ব্লগার না পাঠক হওয়ার চেষ্টায় আছি বেশ কদিন আগের কথা। খালাতো বোনের গায়ে হলুদ। যাওয়াই লাগবে। অফিস থেকে একটু আগে বের হওয়া দরকার। তবে আগে বের হতে গেলেই বসের চোখের রাঙ্গানো খাব কি না সে ব্যাপারে কিঞ্চিত চিন্তিত ছিলাম।
যেহেতু আদরের ছোট বোনের গায়ে হলুদ সেহেতু বসের চোখ রাঙ্গানোর কোন কেয়ার না করেই বের হতে উদ্যত হলাম। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়! রুম থেকে বের হতেই দেখি বস দাঁড়িয়ে আছেন! আমি খাম্বার মত দাঁড়ায়ে গেলাম। বস গম্ভীর গলায় বললেন, “কাজ বাদ দিয়ে এখানে কি?” আমি মৃদু স্বরে বললাম, “বোনের গায়ে হলুদ! আমাকে..” বস আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বোনের গায়ে হলুদ এখানে কি! যান যান বাসায় যান! আপনার মত ইরেসপন্সিবল লোকতো আমি জীবনে দেখি নি। আজ আপনাকে অফিস করতে বলল কে?” আমি মৃদু একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। হাসি আসল না! এত গম্ভীর আর সিরিয়াস একটা লোকের ভেতরও যে আবেগ নামক একটা বস্তু থাকতে পারে তা দেখে আমি রীতিমত মুগ্ধ হয়ে গেলাম! অফিসে যখন জয়েন করেছিলাম তখন সবাই বলেছিল বস রাগী হলেও মানুষ ভাল।
বিশ্বাস হয় নি এতদিন। কারণ এই লোক জীবনে কোনদিন হেসেছে বলে মনে হয় না! তবে আজ বুঝলাম মানুষের চেহারায় সব কিছু ফুটে ওঠে না।
অফিস থেকে বের হয়ে রিকশা নিলাম। গন্তব্য শান্তিনগর। বুড়ো টাইপ রিকশাওয়ালা।
পাশ দিয়ে অন্য রিকশা চলে যাচ্ছে। একবার ভাবলাম একে বলি আরও জোড়ে চালাও। কিন্তু রিকশাওয়ালার অবস্থা দেখে আর কিছুই বললাম না। এর মধ্যেই আমার মামাতো ভাই ফোন দিয়ে ঝাড়ি। আমি কই, এত দেরী কেন এক হাজারটা প্রশ্ন।
রিকশা দিয়ে যাচ্ছি আর দেরীর কারণ বলছি। রিকশা ভাড়া দিয়ে নামার সময় হঠাত করে রাস্তার পাশে চোখ চলে গেল। নীল শাড়ির পড়া মলিন চেহারার এক তরুনীকে দেখলাম। দেখেই মনে হল এই মেয়ে রূপা না হয়েই নয়। কিন্তু সমস্যা হল দূর থেকে আমার অনেক মেয়েই রূপার মত মনে হয় কিন্তু কাছে যেতেই বিভ্রম কাটে! এবারও তাই হবে বলে মনে হল।
তাই এবার আর কাছে যাওয়ার মত কষ্ট করতে গেলাম না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে হল এ অতি অবশ্যই রূপা। দৌড়ে রূপার কাছে যেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর হবে না! প্রস্থানের জন্য উদ্যত হলাম। রূপার সামনে পড়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই।
কত দীর্ঘ সময় পর দেখা হল। কমপক্ষে ৬ বছর তো হবেই। মেঘে মেঘে কত্ত বেলা কেটে গেছে। আমি রূপার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হুট করেই রূপার সামনে এসে দাঁড়ালাম। রূপা আমাকে দেখে ভূত দেখার মত হঠাত চমকে উঠল।
আমি আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন আছিস রে?” রূপা বেশ কিছুক্ষণ অপলক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু বললি? আমি বললাম, “না কিছু না! কিন্তু তুই এখানে কেন?” রূপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, এক বান্ধুবীর বাসায় এসেছিলাম।
আমি বললাম, ভালই তো আছিস। বিয়ের পর তো আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী হয়ে গেছিস।
রূপা হড়বড় বলল, তোর খবর কি সেটা বল? বিয়ে করেছিস নাকি করতে যাচ্ছিস? আমার জন্য তোর সেই আগের পাগলামীগুলা কি এখন ভুলেও মনে পড়ে? তুই আমার সাথে দেখা করার জন্য তো একদিন আমার হলের সামনে চার ঘন্টা ধরে দাঁড়ায়ে ছিলি। মনে আছে নাকি? হিহি।
আমি বললাম, হু। আর তুই আমার সাথে দেখা না করে তোর ফ্রেন্ডের সাথে বাইক দিয়ে ডিনার করতে চলে গেলি!
