আলো নয় আধার খুজি ,সত্যের জন্যে নয় মিথ্যের বিরুদ্ধে যুঝি।
বিভ্রম
==============================
লিয়ামের হাত-পা অবশ হয়ে আসছে,প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে হৃদপিন্ডটা যেন পাজরের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। একটা পাথরের টুকরায় আঘাত লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ল লিয়াম,ডান হাতের কনুই ছিলে রক্ত বের হতে শুরু করেছে। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে শুরু করল লিয়াম কিন্তু পা আর চলতে চাইছে না,চোখে অন্ধকার নেমে আসছে,মাথার ভেতর যেন হাজার হাজার ঘন্টা বাঁজছে। একটু থেমে দম নেয়ার চেস্টা করল লিয়াম,আবারো সবগুলো পকেটে হাত বুলাল যদি কোনটায় ইনহেলারটা পাওয়া যায়।
ইনহেলারটা না পাওয়ায় শ্বাসকষ্টটা যেন আরেকটু জেঁকে বসল,ওর মনে হচ্ছিল বুকের ওপর হটাৎ করেই কেউ যেন একটা বিশ পাউন্ডের ওজন চাপিয়ে দিয়েছে। এমন সময় কানের পাশ দিয়ে সাঁই শব্দে একটি গুলি এগিয়ে গিয়ে সামনের বাতিহীন ল্যাম্প-পোস্টে ধাতব আওয়াজ তুলল। সচকিত হয়ে ভয়ার্ত চোখে পেছন ফিরে তাকাল লিয়াম,পেছনে বন্দুক হাতে ছুটে আসা অবয়বটা ধীরে ধীরে আরো কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। লিয়াম প্রাণপন ছুটতে শুরু করল কিন্তু শরীর যেন কথা শুনতে চাইছে না, অবশ নীথর হয়ে উঠছে তার সারা দেহ। লিয়াম মনে সাহস আনার চেষ্টা করল 'বাঁচতে আমাকে হবেই,আমি এত জলদি হার মানতে পারি না! না!'।
তার চোখের সামনে আপনজনদের মুখ একের পর এক ভাসতে লাগল। আর যদি তাদের সাথে দেখা না হয়,আর যদি এই প্রিয় মানুষগুলির হাসি আর আলিঙ্গনে সে নিজেকে হারাতে না পারে, এসব কথা ভাবতে ভাবতে লিয়ামের চোখ ছলছল করে উঠল। এসব চিন্তায় মোড়ের অন্যপাশ থেকে আসা সাদা ক্যাডিলাকটাকে লক্ষ্য করেনি সে। গাড়িটা সজোরে আঘাত করল তাকে এবং গতি কিছুমাত্র না কমিয়ে নিজ পথে চলে গেল। উড়ে গিয়ে রাস্তার কোনের একটা ডাস্টবিনের উপর আছড়ে পড়ল লিয়াম।
তার পুরো শরীরে একটা প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করল সে,মাথার পেছনে হাত দিয়ে দেখল সেখান থেকে রক্ত ঝড়ছে,সব অনুভুতি কেমন যেন ভোঁতা হতে শুরু করল,চোখ বুজে আসতে লাগল। এমন সময় দেখতে পেল সেই বন্দুকধারী তার সামনে দাড়িয়ে,বন্দুক তাঁক করে আছে ঠিক তার বুক বরাবর এই যেন গুলি করবে.........
টেলিফোন বাঁজার শব্দে টেলিভিশন থেকে চোখ ফেরাল মাহিম। নিজের সাথেই বিড়বিড় করতে লাগল 'আজকালকার সিনেমাগুলোর হয়েছেটা কি?সব কেমন যেন একইরকম,যেন একই ছাঁচে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান দিয়ে বানানো'। ফোনকর্তার যেন খুবই তাড়া,একবার রিং শেষ না হতেই আবার বাঁজছে টেলিফোন। অনিচ্ছা স্বত্যেও উঠে টেলিফোনের দিকে রওনা হল মাহিম,'এত রাতে আবার কে ফোন করল?'ভাবল সে।
টেলিফোনের ওপাশ হতে এক নারীকন্ঠ ভেসে আসল,খুবই উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত শোনাচ্ছে সে কন্ঠস্বর।
'হ্যালো! মাহিম রিজওয়ান বলছেন?'
