কত অজানারে!
আমার এইসব আব্জাব লেখা যারা পড়েছেন তাদের নিঃশ্চই আমার বুদ্ধি শুদ্ধির ব্যপারে একটা ধারনা হয়ে গেছে। তার পরও বলি, আমি যে কি চীজ্ তাতো আমি জানিই। আর ফার্স্ট ইয়ারে (আমরা বলি ওয়ান ওয়ানে) থাকতে এই চীজের উপর একটা পুরু মিওনিজের আস্তরনও ছিল!(স্বাক্ষী আমার ৬০ ক্লাসমেট আর হলের বন্ধু আর বড় ভাইরা) তো এই চীজ আর মিওনিজ মিলে কিভাবে খেয়ানৌকার মাঝি হয়ে গেল সেই ঘটনা নিয়েই এই লেখা।
তখন আমি লেভেল ওয়ান টার্ম ওয়ানে। চেহারা ছবি এতই আনইম্প্রেসিভ যে আমার বাবাও মাঝে মাঝে সন্দেহ করে আমি মনে হয় কোন গ্যারেজে অথবা লেদ মেশিনের ওপারেটর হিসেবে পার্ট টাইম জব করি! এমনকি এই এখনো আমার ড্রেস-আপ গেট-আপ ঐ রকমই।
ঘটনা টা ঘটেছে আমাদের গ্রামে। তাও আমার এই চেহারার কারনেই মনে হয়! বিচ্ছিন্ন ভাবে বাবা মা প্রায়ই গ্রামের বাড়ি গেলেও পুর পরিবারসহ যাওয়া হয় বছরে দুই তিন বার। আমার বাবা আমার দাদার, দাদা তার বাবার, এবং আমি আমার বাবার বড় সন্তান হওয়াতে, এত বড় জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হয়েছে যে, আমার কোন কাজিন খুজে পাওয়া দুস্কর! তাই গ্রামে গেলে আমি একা একাই থাকি। আমার বড় ছেলে অথবা মেয়েরও (যদি কখনো হয়!) এই দুর্ভোগ পোহাতে হবে। তবে আমাদের গ্রামের পাশ দিয়েই গেছে মধুমতি নদী।
ঠিক ছোট বেলায় অনেকের মুখস্ত করে লেখা আমাদের গ্রাম রচনার মত। আমার রুটিন কাজ প্রতিদিন শেষ বিকালে (কবিরা বলে গোধুলী বেলায়) নদীর পাড়ে যাওয়া আর প্রায় গভীর রাত পর্যন্ত থাকা। গ্রামে কারেন্ট নাই তাই সত্যিকারের জোৎস্নার আলোয় নদীকে দেখি।
সিজনটা মনে নেই। তবে তখন মধুমতি প্রায় অপার্থিব রূপ ধারন করেছে।
শুধু মনে আছে নদীর দুই ধার এমনকি মাঝখানে জেগে থাকা চরও নীল চাদরে ঢাকা। শরিষার মৌসুমে হলুদ হয়ে যেতে দেখেছি কিন্তু ধু ধু মাঠ নীল হয়ে জেতে দেখিনি এর আগে! পরে শুনেছি এগুল হচ্ছে তিলের ফুল। ঐযে যে তিলে তেল হয়, এবং যে তিল কে আমরা প্রায়ই তাল করে ফেলি। সেই তিল! নদীতে দ্বিতীয় লোক বলতে কিছু অলস জেলে। আসলে তারা সারা দিন কষ্ট করে মাচা টাইপের এক জাল পাতে সারা নদী জুড়ে, এর পর সারারাত অপেক্ষা, আবার কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয় শেষরাতের দিকে।
এ সময়টুকু তাদের নৌকা আর হাল বইঠাও অলস পড়ে থাকে।
তো আমার এক ফুফা করলেন কি, এদের এই আলসেমি ভাঙ্গানোর জন্যই কিনা, জেলেদের বলেকয়ে আমাকে একটা মাঝারি সাইজের নৌকা আর বৈঠা জোগার করে দিলেন। এর পর চললো দুই ঘন্টার ট্রেনিং সেশন। সে আমাকে স্রোতের মধ্যে নৌকা... আরো কি কি যেন বলতে চেস্টা করে। আর আমি বলি, “হা হা , এই সবতো আমি জানিই, যদি স্রোতের বেগ এত হয়, নৌকা আর বাতাসের বেগ এত হয় তাহলে নৌকা এত ডিগ্রি আঙ্গেলে...” আমার ফুফা অবাক হয়ে তাকিয়ে চোখদিয়েই যেন বলতে থাকে ‘আরে এই গর্ধবটা বলে কি!!’ যাই হোক শিখে ফেললাম নৌকা চালানো!
