-এই খালি যাবা ?
-কই যাইবেন ?
-দক্ষিন খান ।
-যামু ।
-কত?
-১১০ টাকা ।
-কি? রিকশা নতুন চালাও নাকি ? ফাজিল কোনখানের ।
-গালি দেন কেন ? হ্যাঁ ?? না যাইলে না যাইবেন ।
তাই বইলা গালি দিবেন ? আমি কি আপনার চাকর নাকি?
-চুপ! শালা ছোটলোকের বাচ্চা । যেইখানে আছস ওইখানে বসে থাক । দেশে রিকশার অভাব পড়ে নাই ।
-অভাব পড়ে নাই ত আমারে কন ক্যা ? আমি ছোটলোক আপনে কি??
-এক থাপ্পর মারব । মুখে মুখে কথা কস ।
আমারে চিনস ?
- দরকার নাই আমার আপনারে চিইন্যা । যেইদিকে জাইতাসেন ওইদিক যান ।
-আর একটা কথা বলবি ধরে থানায় নিয়া যাবো কিন্তু ।
-এহ! আইছে আমার লাটসাহেব!
-অই চাচা যাইবা ?
-কই যাইবেন চাচা?
-দক্ষিন খান ।
-যামু ।
-কত?
-১০০ দিয়েন ।
-কি কইলা? উত্তরা ৪ থিকা দক্ষিনখান ১০০ টাকা ? ভাড়া শিখাও নাকি আমারে ?
-ভাড়া শিখামু কেন ? যেইটা ভাড়া সেইটাই ত কইলাম ।
-যেইটা ভাড়া সেইটা না ? তোমার মিয়া হাতই নাই একটা । একহাতে টানবা আবার ১০০ টাকা ভাড়া চাও । রাস্তায়ই তো আমার বিশ মিনিট নষ্ট করায় দিবা ।
৫০ টাকা দিব যাইবা ?
-এইটা কি কন সাহেব ? এইটা সম্ভব না । কেউ যাইব না ৫০ টাকায় । আচ্ছা ৮০ টাকা দিয়েন, উঠেন ।
-এহ! লেংড়ায় লেংড়ায় টানবা আবার ৮০ টাকা দিমু তোমারে । আমার সময়ের কি দাম নাই নাকি ?? ৭০ পাবা চল ।
-আচ্ছা চলেন । তয় , অন্যকেউ হইলে যাইত না ।
:::::::::::::::::: ২ মিনিট পর ::::::::::::::::::
-শালার বাঙ্গালীর উন্নতি কোন দিনই হবে না ! আজাইত্যা ফকির গুলা ফকিরই থাইকা যাবে । যত্তোসব ন্যাড়ো মাইন্ডেড ননসেন্স পাবলিক !
-কি হইছে সাহেব ?
- আর বইলো না চাচা, এক রিকশা ওয়ালারে বললাম ভাড়া এত কেন ? কয়কি জানো ?
-কি কয়?
-কয় যাইলে যাইবেন না যাইলে নাই । আমি কি আপনার চাকর নাকি?
-হে হে ।
মেজাজ খারাপ আসিল হয়তো পোলার ।
-আরে নাহ! এইগুলার স্বভাবই খারাপ বুঝলা চাচা । সারাদিন ওই এক জায়গায় বইসা থাকবে কিন্তু পাঁচ টাকা কম রাখবে না । যত্তোসব রাবিশ!
-কি করব কন? রিকশা ওয়ালা বইলা কি আমগোর কাছ থিকা কোন কিছুর দাম কেউ কম রাখে? আমগোরও তো সংসার আছে । পেট তো মানে না ......
- আচ্ছা চাচা সামনে একটু রাখ তো ওই দোকানটার সামনে ।
ফ্লেক্সি করা লাগবে মোবাইলে ।
জাগর চৌধুরী ফ্লেক্সি করছেন । একে একে ৫টা নাম্বার দিলেন ২টাতে ২০০ টাকা করে ,একটায় ১০০, বাকি ২ টায় ৫০ করে লোড করলেন । তারপর দুই পকেট থেকে ২ টা মোবাইল বের কয়রে চেক করলেন ।
হ্যাঁ টাকা গেছে ।
এরপর একটা হাতে নিয়ে কল দিলেন কাউকে । ৩ বার দেয়ার পর ওপাশ থেকে সাড়া এল ,
-হ্যালো ?
-হ্যাঁ জান তোমার দুটো নাম্বারে ২০০ করে পাঠিয়েছি । দেখতো গেল কিনা ।
-দেখছি ।
হ্যাঁ এসেছে ।
তুমি কোথায় ?
-এইতো আমি অফিস থেকে বেরুলাম মাত্র । তুমি রেডি হও আমি আর পনের মিনিটের মাথায় পৌছে যাব । গাড়িটার ব্যাবস্থা হল ?
