[অনীক আন্দালিব অথবা ছন্নছাড়ার পেন্সিলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশপূর্বক]
ছন্নছাড়ার পেন্সিল তার প্রোফাইলে এই কথাগুলো লিখে রেখেছেন : 'কারো প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রাখার উপায় হচ্ছে তার সাথে কখনো সাক্ষাৎ না করা!'
কথাগুলো হুমায়ুন আজাদের, সেটিও জানিয়েছেন তিনি। যে কেউ তার প্রিয় কোনো উদ্ধৃতি তার প্রোফাইলে ঝুলিয়ে রাখতেই পারেন, কিন্তু কেন বেছে বেছে নির্দিষ্ট ওই কথাগুলোই নির্বাচন করলেন, তা নিয়ে আমরা নিশ্চয়ই একমুহূর্ত হলেও ভাবি। অন্তত আমি তো ভাবি। ছন্ন'র প্রোফাইলের ওই লেখাগুলো পড়ে মনে হয়- ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার বয়ানই লিখে রেখেছেন তিনি এবং অভিজ্ঞতাটা তার জন্য শকিং ছিলো। ধারণা করি, কোনো এক ভার্চুয়াল সম্পর্কের মানুষকে কাছ থেকে দেখে তার ভালো লাগেনি, আশাহত হয়েছেন বা বেদনাদায়ক কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে।
মোট কথা, দেখা হওয়ার আগে ভার্চুয়ালি যে শ্রদ্ধাবোধটা ছিলো, সেটা মিলিয়ে গেছে।
কথাগুলো আমাকে ভাবিয়েছে, এবং আমার মতামতটা দাঁড়িয়েছে অন্যরকম। মনে হয়েছে- দেখা হলেই যার ওপর থেকে শ্রদ্ধা চলে যায়, তার সঙ্গে দেখা হওয়াই উচিত এবং শ্রদ্ধাটা চলে যাওয়াই উচিত।
২.
ভার্চুয়াল সম্পর্ক নিয়ে সমস্যাটা সব সময়ই থেকে যায়! যার সঙ্গে দেখা হয়নি, অথচ প্রচুর কথাবিনিময় হয়েছে, মধুর একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, হয়তো শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে অথবা জন্ম হয়েছে প্রেমের; অথচ দেখা হওয়ার পর সেই অনুভূতিটি আর থাকে না। কেন এমন হয়? হয়, কারণ, ভার্চুয়ালি কোনো মানুষই নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার সুযোগ পান না, বা ইচ্ছেকৃতভাবে প্রকাশ করেন না! ভার্চুয়ালি প্রকাশিত মানুষটি আসলে খণ্ডিতভাবে প্রকাশিত মানুষ, সেই মানুষটিকেই কাছ থেকে দেখতে গিয়ে যখন তার অপ্রকাশিত দিকগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ে তখনই বুকে আঘাতটা লাগে!
ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলো নির্মাণ করার সময় বা রক্ষা করার সময় আমরা ভুলেই যাই- এই মানুষটিও যে কোনো বাস্তব মানুষের মতোই দোষগুণ-ভালোমন্দ মেশানো একজন মানুষ! তার সবকিছুই শুদ্ধ, সবকিছুই সুন্দর হওয়াটা অবাস্তর, যদিও সেভাবেই সে নিজেকে প্রেজেন্ট করছে! এই ভুলে যাওয়াটাই বিপত্তি ঘটায়।
৩.