-জ্বি বলছি
আমি সেন্ট পাবলো হসপিটাল থেকে বলছি। আপনি আমাকে চিনবেন না,আমি মেরীয়ান,আপনার স্ত্রীর সাথে আজ বিকেলে সুপার স্টোরে পরিচয় হয়েছিল আমার...
-আমার স্ত্রী?!! দেখুন আপনি মনে হয় কোথাও ভুল করছেন...আমি অবিবাহিত সুতরাং আমার স্ত্রীর সাথে আপনার পরিচয় হবার প্রশ্নই আসে না।
আপনি মাহিম রিজওয়ান নন? মাইক্রোবায়োলজিস্ট?
-জ্বি আমিই মাহিম রিজওয়ান এবং আমি পেশায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমি অবিবাহিত সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমার স্ত্রী বলতে কেউ নেই।
কিন্তু রীতি!, আমি যার সাথে আজ বিকেলে পরিচিত হলাম,তিনি তার স্বামীর কার্ড বলে যেটা দিয়েছিলেন সেটা আপনার।
-তিনি হয়তো বা ভুল করেছেন,তাড়াহুড়োয় হয়তো ভুল কার্ড দিয়েছেন,তাছাড়া আমি রীতি নামে কাউকে চিনি না। আর আমি মাত্র ১ মাস হল সিডনীতে আমার এই চাকরীতে জয়েন করেছি,ওরকম কাউকে আমার কার্ড দিয়েছি বলেও মনে পড়ছে না।
দেখুন উনি ভুল করেছেন বা আপনি ভুল করছেন সেটা নির্নয়ের সময় এটা না,সুপারস্টোর থেকে বের হয়ে রীতি একটা কার-এক্সিডেন্টের শিকার হয়েছেন,ওনার অবস্থা খুবই গুরুতর এবং অস্ত্রপচারের জন্য আত্মীয়দের কারো সম্মতি দরকার মেডিক্যাল ফর্মে এবং আমার কাছে শুধু আপনার কণ্ট্যাক্ট নাম্বার আছে। সুতরাং আপনি যদি মনে করেন যে বিপদাপন্ন এই মহিলাকে আপনার সাহায্য করা উচিত তবে তৎক্ষনাত হাসপাতালে চলে আসুন, তাছাড়া এই মহিলা আপনার স্ত্রী না হলেও আপনার পরিচিত নিশ্চই নাহলে সে আপনার কার্ড হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে ঘুরত না নির্ঘাত। আর আমার যতদুর মনে হচ্ছে রীতির মত আপনিও বাঙ্গালী অতএব অন্তত একজন বাঙ্গালীকে এতটুকু সাহায্য তো আপনি করতেই পারেন।
কিছুক্ষন ভেবে হাসপাতালে যাওয়ার মনস্থির করল মাহিম। আর সেন্ট পাবলো এখান থেকে বেশী দুরেও নয়। নিজের কালো toyota matrix srx গাড়িটি নিয়েই রওনা হল মাহিম।
২
সেন্ট পাবলো হসপিটাল,জরুরী বিভাগের সামনে পায়চারী করছে মেরীয়ান। মাহিমকে দেখেই জিজ্ঞেস করল 'আপনি কি মাহিম রিজওয়ান?'।
মাহিম সাথে সাথেই হ্যা-সূচক উত্তর দিল। মেরীয়ান,মাঝারী গড়নের ভদ্রমহিলা। বয়স ২৪-২৫ হবে,প্রথম দেখায় বাঙ্গালী বা উপমহাদেশীয় বলেই মনে হয় তবে চোয়ালের গঠন ইউরোপীয়ানদের মত,সব মিলিয়ে সুদর্শনাই বলা চলে। মাহিমকে ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেখে মেরীয়ান বলল 'কি ভাবছেন?আমাকে সুন্দরী বলা চলে কি না?'। 'ভাবছিলাম আপনিও বাঙ্গালী কিনা?'বিব্রতবোধটা কিছুটা কাটিয়ে উঠে বল্ল মাহিম।
