অরূপ রাহীর গান শোনার জন্য আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে বেশ অনেক দিন আগেই। অনেকটা অন্যরকম এবং কিছু-কিছু ক্ষেত্রে চেনা-অচেনার আবহে আমি কিছুটা দ্বিধান্বীত এবং একই সাথে মুগ্ধ। মুগ্ধতার ব্যাপারটা হয়তো খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু দ্বিধার কি কারন সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। গানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মতামত যদিও কোনো মুল্য রাখেনা, তবুও ব্যক্তিক ধারনা দেয়াকে আমি দোষের কিছু দেখি না।
এটা বলার কারন, একটু আগেই আমি গানের সাথে দ্বিধার কথা উল্ল্যেখ করেছি।
মুগ্ধতার কথাই প্রথমে বলি। গানের ক্ষেত্রে বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা, মানে সাধারণ শ্রোতারা মুগ্ধতার ছোয়াঁ পাচ্ছি। এই ছোয়াটা মুলত কিছু শিল্পী এবং কিছু ব্যান্ড গ্রুপের কল্যাণে। প্রচলিত ব্যান্ড সংগীতকে যারা খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না, তারাও হয়তো খেয়াল করলে দেখবেন বর্তমানে বাংলা-গানের রূপ-রূপান্তরে এই সব শিল্পী এবং ব্যান্ড দলের অবদানটাই সবচাইতে বেশি।
অরূপ রাহী’র প্রথম অ্যালবাম যেহেতু ‘লীলা’ নামক ব্যান্ড গ্রুপের প্রয়াস, সে হিসেবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে লীলা এবং অন্যান্য ব্যান্ডের তুলনামুলক বিচার করাটাই শ্রেয়। আমি এখানে শুধুমাত্র ব্যান্ড সংগীতকেই নিয়েই কথা বলছি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যান্ড সংগীতের ব্যাপক প্রসার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবং এতো সব ব্যান্ডের মধ্যে মাত্র কয়েকটি ছাড়া অন্যদের গানে অহেতুক আস্ফালন ছাড়া কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
ব্যান্ডের গানকে যদি কবিতার মতো দশকে ভাগ করে দেখি, তাহলে বোধহয় ভালো হয়।
যুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে আশির দশক, নব্বইয়ের দশক এবং বর্তনাম দশক- এই ৩ভাগে যদি ভাগ করা হয় তাহলে আলোচনা করা বেশ সহজ হয়ে যায়। প্রথম দুই দশকের কথা বাদ দিয়ে বর্তমানের কথা বলি। বাংলা, দলছুট, শিরোনামহীন, মেঘদল এবং এখনো পর্যন্ত চেনা-অচেনার মধ্যে থাকা লীলা- নামগুলো আমাদের সবার কাছেই পরিচিত। প্রশ্ন আসতে পারে মাত্র এই কয়েকটি ছাড়া অন্যদের কথা কেনো বলছিনা। কারন আমার কাছে এই কয়েকটি ব্যান্ডকেই কাছাকাছি ঘরানার মনে হয়েছে।
কোনো না কোনোভাবে এই দলগুলোকে অন্য ব্যান্ড থেকে আলাদা করা যায়। অন্য ব্যান্ডগুলোকে নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। আপাতত এদের নিয়েই বলি।
বাংলা এবং লীলার ক্ষেত্রে অবশ্য আর একটা ব্যাপারে মিল পাওয়া যায়, সেটা অবশ্যই লালনের গান। লালনের গানের বাইরে অরূপ রাহীর গান, কফিল আহমেদ এবং শিরোনামহীন ব্যান্ডের গানের সাথে একই কাতারে রাখা যায়।
যদিও অরূপ রাহীর গানে পদাবলী, কৃষ্ণলীলা, কীর্তনের আবেশও বেশ প্রবল। যে ব্যাপারগুলো আবার কফিল আহমেদ বা শিরোনামহীনের মধ্যে নেই।
লীলা’র প্রথম অ্যালবাম ‘নায়ক’। গানগুলোর দিকে একটু চোখ বুলাই- ১। আমি তোমার মাঝে ২।
বন্ধুর প্রেমে ৩। দাওয়াত ৪। লন্ঠন ৫। নায়ক ৬। পাখি ৭।
