কারাগারের বিষ, রাজনীতির মধু
ফকির ইলিয়াস
=======================================
আবারও বিষিয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। শেখ হাসিনাকে সাবজেলে থাকাকালীন সময়ে খাদ্যের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়েছিল। এমন দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরী। তিনি বলেছেন, সাবজেলে কর্মরত মেয়েরা নাকি তা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছিল। তাই সে খাদ্য গ্রহণ করেননি তিনি।
বরং চিড়া-মুড়ি খেয়ে কালাতিপাত করেছিলেন।
এই সংবাদটি কাঁপিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের রাজনীতির ভিত। এত বড় সর্বনাশের কথা। আমরা পত্রপত্রিকায় ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে অনেক কথা শুনেছি, পড়েছি। কিন্তু কোন নেত্রীকে প্রাণে বধ করে রাজনীতির মাঠ তৈরির চেষ্টা কারা করেছিল, কেন করেছিল?
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর বক্তব্যের পরপরই বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেছেন, তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া নাকি আগেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন তার খাদ্যে বিষক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়েছে। এই রহস্য উন্মোচনে সরকারি তদনত্দ দাবি করেছেন ড. খন্দকার মোশাররফ। তিনি আরও বলেছেন, মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নে এমন জঘন্য কাজ করতে যারা উদ্যত হয়েছিল তাদের বিচার হওয়া দরকার।
হত্যার রাজনীতি ও গোপন ষড়যন্ত্র করে মসনদ দখল করার পাঁয়তারা বাংলাদেশে নতুন নয়। এটা এর আগেও হয়েছে।
পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকা- একদিনে সাধিত হয়নি। এই ষড়যন্ত্র পাকানো হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। পরে তারাই এর বেনিফিশিয়ারি হয়েছে, যারা গোপন ষড়যন্ত্রের ইন্ধনদাতা ছিল। ফ্রন্ট লাইনার্সরা তাৎক্ষণিক কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়ে পালিয়ে গেলেও (অথবা তাদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেও) ক্ষমতাভোগী সুদূরপ্রসারী চিনত্দার বাহকরা থেকে যায় বাংলাদেশেই। পঁচাত্তর-পরবর্তী ঘটনাবলিই এর উজ্জ্বল সাক্ষী।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সামরিক জানত্দারা তাদের শিকড় গেড়ে বসার সুযোগ পায়। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এই চার মূলমন্ত্রে যে বাহাত্তরের সংবিধান বাংলাদেশে রচিত হয়েছিল তা অনেকেরই চক্ষুশূল হয়ে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে। কারণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যারা মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিল, তাদের প্রত্যাশা বাসত্দবায়নের লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছিল এই সংবিধান। যারা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা ছিল, তারা এই ধর্মীয় সম্প্রীতির সংবিধানকে মেনে নিতে পারেনি কোনমতেই।
তমদ্দুনপন্থি মুসলিম লীগ কিংবা মৌলবাদপুষ্ট জামায়াত কিভাবে বাংলাদেশী জাতীয়বাদী চেতনার ঘাড়ে সওয়ার হয়েছিল তা কারও অজানা নয়। বাংলাদেশে বিষ মাখানোর রাজনীতির শুরম্ন সে সময় থেকেই। বলা প্রয়োজন এসব বিষ প্রয়োগকারীরা এতটাই জঘন্য ছিল এরা জেলে জাতীয় চার নেতাকে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে জেলবন্দি হত্যার মতো নির্মম ঘটনার নজির স্থাপন করেছিল, যা ছিল চরম বর্বরতার শামিল।
দুই.
