মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
হাজী আব্দুস সামাদ আজাদঃ স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অকুতোভয় যোদ্ধা[/sb
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির যোদ্ধা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আওমীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলন ও মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামের অন্যতম জাতীয় নেতা ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিকে তিনি যুক্ত ছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিরও প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। রাজনৈতিক প্রয়োজনে কমিউনিষ্ট পার্টি তাকে আওয়ামীলীগের মধ্যে কাজ করার জন্য পাঠায়।
কিন্তু ওই দলের মধ্যে গিয়ে তিনি আর কমিউনিষ্ট হিসেবে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। হয়ে গেলেন আওয়ামীলীগ। এই দলেই রয়ে গেলেন আজীবন। তারপরও আওয়ামীলীগের মধ্যে যারা ভালো তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
আব্দুস সামাদ আজাদের রয়েছে রাজনৈতিক জীবনের সুদীর্ঘ ইতিহাস ৷ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে এবং আসামের আঞ্চলিক বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে তিনি ছাত্র অবস্থায় জড়িয়ে পড়েন।
এ সময় তিনি ইংরেজ শাসকের রোষাণলে পড়ে কারাগারে যেতে বাধ্য হন।
আব্দুস সামাদ আজাদের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ জানুয়ারী। বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার ভূরাখালী গ্রামে। বাবা শরিয়ত উল্লাহ ছিলেন একজন সমাজকর্মী।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে।
তারপর গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি সুনামগঞ্জ শহরের সরকারী উচ্চ বিদ্যাল্যে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে মেট্রিক পাশ করেন। ওই বছর তিনি সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ৷ এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ইতিহাস শাস্ত্র অধ্যয়ন করে প্রতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ করেন।
১৯৪০ সালের প্রথম দিকে তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হন। ওই বছরের শেষ দিকে তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। তখন থেকেই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৪৪-৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
এজন্য তাকে কারাগারে যেতে হয়। তিনি ১৯৫৩ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি তত্কালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছর তাঁর উপর হুলিয়া জারী করে এবং তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ ধর্মঘটের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সামাদ আজাদ চীন সরকারের আমন্ত্রনে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৭ সালে চীন সফরে যান। এখানে তিনি মে দিবসের অনুষ্ঠানে যোগদান দেন। এ সফরকালে তিনি চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং, লী শাও চী, চু'তে ও চৌ এন লাই এর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
রাজনৈতিক কারণে সামাদ আজাদ এ সময় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ, বিশ্বস্ত ও নির্ভরশীল সহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন প্রথম সারির নেতা হিসেবে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এরপর তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম শ্রম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব শাসনের সময় তাকে আবারো গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে তিনি মুক্তি পান। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে গিয়ে পুনরায় কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গণ-পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে জনাব আব্দুস সামাদ আজাদের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার গঠনে সামাদ আজাদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের ১১ মে হাঙ্গেরীর বুদাপেষ্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এই শান্তি সম্মেলনে তিনি কলোনিয়ালিজম ও রেসিয়ালিজম কমিটির সভাপতিত্ব করেন।
ওই সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সমর্থন চান। গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত করতে ও স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ চলাকালীন মুজিব নগর সরকারের একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে নিউইয়র্ক যান। এ ছাড়াও তিনি আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, সোভিয়েত রাশিয়া, জার্মানী. হল্যান্ড ও যুগোশ্লাভিয়াসহ বিভিন্ন দেশ সফর করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সেসব দেশের সরকার ও জনগণের সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা চালান।
স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আব্দুস সামাদ আজাদ মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পর তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি পাকিস্তানে অন্তরীণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্ঠা চালান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারী গঠিত মন্ত্রীসভায় জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ পুনরায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ৬ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ কুয়ালালামপুরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রকাশ্যে হবে’। ‘জনাব ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিতে রাজী নন’।
বাংলাদেশের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির তিনিই প্রথম উদ্যোক্তা।
১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি সুনামগঞ্জ থেকে দু'টি আসনে জয়লাভ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। এ সময় আব্দুস সামাদ আজাদকে গৃহবন্দী করা হয়। পরে জাতীয় চার নেতার সাথে তাঁকে কারাগারে বন্দী রাখা হয়। সামরিক আদালতে জনাব আব্দুস সামাদ আজাদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়।
পাঁচ বছর কারা ভোগের পর তিনি ১৯৮০ সালে মুক্তি পান।
১৯৮২ সালে সামরিক শাসন ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তার ভূমিকা ছিল। ১৯৯১ সালে তিনি সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। এ সময় তিনি সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সালে তিনি নিজ এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি মারা যান।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ আজাদকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করা হয়।
সম্পাদনায়ঃ শেখ রফিক ও কল্লোল.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।