আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালি জাতীয়তাবাদের গণ্ডি কি বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ?

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্মভূমি পূর্ববাংলা। সেই পূর্ব বাংলা যা ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেছিল এবং পাকিস্তানের দাবি তুলেছিল।

কারণ সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাঙ্গালিরা ভেবেছিল, যুক্ত বাংলায় তারা জমিদারি শোষণের অধীন, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে এবং ব্রাক্ষ্মণ্য দাপটের শিকার। ১৯০৫ সালে দেশভাগ হলে, ভারতীয় পণ্ডিত অশোক মিত্র মনে করেন, আর ৪৭-এর দেশভাগ হতো না। সেটা তাঁর মত। বাংলা ভাগে উৎসাহী হয় তারাই, যারা জমিদারি হারানোর ভয়ে ১৯০৫-এ বঙ্গের প্রাদেশিক বিভাজন মানেননি। আবার ঢাকাকেন্দ্রিক প্রদেশ না হলে আজকের শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের জন্ম হতো না, এমনকি পাকিস্তানের মধ্যে থাকলে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সামর্থ্যও তাদের জন্মাতো কিনা সন্দেহ।

১৯৪৭-এ বাঙালি নেতৃত্বের একটা অংশ আবুশ হাশিম, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর চট্টপাধ্যায়রা বাংলা ভাগ চাননি। কিন্তু গান্ধির অসহযোগিতা আর নেহরু-মাউন্টব্যাটেনের চালে তারা পরাস্ত হন। বাংলা ভাগ হয়। সেই থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র সরে আসে কলকাতা থেকে ঢাকায়। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এই জাতীয়তাবাদ একভাবে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের একমাত্র বাঙালি ধরে নিয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটায়।

দুই বাংলার বাঙালিদের জন্য জাতীয়তাবাদ হলে স্বাভাবিকভাবেই দাবি উঠতো, লাহোর প্রস্তাব মেনে ভারত-পাকিস্তানের বাইরে অখণ্ড বাংলাদেশ করবার। সেটা বাস্তব দাবি না হওয়ায় দেশ স্বাধীন হলো একাংশকে নিয়ে। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবকে তাই বারবার ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ভারতের জন্য হুমকি নয়, কেননা তা ভারতের বাঙালিদের জন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে না বা দেবে না। এই যদি হয়, তাহলে পূর্ব বাংলার বাঙালিত্ব কী দিয়ে চিহ্নিত হবে? ধর্ম ছাড়া তো আর কোনো বড় পার্থক্য নাই। সেকারণে পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদ অসম্পূর্ণ আর পশ্চিমবাংলায় সেই জাতীয়তাবাদ ৪৭ সাল থেকেই শ্মাশানবাসী।

তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যত কী? হয় তাকে উভয় বাংলার ঐক্যের ডাক দিতে হবে এবং সেটা পারে এই বাংলাদেশই। সেটা না করা মানে দাঁড়ায় বাংলাদেশকে মুসলিম বাঙালিদের দেশ আর পশ্চিমবাংলাকে হিন্দু বাঙালিদের দেশ মনে করা অর্থাৎ তা হয় দ্বিজাতিতত্ত্বেরই বিজয়। এই মুসলিম বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই নতুন নাম হয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি ও বাংলাদেশি উভয়ই এখানে তাদের জাতীয়তাবাদের মর্মে মুসলিম পরিচয়টিকে ছাড়তে পারেনি, যেমন ভারতীয় বাঙালিরা পারেনি তাদের সম্প্রদায় ও ধর্মীয় পরিচয় ছাপিয়ে জাতীয় ঐক্য করতে। এখানে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, পূর্ব বাংলা অখণ্ড বাংলার মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সংগ্রামী এবং জনসংখ্যায় গরিষ্ঠ।

একইভাবে পূর্বপাকিস্তান পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রগতিশীল ও সংখ্যায় বেশি। কিন্তু সংখ্যা ও চেতনায় এগিয়ে থেকেও কেন পূর্ববাংলা বঞ্চিত হবে এই প্রশ্ন বাঙালিরা পাঞ্জাবিদের করেছে। কিন্তু কেন তারা তাদের দেশের অন্য অংশের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থাকবে, সেই প্রশ্ন তো ভারতকে করা দরকার? কেন দুই ভাইয়ের এক সংসার হবে না। সুকুমার রায়ের ভাষায়, কেন বাঘে (পাকিস্তান) অর্ধেকটা খেল বলে বাকি অর্ধেকটা (পঃ বাংলা) সেই দুঃখে মারা যাবে। প্রশ্নটাকে আমি দেখতে চাইছি ইতিহাসের ময়দানে দাঁড়িয়ে, রাজনীতির মঞ্চ থেকে নয়।

রাজনীতির মঞ্চে এই প্রশ্ন ওঠার বাস্তব ভিত্তি এখন বিশেষ আর নাই। থাকলে কী হতো সেটা অন্য আলোচনা। কিন্তু ইতিহাসের ভেতর রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিক থেকে এটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বরূপ বোঝার স্বার্থে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.