুর্তেই ক্ষমা করে দিলাম ওর অপরাধ।
কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে ওদিকে একবার তাকিয়েই পেছন দিকে চলে গেল কনডাক্টর। অর্থাৎ আগেই দায়মুক্ত হয়েছে মেয়েটি। আচ্ছা কি নাম ওর? জানিনা যখন, আমিই না হয় একটা নাম দেই। শোন মেয়ে, তুমি হলে উত্তর আকাশের নক্ষত্র “অরুন্ধতী”।
মাঝখানে মুগ্ধতার আবেশে ছেদ পরেছিল।
তাই তাকে পুর্ণ করার ইচ্ছায় আবারো চাইলাম অরুন্ধতীর দিকে। ও তেমনি বসে আছে। একরাশ অবাধ্য চুল ওর মুখের একপাশ আড়াল করে আমাকে আরও উন্মত্ত করে দিতে চাইছে যেন। আমি চেয়ে আছি তৃষ্ণার্ত তীবরের মত। কিন্তু জলহীনতায় মেঘ শুন্য।
অরুন্ধতী তোমার আঁকা সকল ছবিই অসমাপ্ত থেকে যায়। তুমি না জানলেও আমি ঠিক জানি। চুলগুলো অনামিশার মত জড়িয়ে আছে ওর মুখ। তার আড়ালে আলোক বিচ্ছুরন ধরা পড়ে না এই চোখে। যেমনি জলের উপর পড়েনা মেঘে ঢাকা নক্ষেত্রের ছায়া।
আমি ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হচ্ছি সামগ্রিক এক অপার সেন্দৈর্যের ছায়ায়। একটি একটি বিন্দু দিয়ে যেমন আঁকা যায় ছবি, তেমনি করে। কেমন একটা ঘোর চলে আসছে। আমি নিজের মনে সৌন্দর্যের সৌরভ ছড়িয়ে দিচ্ছি অদেখা একটি মুখে। দেখছি এরোসের কন্ঠলগ্না অ্যাফ্রোদিতির মুখ।
শাহবাগ- হেলপারের উচ্চ স্বর কানে যেতেই চমক ভাঙ্গলো। গন্তব্যে পৌছে গেছি। সময়তো কখনো এত দ্রুত পেরিয়ে যায়নি আগে! মূহুর্তগুলো যেন ক্ষন হয়ে ছিল কিংবা মিনিট গুলো সেকেন্ড। পূর্ব সিগন্যলে দাড়িয়েছে বাস। সামনেই একই গোত্রের ভীড়।
অপেক্ষা করছে সবুজ সংকেতের। ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালাম। বিদায় অরুন্ধতী। তুমি জানলেনা, তুমি কি দিয়েছো আমায়।
পা, বাড়াতেই ফুটপাতে নেমে এলাম।
দু’পা এগিয়ে সিগারেট ধরিয়ে নিলাম একটা। না তাকিয়েও বুঝতে পারছি অরুন্ধতী তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। চতুষ্কোন ফ্রেমে একটা উদীগ্রব মুখ। বুকের ভেতর একটা তোলপার টের পাচ্ছি। এবারে আমার চাইবার পালা।
ঋত্বিকা
ভাস্কর্যের মত অনঢ় বসে আছে ও। শুধু তার মাঝে জীবন্ত দুটি চোখ। বারবার বদলে যাচ্ছে তার ভাষা। অস্পষ্ট ছায়াতেও বেশ বোঝা যায়। ও চেয়ে আছে এখনো স্থির চোখে।
যেন কেউ সম্মোহন করে রেখেছে। দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ছে মুগ্ধতা। কি দেখছে ও? এ দৃষ্টি আগেও দেখেছি অনেক। কিন্তু সে সময় এখন অতীত। আর এখন? আমায় দেখে আর কিছু না হোক মুগ্ধতা জাগেনা কারো চোখে।
আমি তো আড়াল করে রেখেছি আমার মুখ। এখানে চেয়ে দেখার কিছু নেই। তবু কেন লক্ষ্য খোঁজ অন্ধ তীরন্দাজ? তুমি যাই দেখনা কেন, তা ঘিরে আছে ভ্রান্তি’র বেড়াজালে।
ইচ্ছে করছিল ওর চোখে তাকাই। কিন্তু আমি জানি, তাতে সেখানে ভেসে উঠবে বিপরীত ভাষা।
কি লাভ, কারো এক পলকের স্বপ্নাবিষ্ট অনুভুতি গুড়িয়ে দিয়ে, যদি মোহ থেকেই তার জন্ম হয়। একটু পরই কে কোথায় চলে যাবো কেউ জানে না। থাকুক ও ওর মনে।
কিন্তু একটা মানুষকে অনুভুতির শীর্ষ বিন্দুতে নিয়ে যায় কোন সে শক্তি- তা জানার একটা দূর্নিবার আকাঙ্খা জেগে উঠেছে বুকে। অস্বীকার করবো না, একটা শিহরনও।
কেউ আমাকে বিশাল ভাবলে, তাকে কি এড়িয়ে থাকা যায়? যুবক তুমি আর চেয়ো না এদিকে.......ভাবতেই ও ঢেকে গেল কাঁচের গায়ে। কনডাক্টর এসে দাড়িয়েছে ওর পাশে, ভাড়া চাইছে। গন্তব্য জানতে চাওয়ায় শুনতে পেলাম একটা ভরাট কন্ঠস্বর “শাহবাগ”। আর উত্তরটা যেন একটা চোরকাঁটা বিধিয়ে দিল মনে। আমারো গন্তব্য একই।
তারপর?
