আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাঝি



দাদা দাঁড়ডা এইবার আমার কাছে দেও। তুমি অনেক বাইছো। মাঝি নাতীর কাছে দাঁড় ছেড়ে দিতে দিতে বলল; আরে মগা দাঁড় আমি আর কৈ বাইলাম। সংসারের দাঁড় তো তোর দাদী একলাই বাইয়া গেল। নাতী দাঁড় ধরে দাদারে জিগায়; আচ্ছা দাদা, দুইন্যার এত কাম থুইয়া তুমি মাঝি হইলা ক্যান? দাদায় ম্যাচবাত্তি আর বিড়ির প্যাকেট কোমড়ে লুঙ্গির ভাঁজে প্যাচাতে প্যাচাতে কয়; আরে আমি আর মাঝি হইলাম কেইম্তে! এই পারের মানুষ হেই পার করি।

আসল মাঝি এই জগৎ-এর মানুষ হেই জগৎ-এ পার করে। দুই ঠোঁটের ফাঁকে বিড়ি, তার উপর আবার সামনের কয়েকটা দাঁতও নেই মাঝির। কথা ষ্পষ্ট বোঝা যায় না। নাতী মাঝির কথা বুঝতে না পেরে উদাস ভাবে আকাশের তারা দেখে। মাঝি এতক্ষনে বিড়ির অর্ধেকে পৌঁছে গেছে।

সেটা আন্দাজ করতে পেরেই বোধহয়, নাতী একটু মনোযোগের আশায় আবার জিগায়; আইচ্ছা দাদা, আন্ধার হইলেই কেবল আসমানে তারা দেহা যায় ক্যান? এবার দাদা বুঝলেন, নাতীর হাতে বিড়ির অর্ধেক দিয়ে বললেন; নে টান দে; দাদা এবার নাওয়ের পিছনে হাল ধরে বসে। গলা খাকড়া দিয়ে থুথুর দলা পানিতে ফেলে দাদা বললেন; আরে মগা আন্ধার হইলেই তো আলো মাইনষ্যের চোখে লাগে। নাতী কথার আগা মাথা কিছুই বুঝে না। আর কথা না বাড়িয়ে বৈঠা হাতে নিতে হাত বাড়ায়। দাদা বাঁধা দিয়ে বলে; বাদামে বাতাস লাগছে, অহন বৈঠা টানতে অইব না।

নাতি কয় দাদা বৈঠা টানলে আমরা আরো তাড়াতাড়ি ঘাটে যামুগা। দাদায় কয়; আরে, কত কিসিমের যন্ত্র বানাইল মাইনষে! দেহছ না! খুইস্যার পুতে নাওয়ে মিশিন লাগাইছে! হের নাওয়ে উইঠ্যাও মাইনষে কয়, এই ছেমড়া জোরে চালা। বেবাক কত জলদী চলে, হেও মাইনষে কয় জোরে চালাইতে। কারো কাছে টাইম নাই! আমরা বেলা উডার আগে ঘাটে গিয়া করুম কী। এবার নাতী আরাম করে বসে।

ঠোটের ফাঁকে বিড়ি না থাকায় কথা বুঝতে তেমন কষ্ট হয় না। বেলা ডোবার সাথে সাথে ইঞ্জিন চালিত নৌকা গুলোর দৌরাত্ম্য অনেকটা কমেছে। বাতাসে শব্দ কম। পানিতে ঢেউ নেই। এই সময়ে নৌকায় সব চেয়ে বেশী আরাম।

শীত নেই। আবার ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কাও নেই। নদীর তীর স্পষ্ট দেখা যায়। এখানে ওখানে দু একটা জেলে নৌকায় হারিকেনের আলো। বুড়ো আগ বাড়িয়ে কথা বলে না।

কিন্তু জিজ্ঞেস করলে সব কথার উত্তর দেয়। এভাবে নীরব বসে থাকতে নাতীর ভাল লাগে না অথচ করার মত কোন কাজও নেই। দাদী বুড়োকে একা আর নৌকায় দিতে চায় না। বিশেষ করে রাতের বেলায়। তাই বলে কয়ে নাতীকে সঙ্গে দিয়েছে।