এর পর থেকে প্রতিদিনই নদীতে যাই আমি।
মাঝে মাঝে ছোট বোনটাকে নিয়ে যাই। ও নৌকায় বসে গান করে। তীব্র জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় চারদিক। নদীর পানিও চিক চিক করে চাঁদের আলোয়! তার মধ্যে নীল চাদরে ঢাকা চর। এই সব অপার্থিব সৌন্দর্য ধারন করার মত লেখনি আমার নেই!
তো একদিন আমার বোনদের নিয়ে যাই নি।
একটু রাতও হয়ে গেছে মনে হয়। হঠাৎ গান শুনতে ইচ্ছা হল। যেই নিজের হেড়ে গলায় ‘মন মাঝি তোর বৈঠা...’ টান দিয়েছি। ওমনি প্রতিবাদ করার জন্যেই কিনা, নৌকাটা ভীষন দুলে উঠলো। ডুবো চরে আটকে গেছে! অনেক কষ্টে মষ্টে যখন গান গাওয়ার অপচেস্টার প্রায়শ্চিত্ত করেছি।
তখনি আমাদের গ্রামের দিকের পাড় থেকে এক জন লোক হাক দিলো “মাঝিইই...” আমিও ডানে বায়ে তাকিয়ে মাঝিকে খোজার চেস্টা করতে থাকি! এর পরে বুঝতে পারলাম মাঝিটা আর কেউ না আমিই! আগেই বলেছি আমার চেহারা সুরতের কথা। এখন দেখি আমি মাঝি হিসেবেও চলে যাই বেশ! গেলাম তাদের কাছে। আসে পাশে কোন নৌকা নাই। ওদিকে এই লোকের ভাগ্নে বিয়ে করেছে নদীর অই পাড়ে। আজ রাতেই ভাগ্নে আর ভাগ্নে বৌ কে নিয়ে সে ফিরে আসবে আমাদের গ্রামে।
তাই আমার সরনাপন্ন হয়েছে তারা। বাধ্য হয়েই। মামার সাথের লোকটা অবশ্য আমার স্বাস্থ্য দেখে সন্দেহ পোশন করছিল আমি পারবো কিনা। কিন্তু মামা বলে “আরে!এরা জাত মাঝি!!! পারবে না আবার”। (!!!) আমি আবার নতুন মানুষের সাথে কথা বলতে পারিনা।
তাই চুক্তি হল আমিই তাদের নিয়ে যাব এবং নিয়ে আসবো। বিনিময়ে ভাগ্নের শশুর বাড়িতে ভরপেট খাওয়া! সে বাড়ীতে গিয়ে খেলাম ডিম ভুনা আর কি যেন একটা মাছ সাথে মশার কামড় দিয়ে লাল চালের ভাত! প্রায় তিন ঘন্টা বসে থাকতে হল আমার। মেয়ে বিদায় দেওয়া যে কি ঝক্কি তা টের পেলাম ভাল করে। এক বার মেয়ে যেতে চায়না, একবার মা যেতে দিতে চায়না! সাথে মড়া কান্না!!! নিরাপত্তা জনিত কারনে বৈঠাটা আমার কাছেই ছিল! সবার আগে বৈঠা হাতে নীল মাঠ পেরিয়ে যাবার সময় মাঝি হতে কেমন লাগে তার ভাল পার্টটুকু বুঝে গেলাম! যাইহোক রাত সাড়ে এগারটার দিকে ফিরলাম নদীর ঘাটে।
এর পর ফেরার পালা।
যাত্রী আমি ছাড়া আরো চারজন। নৌকা চালাতে গিয়ে আমার মাঝি সেজে ভন্ডামি করার জারি জুরি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। মামার সাথের লোকটা ভাবলো অভাবি রুগ্ন মাঝি তার উপর কম বয়স। মনে হয় পারছিনা! তাই বৈঠাটা সে নিজেই নিয়ে নিল। আর আমি চাঁদের আলোয় বালিকা বধুর তার প্রথম স্বামীর বাড়ী যাবার দৃশ্য দেখতে লাগলাম।
ব্যাক গ্রাউন্ডে অপরূপ প্রকৃতি!!
নিয়ত করে ফেললাম যদি কখনও বিয়ে করি, তাহলে অবশ্যই আমার বউ(স্ত্রী)কে নিয়েও নৌকা চালাবো এই নদীর বুকেই। কোন এক জ্যোৎস্না ভাসা নিঝুম রাতে। জেলে আর জেলেনী সেজে!!!
তবে শুকিয়ে যাচ্ছে আমাদের নদীটা! আর সব নদীর মতই। জানিনা ততদিন নৌকা চালানোর উপায় থাকবে কিনা!! আর আমার স্ত্রীরও এই সব ভাল লাগবে কিনা! আসলে জানিইতো না কে হবে সে!!! এই মাঝি মার্কা ছেলেটাকে ভালই বা লাগবে কার?...!!
বিদায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।