মুখোমুখি না হোক ও অন্তত পাশে চলে আসবে। যুবক তোমার বুকে কাঁটা বিধিয়ে ফোটানো হবে রক্ত গোলাপ। অতঃপর হত্যা---।
ও চেয়ে আছে এখনো। বুকের ভেতর একটা কিছু মাথাচাড়া দিচ্ছে ।
একটা কষ্ট বোধ। আশ্চর্য! সেটা ওর জন্য। তুমি বিদ্ধ করেছ আমায়। বর্শায় নয়, কিসে আমি জানি না । তুমি চেয়ে থেকো না।
শাহবাগ এসে গেছে। সিগন্যালে অপেক্ষমান গাড়ির বহর। আমাদের বাসটাও এসে থামলো। ও উঠে দাড়িয়েছে আর সেই সাথে সরিয়ে নিয়েছে দৃষ্টি। আমি স্থির হয়ে বসে আছি এখনো।
আমার এখানে নামা হবে না। আমি পারবো না। ও নেমে গেছে ধীর পায়ে। ঐ তো পাশে এসে দাড়িয়েছে ফুটপাতের উপর। সিগারেট ধরিয়ে নিলো মাথা নীচু করে।
ওর চোখে এখনো রেশ কেটে যায়নি পূর্ব অনুভুতির। বরং আগের ছায়া আরো গাঢ় হয়েছে যেন। আমি দেখছি ওকে পরিপূর্ণ ভাবে। চোখ সরিয়ে নিতে পারছিনা। ওকি এবার চাইবে এদিকে? হ্যাঁ তাই করো।
আমি দেখতে চাই, আমাকে দেখার পরও তোমার চোখে রয়ে গেছে মুগ্ধতা। দেখতে চাই তুমি পারো অসুন্দরকে সুন্দর করে তুলতে। এই দিকে ফিরে চাও- আমি দেখি তোমার মুখে বিজয়ীর হাসি, ঘৃনাকে পরাজিত করে। সব কিছু কেমন অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখটা বিশ্বাসঘাতকতা করলো।
আমার বিক্ষত কপোলে গড়িয়ে পড়ছে নোনতা জল।
তিথুন
স্নিগ্ধ একটা সুন্দরের ঘোর আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এতক্ষন। তার রেশ এখনো জড়িয়ে আছে আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে। এক অপুর্ন অবলোকন থেকে তার জন্ম দিয়েছি আমিই। সেই সৌন্দর্য - অরুন্ধতী।
ও চেয়ে আছে জানালায়। আমি মুখ ফিরিয়ে চাইলেই দেখতে পাবো এতক্ষণের সুতীব্র কাঙ্খিত মুখ। আমি জানি না কি আছে সেই মুখে। পাহাড়ের অহঙ্কার, সাগরের বিশালতা নাকি আঁধারের নিকষতা। যাই হোক, সে অন্য মুখ।
আমি যাকে সৃষ্টি করেছি - সে অরুন্ধতী। আমি দেখেছি যে আলোর জানালা, তাকে মুছে দেই কোন সাহসে। আমার অরুন্ধতী আমারই থাক...........
একরাশ ধোয়ার কুন্ডলী উড়িয়ে আমি এগিয়ে চললাম সামনে। একবারও পিছু না ফিরে।
প্রথম প্রকাশঃ 'ঈক্ষণ' ১৯৯৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।