তো নাতী এবার একটা বেশ কঠিন প্রশ্ন করে বসল। অবশ্য ভেবে বলেনি। এম্নিই এসে গেছে। আচ্ছা দাদা, এত ভাড়া থাকতে তুমি মরা টানো ক্যান? এবার দাদু একটা বেশ কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হল। স্মৃতি হাঁতড়ে কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে যেভাবে মরা টানা শুরু করলো তাই বলতে শুরু করলো।

হুন, তোগ জন্ম তহন হয় নাই। কইলে বিশ্বাস করবি না। যুদ্ধের সময় গাঙ্গে দিয়া কস্তুরির চনের মত মরা মানুষ বাইস্যা গেছে। বেবাক মাইনষ্যে ডরে চোখ ঢাইক্যা রাখছে। মরার লাহান নিরীহ আর কোন কোন কিছু আছে! তয় মানুষতো! একটা কবরের ব্যবস্থা তো করা লাগে! এই মাইনষের লইয়া কবর দিতে শুরু করলাম।

আমার লগে গেরামের আরো অনেক মানুষ আইল। আইচ্ছা দাদা হুনছি হিন্দু মরলে পোঁড়া দেয়। তোমরা বুঝলা কেমনে যে, বেক মরা মুসলমান আছিল। নাতীর প্রশ্নটা ফেলে দেয়ার মত নয়! বুড়ায় কয়; হোন বেক্কলের কথা! মরা মানইষ্যের কাছে জিন্দাগো একটা দায়, মানুষের সন্মানে হেরে বিদায় দেওন হইল বড় কথা। হিন্দু মুসলমান পরে, মানুষ বইল্যা কথা।

হাত পাও মাথা কারটা কার লগে গেছে হেই খবর কে কইব! মাটির ভিতরে গাতা কইরা,এক গাতায় কত মরা শোয়াইছি! হের পরে তুমি খালী মরা টানো! দাদায় কয় আরে না রে, মানুষ কি পরতেক দিন মরে! তয় মরা মাইনষ্যেরে আর ডরাই না। নাতী আবার জিগায় তো মরা টানা শুরু করলা কবে থেইক্যা? আরে হেই কথা আর কইস না। শেখেরে মাইরা মিলিটারী ক্ষমতায় আইল। বালুচর গেরামের তালেব পরধানের মাইয়া গেছিল শাড়ি পিন্দা মতলব কলেজে। বেলাউজের ফাঁক দিয়া পেট দেখা যায় দেইখ্যা, মিলিটারীরা দিছে আলকাতরা লাগাইয়া।

সোমত্ত মাইয়া লাজে-সরমে কাইন্দা কাইট্টা বাড়ি মাথায় তোলছে। তালেব পরধানের বড় ছেলে গেছিল মিলিটারিগো হেই কথা জিগাইতে। হের পরের দিন তালেব পরধান গিয়া পোলার লাশ আনতে কত হাতে পায়ে ধরল মিলিটারীগ! আমি নাও বাইন্দা ঘাটে বইয়া আছি। দেহি তালেব পরধান বেক মাঝিরে জিগায়। কিন্তু কেউ লাশ নিয়া যাইতে রাজী হয়না।

আউলা-ঝাউলা মানুষটারে দেইখ্যা বড় মায়া হইল। আমি সামনে গিয়া কইলাম, পরধাইনা পোলারে নিয়া আসেন আমি আফনেগো বাড়ি লইয়া যামু। পরধান্ আমারে বুকে ধইরা ছোড পোলাপাইনের মত দিল কাইন্দা। হের পর থেইক্যা কেউ মরার ক্ষ্যাপ নিতে কইলে মানা করবার পারি না। দাদা রাইতে বিয়ালে নাওয়ে লাশ লইয়া; কোট্টে গাঙ্গের পানি ভাইঙ্গা, উজান তেনে ভাটিত যাও।

তোমার ডর করে না? মরারে ডরাই নারে ভাই! ডর হইল জিন্দারে লইয়া। গেল বার ওছমানের পোলার লাশ লইয়া নাওয়ে আমি একলা। ক্ষেত বেইচ্চা ছেড়ারে সৌদি পাঠাইছিলো। জুয়ান পোলাডা কেইম্নে জানি গেলগা মইরা। মাইনষে কয় টেহার শোক পুত্র শোক।