বাংলাদেশে বিষ মাখানো রাজনীতির প্রতিযোগিতা একদিকে চলেছে আর অন্যদিকে মধুলোভী ভ্রমরেরা এর সদ্ব্যবহার করেছে ভোগের ভূখ- হিসেবে। আমরা সদ্য একটা বিতর্ক দেখছি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে।
এর নিষ্প্রাণ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বেশ কিছুদিন ধরে নানা ধরনের বিতর্কমূলক কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েও তার দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সিদ্ধানত্দের নানা সমালোচনা করেছেন। তিনি আক্রমণ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিয়োগ বিষয়টিকেও। এর জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমেদ। মোট কথা একটি 'টাগ অফ ওয়ার' চলছে আওয়ামী লীগে।
এর কারণ কি? এর কারণও হচ্ছে সেই ক্ষমতার মমতা। আবদুল জলিল ওয়ান-ইলেভেনের পর দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন। এরপর তিনি দাসখত দিয়ে বলেন, আর রাজনীতি করবেন না। এর আগে মন্ত্রী থাকাকালেও তার বিরম্নদ্ধে এনত্দার অভিযোগ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। 'ডেডলাইন এপ্রিল' দিয়ে তিনি নিজেই রাজনীতিতে এপ্রিল ফুল হয়েছিলেন।
এর ব্যর্থতার দায় নিয়ে সে সময়ই তাকে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। তিনি তা করেননি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি এমপিও হয়েছেন দলের করম্নণায় এবং লীগের স্রোতের জোরে।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে 'দলীয় মুখপাত্র' করার মাধ্যমে শেখ হাসিনা মূলত এই বার্তাটিই আবদুল জলিলকে পৌঁছে দেন-তার এবার অবসর নেয়া দরকার। তারপরও ক্ষান্ত হননি আবদুল জলিল।
প্রকারান্তরে তিনি এখন দলের সভাপতিকেই আক্রমণ করে যাচ্ছেন এবং দলের শাসনতন্ত্র ভঙ্গ করছেন। শুধু ঐক্য দেখানোর জন্য শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন না, তা দেশবাসী জানেন এবং বোঝেন। কিন্তু আর কত চলতে পারে আবদুল জলিলের রাজনৈতিক বিবেক বর্জিত বক্তব্য? ক্ষমতার মধু না পাওয়ায় জলিলের এই যাতনা লজ্জার তিলক এঁকে দিচ্ছে প্রজন্মের কপালে। তারা এই কলঙ্ক তিলক ধারণ করতে মোটেই আগ্রহী নয়।
একটা কথা মনে রাখা দরকার, এই দেশ ও জাতির অগ্রগতি থামিয়ে দিতে এখনও একটি মহল ব্যাপকভাবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
যারা এই দেশের স্টক এক্সচেঞ্জ উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে কিংবা দেশজুড়ে সিরিয়াল বোমা হামলার পরিকল্পনা করছে এরা কারা? আজ যারা রাজনীতির মধুলোভী ভ্রমর সেজে আবোল-তাবোল বলছেন, তারা মূলত এই অপশক্তির হাতকেই শক্তিশালী করছেন। গণতন্ত্রের বিরম্নদ্ধে মানুষের মন ও চেতনাও বিষাক্ত করে তুলছেন।
বাংলাদেশে সমৃদ্ধি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা মোটেই সহজ কাজ নয়। এর প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রাজনীতিতে ভোগবাদিতা। এই ভোগবাদীদের কারণে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মূল্যায়ন পাচ্ছে না।
দেশে কানসাটের মতো ফুঁসে উঠছে বারবার মানুষ। শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে মানুষ যখন চরমভাবে নিগৃহীত হতে থাকে তখন তার আর ঘুরে না দাঁড়িয়ে উপায় কি? আশুলিয়ায় এমন সাম্প্রতিক ঘটনা তারই সাক্ষী বহন করছে।
জাতীয় স্বার্থই যদি রাজনীতিকদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয় তবে, এর ঐক্যে সবাইকে এক কাতারে দাঁড়ানো দরকার জরুরিভাবে। টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু নিয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া একটি চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনার উচিত বর্তমান সরকারকে সর্বতোভাবে প্রস্তুত করে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে এ সমস্যাটি আশু সমাধান করা।
কারণ এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের সাধারণ মানুষ। তাই এই ইস্যুটিকে রাজনীতিকরণ না করে, দলীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার প্লাটফর্ম হিসেবে না দেখে গণস্বার্থে রক্ষা করা উচিত প্রধান দুটি দলেরই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি নিউইয়র্কে এক সমাবেশে বলে গেছেন, তার সরকার টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করবে। দেশের মানুষ এর প্রতিফলন দেখতে চায়। সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা এখন জেলের দেউড়ি ঘুরে মুক্তির বাতাস খাচ্ছেন।
সর্বশেষ সংযোজন শাজাহান সিরাজ। কি এক আশ্চর্য চিত্রপ্রবাহ। জেলে যাচ্ছেন আর জামিনে স্থায়ী মুক্তি পাচ্ছেন তারা। এর চেয়ে রাজনীতির মধুচাক আর কি হতে পারে?
নিউইয়র্ক, ১ জুলাই ২০০৯
------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। ঢাকা।
৩ জুলাই ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- ক্রিস গ্রুমভকো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।