-হুম । দুলাভাইকে বলে রেখেছিলাম কালকে । কিছুক্ষনের মধ্যে পাঠিয়ে দেবে বোধহয় ।
তুমি জলদি কর । আজ কিন্তু লেট হলে চলবে না ।
- আরে ধুর কি যে বল । আমি এই তো পৌঁছে গেলাম বলে ।
-আচ্ছা রাখি
এরপর আরেকটা রিং দিলেন দ্বিতীয় সেটটা থেকে ।
এইবার অন্যএকটা নাম্বারে । প্রথমবারই রিসিভ হল ,
-হ্যালো ভাইয়া?
-হ্যাঁ , মারুফ কই তুই ?
-আমি এইযে বাসার দিকে যাচ্ছি , ভার্সিটি থেকে । তুমি ?
-আমি অফিসে । তোর নাম্বারে ৫০ টাকা দিয়েছি। দেখতো গেল কিনা ।
-দাঁড়াও দেখি ।
হ্যাঁ আসছে । তুমি ফিরবা কখন ?
-আমার আসতে দেরি হবে ।
-আজ না তোমার আম্মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ডাক্তারের কাছে ?
আমি পারব না । আজকে জরুরী মিটিং এ আটকেছি বুঝলি ? ফিরতে অনেক রাত হবে ।
তোরা খেয়ে নিস । আর আম্মাকে তুই নিয়ে যা না চেম্বারে ।
-আমি? আমার তো কালকে এক্সাম আছে । আচ্ছা, নাহয় গেলাম, কিন্তু চেম্বারটা কই? চিনি না তো । তোমার পরিচিত ডাক্তার তুমি গেলে সুবিধা হত না ?
- আরে টেস্টের রিপোর্টগুলোর সাথে দেখ চেম্বারের কার্ড আছে ।
তুই চিনবি , গ্রীন লাইফ হাসপাতালটার আগের গলিটার মুখেই মেঘনা ফার্ণিচারের বড় দোকানটার অপজিটের তিনতলা বিল্ডিংটায় ।
না পেলে পরে ফোন দিস । আর আম্মাকে বলিস আমার জন্য ওয়েট না করতে , আমার দেরি হবে । কাজের চাপ বেশি আজকে ।
রিকশাওয়ালা ফ্যালফ্যাল কয়রে তাকিয়ে আছে তার দিকে ।
বুঝতে পেরে জাফর চৌধুরীর ভুরু কুচকে উঠল । বিরক্ত বঙ্গিতে এসে রিকশায় উঠলেন ।
-সাহেব কথা গুলা রিকশায় উইঠাই তো বলতে পারতেন । পনের মিনিট তো এইখানেই শেষ ।
-জ্ঞান দাও নাকি ? হ্যাঁ ? আমার কি সময় তোমার কাছ থেকে নিতে হবে ??
-কি বলেন? আমি কি তা বলসি? বললাম রিশকায় উইঠ্যাই ত কইতে পারতেন কথা গুলি ।
-বেশি বুঝ? টাকা গেল কিনা সিউর হইতে হবে না? আন্দাজে লাফ দিয়ে চলে গেলে দোকানদার বেটা এতোগুলি টাকা মেরে দিলে কিভাবে ধরব ? কালকে শুক্রবার । দুই দিনের মধ্যে এইদিকে আসাও হবে না । এতোগুলা টাকা গেলে কি তুমি দিবা ?
-কি যে কন সাহেব /
-তাইলে বকবক কম কর ।
:::::::::::::::: ৫ মিনিট পর ::::::::::::::::
-চাচা সামনে বামের দোকানটায় একটু রাখ তো । ১ মিনিট ।
একটা জিনিস নিতে হবে ।
জাফর সাহেব রিকশা থেকে নেমে সুপার শপটায় ঢুকলেন । রিকশাওয়ালা বুড়ো অপেক্ষা করতে থাকলো ...... ১ মিনিট, ২মিনিট ... ৫ মিনিট ... দশ মিনিট পার হয়ে যাচ্ছে । তার যাত্রির দেখা নেই । নিজেকে বেকুব মনে হচ্ছে তার ।
অবশেষে, ১৫ মিনিটের মাথায় জাফর সাহেব বেরিয়ে এলেন হাতে রেপিং পেপারে মোড়া বড় দুটো প্যাকেট নিয়ে । হন্তদন্ত হয়ে রিকশায় উঠে বসলেন । বসেই হুকুম ,
-চাচা একটু তাড়াতাড়ি টানো তো । অনেক দেরি হয়ে গেল ।
-একটু পরপর নাইমা হারায় গেলে ত দেরি হইবই ।
( বিড়বিড় করে )
দশ ফুট না যেতেই রিকশা বামে চাপানো হল । জাফর সাহেব খেকিয়ে উঠলেন, আহহা!! আবার কি হল ?!