অহন ওছমানের শোক ডবল। এক কিস্তে বিশ হাজার না কয় টেহা বলে পাঠাইছে। যেই কয়টা টেহা জেবে আছিল, এরফোট থেনে লাশ নাও ঘাটে আন্তে আন্তেই নাই। ওছমানের মাথা ঠিক নাই, হেই কালে। হেয় লাশের লগে যাইতে চায়।

আমি হেরে কইলাম; তুই গাড়িত উইট্টা তরাতরি বাইত যা। বেক্কলে কয় কি, বাইত গিয়া করুম কি! আমি কইলাম আরে বেক্কল ছেড়ার মায়তো বাইত একলা, হেরে সামাল দিব কে? মায়ের তেনে পোলার দরদ এই দুইনাইত আর কার আছে। তুই বাইত জা, তরে ধইরা মাইয়াডা কান্দ্যা-কাইট্টা বুকটা খালি করবো। বুড়ো এবার বিড়ি আর ম্যাচ নাতির হাতে দিয়ে বলে; নে ভাই একটা বিড়ি ধরা। নাতি বিড়ি ধরাইতে ধরাইতে বুড়ো আজলা ভরে নদীর পানি মুখে দেয়।

গামছা দিয়ে মুখ মুছে আবার পুরোনে কথায় ফিরে আসে। তয় লাশের লগে তার লাগেছ তুইল্যাদিয়া ওছমানে গাড়িতেই গেছে। গাট্টি-বোচকাত বিদেশী সিল মারা। নাও ধলপরের কদ্দুর আগে কালির বাজারের তেপোতায় মেঘনা তেনে পদ্মার গলায় হান্দাইছে। এমন সময় ডাকাইত পড়ল।

লাইট মাইরা দেহে বিদেশী বাক্স। বন্দুক ধইরা কয় “বুড়া জানে বাঁচতে চাইলে টু শব্দটা করবি না। “ আমি কইলাম বাজানেরা বড় বাক্সটায় পোলার লাশ, ছোট বাক্সে হের কাপড় চোপড়। ক্ষেত বেইচ্যা সৌদি গেছিলো কাড়ি কাড়ি টেহা কামাইবার লাগি। অহন লাশ অইয়া ফেরৎ আইছে।

কইলে বিশ্বাস করতি না, হেরা ছেড়ার লাশটা রাইখ্যা বেক হেগ নাওয়ে তুইল্যা নিল। ডাকাইতের কি কোন মায়া ধর্ম আছে, দাদা। লম্বা টান দিয়ে বিড়াটা এবার দাদার হাতে দেয় নাতী। বিড়িতে জুইত কইরা টান দেয় বুড়ো। মানুষের কামড়া-কামড়ি দর্শকের মত দাঁড়িয়ে চোখের সামনে দেখতে থাকে।

নাতি এবার আসল কথায় আসে: আইচ্ছা দাদা এত দূর তেনে তুমি মাইনষের মরা আইন্যা দেও, বেকতের আবার টেহাও থাহে না। তো তোমার চলে কেইম্তে। বুড়ো এবার নিজের কথায় ফিরে এল। ভাইরে ওমর ফারুকের নাও গাঙ ভইরা ফালাইত। গেরামের বেবাক মর্দা বইঠার তালে জারি গাইতো।

দৌড়ে হের নাও পরতেক বছর থাকতো আগে। বেবাক নতুন চর দখল করতো হেয়। পরতেক চর দখলের সময় গন্ডায় গন্ডায় লাশ পরতো। আমারে কইতো হরু, চরতো জাগে নাই, তোর কাম বাড়ছে। থানাত নতুন দারোগা আইলে মাইনষে কইতো এই বার ওমর ফারুকের খবর আছে।

যেই কড়া দারোগা আইছে! ওমর ফারুক কইতো, আরে টেহা দেখলে কাঠের মূর্তি আক করে। দারোগায়তো মানুষই। মরলে আমার কবরে টেহা দিছ, আমি ফেরেস্তাগরেও ঘুষ দিমু। জমি জমা দালান-কোঠা, টেহা-পইসা, বেক থুইয়া হেও খালি আতে সারে তিন আত মাটির তলে গেছে। আমিও খালি আতে যামু।