'নাহ্, বাঙ্গালী নই তবে আমার মা মালয়েশিয়ান' মেরীয়ানের উত্তর। 'চলুন,ডাক্তার আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন'। মাহিম মেরীয়ানকে অনুসরন করে হাটতে শুরু করল জরুরী বিভাগের ভেতরে। 'আচ্ছা!তখন আপনি আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন কি করে?' মাহিমের কৌতুহলী প্রশ্ন শুনে মেরীয়ান মৃদু হেসে জবাব দিল 'চিনব না কেন বলুন?আপনার আইডি কার্ডটা যে ঝুলছে আপনার গলায়'। আইডি কার্ডটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিব্রত হল মাহিম,ল্যাব থেকে এসে জামা-কাপড় আর পাল্টানো হয়নি এমনকি আইডিটাও খোলার কথা মনে নেই।
সে আইডি কার্ডটা খুলে পকেটে রাখল। একটা কেবিনের দরজার সামনে এসে থামল মেরীয়ান,দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে রীতি,তবে দেখলে মনে হয় যেন ঘুমোচ্ছে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে,বাম হাতটায়ও ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। 'কি? চিনতে পারছেন?'মেরীয়ানের উৎসুক প্রশ্ন।
কিছুক্ষন খেয়াল করে দেখার পর মেয়েটাকে চিনতে পারল মাহিম। সপ্তাহখানেক আগে রোজেল থেকে বাচ্চাদের একটা দল এসেছিল 'অরফিয়াম ল্যাব' পরিদর্শনে, তাদের সাথেই গাইড হিসেবে এসেছিল মেয়েটি। তখনই পরিচয় হয়েছিল মাহিমের সাথে এবং বাঙ্গালী হওয়ায় মাহিম তার কার্ডও দিয়েছিল মেয়েটিকে।
'হ্যা চিনতে পেরেছি,ল্যাবে পরিচয় হয়েছিল কার্ডও দিয়েছিলাম,বাঙ্গালী মেয়ে, সম্ভবত তাড়াহুরোয় ওর স্বামীর কার্ডের যায়গায় আমার কার্ডটা দিয়েছিল আপনাকে। আঘাত কি খুব বেশী গুরুতর?'।
-মাথা এবং হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে,তবে ডাক্তার মেরুদন্ডে বড় ধরনের আঘাতের আশঙ্কা করছেন। গাড়ির চালক যেন ইচ্ছা করেই খুন করতে চাচ্ছিল মেয়েটাকে। প্রথমবার ধাক্কা দেয়ার পরও সে গাড়ি থামায় নি বরং মেয়েটার উপর দিয়েই চালিয়ে দিয়েছে গাড়ি।
এমন সময় ডাক্তার ঢুকলেন ক্যাবিনে,মাহিমকে দেখে জানতে চাইলেন সেই রীতি'র স্বামী কি না?মাহিম সত্য বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু মেরীয়ান ওকে ইশারায় থামিয়ে দিল। 'জ্বি উনিই রীতির স্বামী' বল্ল মেরীয়ান।
কিছু কাগজ মাহিমের দিকে এগিয়ে দিয়ে সই করে দিতে বললেন ডাক্তার। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সই করল মাহিম। 'আমরা যথাশীঘ্রই অপারেশন শুরু করব' বলে চলে গেলেন ডাক্তার।
এটা কি ঠিক হল?আমি তো ওনার স্বামী না,কিছুটা বে-আইনী ব্যাপার হয়ে গেল না?