রূপা বলল, বাবু তোমার দেখি সব কথাই মনে আছে। আমি তো ভেবেছিলাম সব ভুলে টুলে গেছিস।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, সব কি এত সহজে ভুলা যায়। আচ্ছা এইসব আউল-ফাউল কথা বাদ দে।
এই শুক্রবারে ফ্রি আছিস? তোর জামাইয়ের সাথে পরিচয় করায়ে দিবি। আজকে একটু বিজি আছি। নাহলে তো আজকেই যেতাম।
অতঃপর আমি রূপার ফোন নাম্বার নিয়ে খালার বাসায় চলে গেলাম। দিন কত দ্রুতই না যায়!
রূপার সাথে আমার শেষবারের মত যখন দেখা হয়েছিল সময়টা ছিল অত্যন্ত অদ্ভুত।
ডুবে যাওয়া সূর্যের আলোতে আকাশের মেঘগুলো কি অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছিল। সেই অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশে রুপার সাথে আমার শেষ কথা হবে এরকম অদ্ভুত সত্য প্রকৃতিদেবী আমার জন্য লিখে রেখেছিল কে জানত! সত্যটা হয়ত অদ্ভুত না। এরকমই হবার কথা ছিল। তবে কোন এক অজানা কারণে আমার মনে হচ্ছিল হয়তবা অন্তমিলটা এমন বেওয়ারিশ ঘুড়ির মত হবে না, হয়তবা অন্তমিলটা এমন শূন্য বা তিক্ত হবে না। কিন্তু মানুষের মনে হওয়াটা আর বাস্তবটা যে এক জিনিস নয় তা আমি সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।
কত অবলীলায় রূপা এসে আমাকে বলল আমি যেন কখনও ওর সাথে কোন রকম যোগাযোগ না রাখি! প্রথমে ভয়ানক একটা ধাক্কা খেলেও জানতাম এরকম বলাটাই হয়ত স্বাভাবিক! তাই হয়ত যতটুকু ধাক্কা খাওয়ার কথা ঠিক ততটুকু খেলাম না! আমি আস্তে করে বললাম, তুই কি সত্যিই মন থেকে বলছিস? রূপা খুব ধীরে সুস্থে উত্তর দিল- হু। আমি বললাম, আচ্ছা দোস্ত আবার একটু চিন্তা করে দেখ না। আমি তোকে হুটহাট করে কি সব বলছি জানি না। অসম্ভব টেনশনের মধ্যে ছিলাম। বাসায় এত্ত ঝামেলা।
তারওপর পরীক্ষায় খারাপ করলাম। আর তুই বললি তোর পক্ষে রিলেশন করা সম্ভব না। খালি ফ্রেন্ডশীপ রাখতে চাস। আর তোর সাথে ফ্রেন্ডশীপ রাখা আমার পক্ষে কষ্টকর ছিল দেখে বলে ফেলেছিলাম তোর সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপ রাখা সম্ভব না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোর সাথে কথা না বললে আমি বাঁচব না।
তুই জাস্ট ফ্রেন্ড হিসেবেই থাক!