পানির উপড়ে ভাসতে ভাসতে, পানি ঠেইল্যা খাই। মাইনষ্যের মরা এই পাড় তন ঐ পাড় করি । লাশের ঘরে মাইনষের শোক, কান্দা-কাটি; এর মাইধ্যে টেহা-পইসার কতা কই কেম্নে! মাটি দিয়া আইয়া পরি। গাঙ্গের পানিতে নাও, গাও-গতর ধুইয়া বাড়ি যাই। হেগো শোক কমলে, হাপ্তা দুই হাপ্তা বাদে যা পারে আইন্যা তোর দাদীর কাছে দিয়া যায়।

দরা-দরি খেছা-খেছি পারি নারে ভাই। হের লাইগ্যা মরা টানি। মানুষ জিন্দা থাকতে সাপের মতন, সিদা অয় না। মরলে সিদা অয়। এবার একটু দম নিয়ে কাঠের কফিনটির দিকে দৃষ্টি রেখে বলে; এই যে দেখ কত কতা কইতাছি! গইন্যায় কোন জব দেয়? জিন্দা থাকলে কত কতা কইতো! কতো চালাকী করলো! গেরামিন থেইক্যা টেহা নিছে।

হেই টেহা দেওনের লাগি আবার টেহা আনছে আশা-র তেনে। আশা-র টেহা দেওনের লাগি আবার টেহা নিছে বেরেকের তেনে। বর্গা ক্ষেতে বিলাতী ধান লাগাইছে। ধানডা ভালাই আছিল। ক্ষেতের দিগে চাইলে চক্ষু জুড়ায় যায়গা! সার, ওষুধ পানি দিতে দিতে গইন্যার জান শেষ।

ধানের ছড়ি আইছে। গইন্যায় মনে লয় এই ঠেলায় বেবাক ঋণ শোধ কইরা দিতে পারব। এর মইধ্যে শুরু অইল বৈশাগ্যা গাদলা। পানি আর তুহানের ঠেলায় গেলগা বান্ধ ছুইট্টা। অহন গইন্যার আম ও গেল ছালা ও গেল।

চক্ষের পলকে বেবাক ধনের জমি পানির তলে। হ, দাদা, গেরামের মানইষ্যে বুক থাপরায়া কানছে। নিজের দেখা দুর্দশার কথা মনে পড়ল নাতীর। এই ফাঁকে একটু দম নিল বুড়ো। কিন্তু গইন্যা কাকু মরল কেম্বায়? নাতীর কৌতূহল থামে না! তয় বেক চাষী ত আর গইন্যার মতন বর্গা ক্ষেত করে নাই।

হেগো গেছে এই বারের ধান। কিন্তুক গইন্যার বেরেকের দেনার লাইগ্যা বেডারা বাড়ি ছাড়ে না। এন্দা ঘরে দিনকে দিন দানা-পানি নাই। চুলার ভিতরে বিলাই ঘুমায়। উপায়-আন্তর না দেইক্ষ্যা গামছা গলায় হাক্কার মাইধ্যে ঝুইল্যা গেছে গইন্যা।

দারোগা-পুলিশ তার লাশ নিছে। কাইট্টা-ছিঁড়া আতুরী-ওজুরী কইলজা-গুরদা মজক বেক রাইক্ষ্যা দিছে। তার বউ আইয়া কান্দে, লাশটা আইন্না দেওনের লাইগ্যা। লাশটা আইন্না দিলে মাডি দিবি কেইম্তে! মুদ্দারের কাপড় দিব কেডা? কবরের বাঁশ পাবি কৈ? কে করব কবর? গরিবের মইরাও শান্তি নাই। হ দাদা গরীবের মইরাও শান্তি নাই! তো অহন গইন্যা কাকুর লাশ নিয়া আমরা করুম কি? বুড়ো সুখটান দিয়ে বিড়ির পাছাটা পানিতে ফেলে দিয়ে বলল: ঘাটে গিয়া লাশটা নামাইয়া, গইন্যার বউরে খবর দিমু।

আরঙ্গে কত মানুষ আইয়ে যায়, হেগ কাছে দুই-চাইর পইসা সাইয্য চামু। কাফনের কাপড়টা কিন্তে পারলে, গেরামের কেউ না কেউ একটা বাশঁ তো দিবই। মাটি দিয়া দুই-চাইর পইসা বাঁচলে গইন্যার বউটার আতে দিয়া আমু। আমরা গরীব মানুষ, এর তেনে বেশী আর কি করতে পারমু রে ভাই।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।