-আপনার কিছু সই-এ যদি একটা মেয়ের জীবন বাচে তাতে ক্ষতি কি?নাকি ভাবছেন এই মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠে বলবে 'নাও খুবতো স্বামী সেজেছিলে,এবার আমায় বিয়ে কর'বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল মেরীয়ান। মাহিম তার দ্বিধা আর বিব্রতবোধ নিয়ে তাকিয়ে থাকল এক অপরুপা অপরিচিতার মুখপানে।
জরুরী বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে রীতি'র অপারেশন চলছে। মাহিম আর মেরীয়ান অপেক্ষা করছে জরুরী বিভাগের বাইরের ওয়েটিং লাউঞ্জে। মাহিম খুবই ক্লান্ত বোধ করছে,আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে, ঘুমে যেন চোখ বুজে আসতে চাইছে। অনেক কষ্টে ঘুম আটকে জেগে আছে মাহিম,ওয়েটিং লাউঞ্জের সোফায় নাক ডেকে আরেকবার মেরীয়ানের কাছে বিব্রত হতে চায় না সে। মেরীয়ান হঠাৎ জায়গা ছেড়ে উঠে দাড়াল 'আমি নিচে যাচ্ছি,মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে কিছু একটা ঔষধ খাওয়া দরকার।
আপনার জন্য কি কফি আনব?'। 'জ্বি... যদি আপনার কষ্ট না হয় তবে নিশ্চই,এক কাপ কফি আসলেই দরকার' মৃদু হেসে জবাব দিল মাহিম। মেরীয়ান ধীরু পায় এগিয়ে যেতে লাগল করিডোর ধরে...ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবল মাহিম 'ছিঃ! কি অভদ্রতাটাই না হল,একটা অসুস্থ মেয়ে একা একা নিচে গেল ঔষধ কেনার জন্য আর সে সঙ্গে যাওয়া দূরে থাক,নির্লজ্জের মত আবার নিজের জন্য কফি আনার কথা বলে দিল। মেয়েটা না জানি কি সব ভাবছে এই অভদ্র বাঙ্গালীটার ব্যাপারে'। এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা টেরই পেল না মাহিম।
৩
যখন মাহিমের ঘুম ভাঙ্গলো তখন সকাল। ঘুম ভেঙ্গেই শুরু হল অবাক হওয়ার পালা,সে শুয়ে আছে হাসপাতালের কোন একটি পার্সোনাল কেবিনের বেডে। তার গায়ে হাসপাতালের রোগীদের পোশাক,বাঁ হাতে স্যালাইনের নল লাগানো,মাথায় ব্যান্ডেজ,সম্পূর্ন শরীরে ব্যাথা। বেডের পাশে এক স্তূপ যন্ত্রপাতি মৌমাছির মত গুনগুন শব্দ তুলছে একটু পর পর,আর কিসব বিচিত্র রিডিং দিচ্ছে। এমন সময় ডাক্তার ঢুকলেন ক্যাবিনে 'আপনার জ্ঞান ফিরেছে দেখছি,তা কেমন বোধ করছেন এখন?'।
'জ্বি ভাল না,সম্পূর্ন শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা, মাথাটাও কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। আমি এখানে কিভাবে?কি হয়েছিল আমার?'
-পুলিশের কাছ থেকে পালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছিলেন আপনি,কপাল ভাল যে বেচে গেছেন। ঠিক ২দিন পর জ্ঞান ফিরল আপনার।
আমি?আর পুলিশের কাছ হতে পালাচ্ছিলাম?আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না...
মাহিমের কথা শেষ না হতেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন একজন মাঝবয়েসী লোক। লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী,কপালের পুরু ভাঁজ আর দৃঢ় চোয়াল কেমন যেন একটা কাঠিন্য এনে দিয়েছে চেহারায়।
'বাছাধনের জ্ঞান ফিরেছে দেখা যায়,তা কি ভেবেছিলে?দু দু'টো খুন করে এভাবেই পার পেয়ে যাবে?আমায় ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবে?এত্ত সোজা না বুঝলা?এবার তোমাকে বুঝাব পুলিশী ডলা কারে বলে খালি একবার কিছুটা সুস্থ হও,তোমারে বুঝাব খুন করার মজা কত?' মাহিমের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলল লোকটি।
চলবে.........। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।