রূপা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমার চেহারাও ভাল না, ব্যবহারও ভাল না। কাজেই ধরে নে তুই বেঁচে গেছিস। আর আমি ফ্রেন্ড ছাড়া অন্য কাউকে সময় দিতে পারব না। তুই তো এখন আমার ফ্রেন্ড না। কাজেই আমি আর তোর কোন কথা শুনতে চাই না।
তুই চুপ থাক। আর আজকের পর তোর সাথে আমার কোন কথা হবে না। মনে থাকে যেন।
অতঃপর দুইজন দুই দিকে রওনা দিলাম। একই ইউনিতে পড়তাম বলে এরপর দুটি বছর মাঝে মাঝেই দেখা হয়েছিল।
কিন্তু কখনও কোন কথা না। এটাই হয়ত বা শেষ কথা হওয়ার ছিল। কিন্তু প্রকৃতি দেবীর খেলা বোঝা কতই না মুশকিল। আবার রূপার সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেও পারি নি।
অথচ শুরুর দিন গুলো কতই না বর্ণময় ছিল।
আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল কলেজে। মেয়েদের সাথে কথা তেমন একটা হত না। ওর সাথে কলেজ জীবনে একবার বা দুইবার সামনা সামনি কথা হয়েছিল। কোন এক অলৌকিক উপায়ে আমরা একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাই। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে টুকটাক কথা বার্তা শুরু হয়।
ফেসবুক তখন নতুন এসেছে। ওর সাথে ফেবুতেই কথা বেশি হত। বন্ধুর চেয়ে বেশি কথা কখনও ওর সাথে আমার হয় নি। সত্যি কথা হল একেবারে শুরুতেই ওর প্রেমে পড়েছিলাম। কেন পড়েছিলাম তার কারণ আমি বহুবার বের করতে চেয়েছি।
কিন্তু, বরাবরই ব্যর্থ হয়েছি। কেন যেন আমার মনে হত এই পৃথিবীতে আমার মায়ের পর কেউ যদি আমাকে বুঝতে পারত সে রূপা। বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে ওকে কিছুই বলি নি। কিন্তু কোন এক মধ্যদুপুরে পাগলের মত হড়বড় করে সব বলে ফেলি এবং ঠিক তক্ষুণি ও আমাকে “না” বলে দেয়। তারপরও দিনের পর দিন ওকে জ্বালিয়ে যেতে থাকি।
কিন্তু ওর “না” আর পরিবর্তন হয় না।
সময় কাটতে থাকে। আমি জানি যে আমার পুরো জগত জুড়ে রয়েছে তার জগতে আমার বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নাই। এটা হয়ত ঈশ্বরের খেলা। ঈশ্বরের সব খেলা মানুষ বুঝতে পারে না।
আমিও পারি নি...
ঠিক আরেকটি অদ্ভুত বিকেলে রূপার সাথে দেখা। কত সময় পর দেখা! পরের শুক্রবারেই রূপাকে ফোন দিলাম। হলুদ শাড়ি পড়া রূপাকে কি সুন্দরই না লাগছে। আমি রূপার স্বামীকে খুঁজছি। আশে পাশে কোথাও নেই।
রূপাকে জিজ্ঞাসা করলাম তার স্বামীর কথা। জিজ্ঞাসা করতেই ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। জানলাম ওর স্বামী অন্য একটি মেয়েকে পছন্দ করত। বাবা মার ইচ্ছায় রূপাকে বিয়ে করেছে। ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
বলতে বলতে রূপা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আমি রূপার হাতটা ধরে বললাম, তোর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়গুলোতে তুই তোর পাশে আমাকে থাকতে দিস নি। এখন কি দিবি?
রূপা চোখ মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মানে?
আমি খুব শান্ত গলায় বললাম, তুই যেদিন বলেছিস তোর সাথে কোন যোগাযোগ না রাখতে সেদিনের পরও প্রতিটা দিন আমি তোকে স্বপ্নে দেখে গেছি। হয়ত তোর জগতে আমি কোনদিনও ছিলাম না, কিন্তু তুই আমার ছিলি, আছিস এবং থাকবি। আমি তোকে বিয়ে করতে চাই।
রূপা ধরা গলায় বলল, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুই...
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, হুম। অনেক আগে থেকেই মাথা খারাপ। তোর ভাগ্যই খারাপ! ঈশ্বর যদি তোর সাথে একটা পাগলের মিল রেখে থাকে তাইলে আমি কি করব তুইই বল!
রূপা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইল। ধরা গলায় বলল, তোর কবিতা লেখার খবর কি?
আমি বললাম, তুই আমাকে “না” বলার পর থেকে লেখালেখি ভুলে গেছি।
রূপা বলল, গর্ধব! বেকুবের মত কথা বলবি না।
আমি বললাম, না। একেবারেই সত্যি কথা। তবে এখন আবার লেখতে পারব বলে মনে হয়। কিন্তু কেউ পড়বে বলে মনে হয় না! তবে কেউ পড়ুক না পড়ুক আমার কিছু যায় আসে না।
তুই পড়লেই হবে।
রূপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে। সূর্য প্রকৃতিতে অদ্ভুত রঙের খেলা সৃষ্টি করেছে। রাস্তায় কয়েকটি বাতি জ্বলে উঠেছে।
আমি রূপার হাত ধরে সোডিয়াম আলোর ভেতর দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি জীবনটাতো আসলে খারাপ না! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।