-চেইন পইড়া গেসে ।
-ওহ গড! কপাল আমার এতো খারাপ । কোন দুঃখে যে মরতে উঠছিলাম এইটায় !!
চেইন লাগানো হল । বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা একহাতে যথাসম্ভব দ্রুত টানার চেষ্টা করছেন রিকশাটাকে ।
-চাচা কি ক্ষতি যে করলা, জানো না । আর তোমাদের কি বলমু । সময় জ্ঞান থাকলে তো আর রিকশা চালাইতা না ।
- আমি ক্ষতি করসি আপনার ?!? এইগুলা কি কন সাহেব ?
-আহহা ! এতো কথা কও কয়েন রিকশাটারে তো গরুর গাড়ি বানায় ফেলছ ! সব যাইতাসে তোমারটা আর আগায় না ! একটু টানো না এইবার ।
-কি করুম? একটা হাতে আর যে পারি না ।
তার উপরে দুপুরে কিছু খাইবার পারি নাই । শরীলে কুলাইতাসে না ।
- শরীরে কুলায় না তো বাইর হও কয়েন রিকশা নিয়া । ঘরে শুইয়া থাকলেই পারো । যত্তোসব ! খালি তো পারো মানুষরে লেট করায় দিতে ! রাবিশ !
নিজের একমাত্র ডানহাতটা আর শীর্ণ পাদুটোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে রিকশাটাকে দ্রুততর করবার চেষ্টা করে ফারুক মিয়া ।
এই মিত্থ্যে অনৈতিক কথাগুলো তার পুরোন রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ......
:::::::::::::::::: ১০ মিনিট পর ::::::::::::::::::
-চাচা ডানের গেটটায় রাখ ।
বিশাল ৬ তালা বাসাটার মেইন গেটের সামনে দাঁড়ায় রিকশা । তাড়াহুরো করে নেমে যান জাফর চৌধুরী । নেমেই হন্তদন্ত করে গেটে ঢুকে পড়েন । পেছন থেকে ফারুক মিয়া চেঁচায় ,
-আমার ভাড়াটা ?? ভাড়া দিলেন না ??
-১ মিনিট দাঁড়াও চাচা ।
ভাংতি নেই জিনিস গুলো রেখে এসে দিচ্ছি তোমার ভাড়া ।
-তাড়াতাড়ি কইরেন সাহেব ! কয়েকটা ট্রীপের টাইম মাইরা দিসেন । একটু তাড়াতাড়ি করলে আরো দুইটা ট্রীপ দিমু ।
-১ মিনিট বসো ।
জাফর সাহেব সিঁড়ি দিয়ে উঠে হাড়িয়ে গেলেন প্রাসাদ সম বাড়িটার ভেতর ।
বৃদ্ধ ফারুক মিয়া কপালের ঘাম মোছেন গামছা কোমড়ে বাঁধা গামছাটা দিয়ে । অপেক্কায় থাকেন ...... ১ মিনিট , ২ মিনিট ...... ৫ মিনিট ...... ১০ মিনিট ...... ২০ মিনিট পেরিয়ে যায় । বাড়ির বিশাল গেট আর খোলে না । ফারুক মিয়া একবার ভাবে লোকটার আসলেই সময়জ্ঞান নেই, প্রত্যেক বার সে ২ মিনিটের কথা বলে ২০ মিনিট পার করছে ।
পেরিয়ে জয়ায় আরো ১৫টা মিনিট !
বাসাটার গেটটা খুলে যায় ! কিন্তু, কোন জাফর সাহেব বেরিয়ে আসেন না ।
বেরিয়ে আসে একটা ঝকঝকে টয়োটা প্রাইভেট কার । দাড়োয়ানের ধমকে ফারুক মিয়া রিকশাটাকে একপাশে চাপিয়ে রাখেন ।
সুন্দর গাড়িটা ফারুক মিয়া আর তার রিকশাটাকে পাশ কাটিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যায় । তাতে বসে আছে ভারি মেকাপ নেয়া এক মহিলা , আর তার পাশে......... !!
ফারুক মিয়ার বুকটা ধক করে ওঠে .........
পাশের লোকটা তার একটু আগের সময়সচেতন ফুলবাবু যাত্রীটি -জাফর চৌধুরী !!!
ফারুক মিয়া চেঁচাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু শুকনো গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যসে আওয়াজ ছাড়া কিছুই বের হয় না ।
গাড়িটা ক্রমে দূরে চলে যাচ্ছে ।
সেই সাথে ফারুক মিয়ার চোখ জমা হচ্ছে দু-ফোঁটা অশ্রু !
বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস ! আর মুখ দিয়ে একটা শব্দ -
"অমানুষ" !!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।