পিয়াসা ৮। সোনার কিষাণ ৯। ইয়াসমিন ১০। তুই আসলিনা
এই ১০টি গানকে আবার ভাগ করে দেখতে ইচ্ছে করছে। প্রথমত- শুধুই লীলার গান, দ্বিতীয়ত- লালান ও সিরাজ সাইঁ এর গান, তৃতীয়ত- লোকজ, পদাবলী, কৃষ্ণলীলা, কীর্তনের আবেশ মিশ্রিত গান।
শুধুই লীলার গান- আমি তোমার মাঝে, দাওয়াত, নায়ক, সোনার কিষাণ, ইয়াসমিন, তুই আসলিনা।
লালান ও সিরাজ সাইঁ এর গান- পাখি, লন্ঠন।
লোকজ, পদাবলী, কৃষ্ণলীলা, কীর্তনের আবেশ মিশ্রিত গান- বন্ধুর প্রেমে, পিয়াসা।
কোনো এক অদ্ভুত কারনে লালনের কিংবা সিরাজ সাইঁ এর গানের প্রতি বর্তমান ব্যান্ডদলগুলোর আগ্রহ বেশ লক্ষ্যনীয়। আমার যতটুকু মনে হয় বাংলা ব্যান্ড আসার আগে এই ব্যাপারটির এত প্রসার ছিলো না।
আনুশেহ্ আনাদিলের কল্যাণে লালনের গান আজ তরুণদের মুখে-মুখে। আর মজার ব্যাপার হলো এর পরেই বেশ কিছু বাউল শিল্পীও লালানের গানের অ্যালবাম করে আলোচিত হন। এই মুহুর্তে যাদের নাম মনে পরছে- বিমল বাউল, টুনটুন বাউল। এর পর লালন নামে একটি ব্যান্ড দল ও গৌ্রব নামের একজন শিল্পীর কথা মনে পড়ছে। তবে অরুপ রাহীর কন্ঠে লালনের গান বেশ পরিণত।
বাংলা’র ক্ষেত্রে লালনের গানে সুরের যে অসামঞ্জস্যতা নিয়ে কথা উঠেছিলো, অরুপ রাহী সে দিক থেকে পুরপুরি মুক্ত বলা যায়। যদিও পাশ্চাত্য মিউজিকের ব্যাবহার তিনিও করেছেন।
রাহী’র কন্ঠে বহুল প্রচলিত সুরে এবং বহুবার শোনা ১টি গানের সামান্য কথার পরিবর্তীত রুপ- ‘বন্ধুর প্রেমে খাইছিগো ধরা আমি’। গানের শেষ দিককার লাইন- ‘অরুপ রাহীর জীবন গেলো প্রেমে ধরা খাইয়া’। লালন, সিরাজ সাইঁ, রামপ্রসাদ প্রমুখদের এই নিজনামধারা অরুপ রাহীর ভেতর সঞ্চারিত না হলেই মনে হয় ভালো হত।
পদাবলী আর কীর্তনের আবেশ মিশ্রিত গান- ‘পিয়াসা’। লালন, সিরাজ সাইঁ প্রমুখ ছাড়া বর্তমান ব্যান্ডগুলো সাধারণত অন্য দিকে যেতে চায় না (নিজেদের গান ছাড়া) । সেই ক্ষেত্রে অরুপ রাহীকে ব্যতিক্রম বলা যায়। তবে এক ধরনের সুখকর আশংকাও কাজ করে- দেখা গেলো ব্যান্ডগুলো না এখন থেকে পদাবলী, কীর্তন, কৃষ্ণলীলা, রামপ্রসাদী, মনমোহন, স্বরূপানন্দ কিংবা এই ধারার গানেও আগ্রহী হয়ে উঠেন।
লীলার নিজস্ব গানের কথায় আসি।
‘আমি তোমার মাঝে, সোনার কিষাণ, ইয়াসমিন’- এই ৩টি গানের কথাই বলতে ইচ্ছে করছে। লীলার নিজস্ব গানের কথা বললে, রাহী’র গাওয়া অ্যালবামের সেরা ৩টি গান। আমি তোমার মাঝে ঝিরঝিরিয়ে বইতে চেয়েছি- অ্যালবামের প্রথম গান। অসাধারণ কথা এবং সুরের মিশ্রণে অনবদ্য। একই কথা প্রযোজ্য সোনার কিষাণ ও ইয়াসমিন গানের ক্ষেত্রেও।
শুরুতেই বলেছিলাম দ্বিধার কথা। দ্বিধাটা তাহলে কোথায়। দ্বিধাটা এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে। আমার মনে হয় এক্সপেরিমেন্ট দোষের কিছু না। কিন্তু লালন বা এ ধরনের গানের ব্যাপক অন্তর্ভুক্তি আমার কাছে ব্যাবসা ছাড়া কিছু মনে হয় না।
একটা ব্যান্ড তাদের অ্যালবামে শুধুমাত্র নিজস্ব গানগুলোই রাখুক। যদি লালন বা রামপ্রসাদ নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছে হয় তবে শুধু সেটা নিয়েই করুক।
লালন নিয়ে ব্যাবসা আর কতদিন? দ্বিধা এ কারনেই!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।