আমরা যখন তরুণ ছিলাম (কথাটা বলতে অস্বস্তি লাগে। মনে হয়, বুড়ো হয়ে গেলাম নাকি? কিন্তু চারপাশে যখন তরুণতরদের ভিড় দেখি, তখন...), তখনো ভার্চুয়াল সম্পর্ক ছিলো, তবে এখনকার মতো এত সর্বব্যাপি নয়, এমন দুকূলপ্লাবি নয়, এমন প্রভাববিস্তারি নয়। এর কারণ হয়তো এই যে, তখন ভার্চুয়াল সম্পর্ক গড়ে ওঠার জন্য এতসব যোগাযোগ মাধ্যম ছিলো না। সেলফোন আসেনি তখনো, ইন্টারনেটের নামও শুনিনি। শহরাঞ্চলে যাদের বাসায় ল্যান্ডফোন ছিলো (এই সংখ্যাও নগণ্য, এবং যাদের ছিলো, তারা মোটামুটি স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে এটাকে ব্যবহার করতেন), তারা আন্দাজে কোনো নম্বরে চাপাচাচি করে কাউকে পেয়ে যেতো কখনো কখনো, তাদের সঙ্গেই কথা-বলার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতো! আগেই বলেছি, এই সংখ্যা ছিলো অতিশয় নগণ্য।
এর বাইরে সম্পর্কগুলো গড়ে উঠতো চিঠিকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ 'পত্রমিতালি'। 'বিচিত্রা' নামের একটা প্রভাবশালী-অভিজাত পত্রিকা ছিলো, সেখানে 'ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন' নামে একটা বিভাগ ছিলো, যেটিতে অসংখ্য পত্রবন্ধুতার আহ্বান সম্বলিত বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। 'চিত্রবাংলা' নামের একটা প্রায়-পর্নো পত্রিকা ছিলো, সেটার শেষ পাতাগুলো বরাদ্দ থাকতো পত্রতিালির বিজ্ঞাপনের জন্য। পরে চিত্রালী আর ছায়াছন্দ নামের দুটো সিনে-কাগজও এই দলে যোগ দেয়! তবে বিচিত্রার সঙ্গে এদের মানগত পার্থক্যই শুধু ছিলো না, আরেকটি পার্থক্যও ছিলো। বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন ছাপাতে টাকা লাগতো, অন্যগুলোতে লাগতো না।
এইসব বিজ্ঞাপন থেকে কেউ কেউ পেয়ে যেতেন তাদের কাঙ্ক্ষিত বন্ধু, চিঠিবিনিময় হতো, ওই চিঠিই কথা, চিঠিই সম্পর্ক! একেকটি চিঠির জন্য সে কি নির্ঘুম প্রতীক্ষা! হায়, এই ইমেইল-চ্যাট-এসএমএস যুগের ছেলেমেয়েরা সেই প্রতীক্ষার মর্মই বুঝলো না!
৪.
আমার নিজেরও এমন বন্ধু ছিলো! গভীর ভার্চুয়াল সম্পর্ক হয়েছিলো আমার, একজনের সঙ্গে। ঘটনাটা একটু অদ্ভুত! সেই গল্পটিই বরং বলি।
বিচিত্রায় 'কুরুক্ষেত্র' নামে একটা বিভাগ ছিলো। সেখানে যৌথ সম্পর্ক নিয়ে (প্রেম, বন্ধুতা বা দাম্পত্য যে কোনো ধরনের যৌথ সম্পর্ক) নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লিখতেন লেখক-পাঠকরা! আমিও সেখানে একটা লেখা পাঠাই (চোখ কপালে তুলবেন না প্লিজ, ১৯৮৯ সালের কথা বলছি, আমার বয়স তখন মাত্র উনিশ+)! চিঠির ফর্মে লেখা ওই লেখাটিতে আমার ভয়াবহ রোমান্টিক 'চেতনা'র প্রকাশ ঘটে। কিন্তু একটা ভুল করে ফেলেছিলাম আগেই।
কোনো লেখা প্রকাশের জন্য লেখার সঙ্গে বিভাগীয় সম্পাদকের কাছেও 'লেখা প্রকাশের অনুরোধ/আবেদন' জানিয়ে একটা চিঠি লিখতে হতো, সেই চিঠিতে আমি আমার বাসার ফোন-নম্বরটি দিয়ে দিয়েছিলাম! আগেই বলেছি, তখন ল্যান্ডফোন থাকাটা ছিলো স্ট্যাটাস সিম্বল, আমি যে হেদিপেদি ধরনের কেউ নই, রীতিমতো টিএন্ডটি ফোন আছে বাসায়, বিভাগীয় সম্পাদককে সেটি বুঝিয়ে দেবার জন্যই যে চিন্তাটা মাথায় এসেছিলো, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! তো লেখাটা বেরুনোর দুদিন পরই একটা ফোন পেলাম, বিপরীত লিঙ্গের। যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, সে কোনো সাড়াই দিলো না, অন্যদিকে এক 'অচেনা'র ফোন! খুশি হয়েছিলাম বলাইবাহুল্য, কিন্তু 'ভাব' নেয়ার জন্য প্রথমেই জিজ্ঞাসাবাদ- ফোন নম্বর কোথায় পেলেন? -বিচিত্রায় ফোন করে নিয়েছি (সরল স্বীকারোক্তি! মনেও আসেনি যে, আপনি বিচিত্রায় ফোন করে আমার নম্বর চাইলেন, আর ওরা দিয়ে দিলো? মগের মুল্লুক নাকি? কিংবা একজন বিভাগীয় সম্পাদক একজন লেখকের নম্বর একজন পাঠককে দেয়ার নৈতিক অধিকার রাখেন কী না- এইসব জটিল প্রশ্নের ধারেকাছেও যাইনি! যাবো কেন, আমি তো দারুণ খুশি!)
তো, এই মেয়েটির সঙ্গে আমার এই ভার্চুয়াল সম্পর্ক প্রায় পনের বছর টিকে ছিলো। কতো চিঠি, কতো ফোন, কতো উপহার বিনিময়, (ইমেইল আসার পর) কতো কতো ইমেইল! সবই বিনিময় হয়, তবু দেখা হয় না! একই শহরে থাকি দুজন, তবু কেন যেন দেখাটা আর হয়ে ওঠে না। কেন হয়নি, ব্যাপারটা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। যথেষ্ট উদ্যোগ ছিলো না, বলাইবাহুল্য।
প্রশ্ন হলো, কেন ছিলো না!? ভার্চুয়াল মুগ্ধতা নষ্ট হয়ে যাবার ভয়, নাকি অন্যকিছু? সে আমার এমন বন্ধু ছিলো যে, ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিটি লেখা সে সংগ্রহে রেখেছিলো, যার অনেকগুলোই আমি নিজে হারিয়ে ফেলেছি! অনেকবার ভেবেছি, হারিয়ে যাওয়া লেখাগুলো ওর কাছ থেকে চেয়ে নেব, কিন্তু চাওয়ার আগেই সে নিজে হারিয়ে গেল! একদিন ফোন করে প্রচুর কান্নাকাটি সহযোগে জানালো- সে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে, আমার সঙ্গে এই যোগাযোগটা আর কন্টিনিউ করতে চায় না!
আমি কিছু বলিনি!
নতুন জীবন শুরু করতে হলে যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে হয়, তাহলে তো আর কিছু বলার থাকে না!
এরপরও অবশ্য আমি ওকে মেইল করেছি, উত্তর আসেনি। ফোন করে দেখেছি,সেলফোন বন্ধ! আর ল্যান্ডফোন! এই নম্বরে এই নামে কেউ থাকে না!!
এখনো মেয়েটিকে খুব মনে পড়ে আমার। বিশেষ করে লেখালেখিতে কোনো একটা প্রাপ্তিযোগ ঘটলে- ছোট্ট একটা প্রশংসা থেকে শুরু করে বড়ো পুরস্কার- সবই আমার প্রাপ্তি,- ওকে মনে পড়ে! মনে হয়, ও-ই আমার লেখার প্রথম অ্যাডমায়ার ছিলো!
৫.
এই লেখাটি লিখতে লিখতে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো। হয়তো লেখার সঙ্গে কথাটির কোনো যোগসূত্রই নেই! এলোমেলো একটা লেখা, এত যোগসূত্র খোঁজার দরকারই বা কি!
বছর দশেক আগে কর্মসূত্রে কয়েকমাস আমি চট্টগ্রাম ছিলাম। শহরটা আমাকে অসম্ভব মুগ্ধ করেছিলো, কিন্তু আমি ছিলাম একা! চট্টগ্রামে আমার কোনো বন্ধু ছিলো না, পরিচিতজনের সংখ্যাও ছিলো নগণ্য।
ওই অসম্ভব সুন্দর শহরে আমার সময়গুলো তাই কেটে গেছে ভয়াবহ একাকিত্বের মধ্যে দিয়ে। তো, সময় কাটানোর জন্য মানুষ ছিলো না বলে আমি একা একা হেঁটে বেড়াতাম। হাঁটতে হাঁটতেই একসময় পেয়ে গেলাম টাইগার পাস নামক সেই মনোমুগ্ধকর জায়গাটা। ওই রোডটাকে আমার কাছে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রোড! যেন 'হাইওয়ে টু হেভেন' (এই নামে একটা টিভি সিরিয়াল হতো আশির দশকের মাঝামাঝিতে; সেই সিরিয়ালে যে পথটিকে দেখানো হতো, টাইগার পাস রোডটা তারচেয়ে অনেক সুন্দর ছিলো)! কী মায়াময়, নির্জন, সবুজ প্রশান্তিতে ভরা!
আমি আজো আমার একাকিত্বের সময়গুলোতে ওই সড়কটি ধরে হেঁটে যাই, কল্পনায়! একা। হেঁটে যাই, হেঁটে যাই... আর ভাবি- আমার পাশে আরেকজন মানুষ তো থাকতেই পারতো, যার সঙ্গে হয়তো আমার এখনো দেখাই হয়নি, যে আমারই মতো জীবনের কাছে মার খাওয়া, আমারই মতো নিঃসঙ্গ, নির্জনতাপ্রিয়, একা! আমারই মতো 'ভালোমন্দের রক্তমাংসে গড়া, দোষত্রুটিতে গড়া একান্ত এক পার্থিব মানুষ!'
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।