আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি নাকফুল এবং তিনদিন তিনরাত্রির গল্প (৩য় পর্ব )

জলছবি স্মৃতি ছুঁয়ে থাকে হৃদয়াবেগ , ধুয়ে গেছে ধ্বনি তার ; শব্দহীন সময়ের পারাবার ।
২য় পর্ব: Click This Link যা কিছু পরম পাওয়া , অপূর্ব সুন্দর তার স্থায়ীত্ব এত স্বল্প কেন ? ছাড়িয়ে নেয় হীরা নিজেকে । বসে পড়ে বিছানায় । বাদল কোন কথা বলে না , বাইরে তাকিয়ে থাকে , তারপরে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় । উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হীরা , তারপরে বিছানায় প্রায় ঝাপিয়ে পড়ে , সজোরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে ।

বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে ভেসে যায় তার অতীতের অপ্রাপ্তি , আকুলতায় ঘিরে থাকা দু:সময় । একসময় বুঝতে পারে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে । ঘড়িতে দেখে রাত দুটো বাজছে । আজ ঘুমুবে শান্তির ঘুম , স্বান্তনার ঘুম ! ওরা দুজন ছাত্রজীবন থেকে মুখচোরা , লাজুক স্বভাবের । খুব ইচ্ছা করে বলতে বাদলকে সে সব কথা যা অনেকবার বলতে চেয়ে বলা হয় নি ।

লজ্জাই করতে লাগল ভেবে , আর বলবে কিভাবে । মেইল করে দেয়া যায় । বড় করে লিখে দেবে ' আমি তোমাকে ভালবাসি বাদল ' । ল্যাপটপ টেনে নিয়ে বসল , দেখে বাদলের মেইল , সেতো কিছুক্ষন আগেও ছিল এখানে , কখন লিখেছে ? কি লিখেছে ? ভাবতে ভাবতে দেখে লেখা -- ' হীরা , তোমাকে আমি ভাল বেসেছিলাম , ভাল বাসি এবং ভালবাসবো । চিরকাল তুমি আমার , আমারই থাকবে অলিখিত কঠিন সত্য এই ।

আমার মত করে কেউ তোমাকে ভালবাসতে পারে আমি বিশ্বাস করি না । আমি তোমায় সবটুকু ছেড়ে তোমার সবটুকু পেয়েছি , তুমি আমার । ' হীরা কি করবে বুঝতে পারে না , বন্ধু আশিকের কথা মনে পড়ে তার । বলেছিল , বাদল তোমার ভাল লাগাকে সন্মান করে , সে তুমি একসময়ে ঠিক জানতে পারবে । অসম্ভব ভাল লাগা নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্নময় মায়াবী রাতকে তার ভাল লাগার ভাল বাসার স্বাক্ষী করে ।

বাদল নিজের রুমে গিয়ে নিজেকে সংবরন করতে পারে না । কেন শিউলীকে নিয়ে তাকে সংসার করতে হচ্ছে ? কেন সালংকরা বধু হয়ে হীরা তার সংসারে এল না ! কেন এভাবে ছেড়ে থাকতে হচ্ছে হীরাকে --কার অপরাধে ! ভীষন অস্থিরতায় মনে পড়ে গেল আজ রাতেই তো সে হীরার কপালে তার ভালবাসার আদর সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে , হীরা তার ; একান্তই তার । মেইল করতে বসে , লিখে ফেলে যা কিছু মনে এল । তারপর মনে হল আজ রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেবে , সারা রাত অনুভব করবে তার বুকের পূর্নতা । সে হাত রাখে বুকে , কিছুক্ষন আগে মুখ লুকিয়েছিল তার ভালবাসা সেখানে ।

ভরে আছে বুক । জানালার কাছে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে , সে রাতে অ্যাশট্রে ভরে যায় ছাই দিয়ে । ভোরে অনেকক্ষন শাওয়ার ছেড়ে ফ্রেশ হয় । নিজেকে হালকা মনে হয় । কফি খেতে মন চায় ।

মনে পড়ে আজ চলে যাবে হীরা , প্রতিটা মূহুর্ত সে হীরার সাথে কাটাতে চায় । সাতটা বেজে গেছে । হীরার রুমে যেয়ে নক করতে ঘুম ভাঙ্গা চোখে দরজা খোলে হীরা । বলে , এতক্ষন ঘুমুলাম ! সকাল হয়ে গিয়েছে টেরই পাইনি ! সে তো কখনো সদ্যজাগ্রত হীরাকে দেখেনি , কেমন নিষ্পাপ , কমনীয়তা ওর চোখে মুখে ! কেন বিধাতা তার করে দিল না হীরাকে , কেন হীরার প্রতিটা ভোর বাদলের হল না ! বুক ভার হয় । সে পুরুষ মানুষ , তাকে সব্যসাচী হতে হয় ।

বাথরুমে ঢোকে হীরা বাদলকে বসিয়ে রেখে , বেরিয়ে আসে সদ্য ফোটা সতেজ গোলাপ ; পেয়াজ খোসা রঙ শাড়ি আর হালকা প্রসাধনে তাকে দেখে মনে মনে ভাবে বাদল -- এ ফুল তার হাত দিয়ে ফুটেছে ! টিপ পরেনি মনে করিয়ে দিল বাদল , টিপ পরতে গিয়ে হীরা কপালে জায়গা খুঁজে পায়না । খুঁজতে থাকে । বাদল বুঝতে পারে , টিপটা হাতে নিয়ে সে পরিয়ে দেয় আর বলে , গতরাতের সেটা কি আর ঢাকবে কিছুতে ? না তুমি পারবে কখনো ঢাকতে কোন আবরনে ! দুজনে বেরিয়ে পড়ে । নাস্তা সেরে নিয়ে অচেনা পথে হাটে এদিক ওদিক পাশাপাশি । ফুল দেখে ,পাতা দেখে , প্রজাপতি দেখে --সব নতুন মনে হয় ।

নতুন মনে হয় দিনের আলো , আকাশ শীতের বাতাস ; সব , সব কিছু । কেবল দুজন পুরোন তারা অনাদিকালের স্রোতে ভেসে আসা , চলছে নিরবধি । মার্কেটে গিয়ে লিস্ট বের করে দুজনে কেনা শুরু করে , ব্যাগ হয়ে যায় কয়েকটা । শেষে বাদল জুয়েলারী শপে ঢোকে ; নক্ষত্রের ডায়মন্ড নেকলেস দেখাতে বলে । বেশ সুন্দর একটা নেকলেস পছন্দ করে ,হীরাও সুন্দর বলে মত দেয় ।

বাদল যখন বলে এটা সে হীরার জন্য নিতে চাইছে , রাজী হতে পারে না সে । দামটা অত্যন্ত বেশী , সে কথা বলেনা , বাদলকে বুঝিয়ে বলে -- এটা তেমন পরা হবে না , হারিয়ে যাবার ভয়ও আছে । অনুরোধ করে এটা শিউলীর জন্য নিতে । হা হা করে হেসে ওঠে বাদল , বলে তুমি কি জান আমাদের বাড়ীর ত্রিসীমানায় হীরার প্রবেশ নিষিদ্ধ , এমন কি এ শব্দটাও অনুচ্চারিত থাকে । কারনটা তুমি বুঝে নাও ।

আমার অবশ্য লাভই হয় । আমি সমস্ত হীরা আমার করে যত্নে গুছিয়ে রাখি একান্তে । কোন ছোয়া পড়ে না , কারো ছায়া পড়ে না । বাদলের পীড়াপীড়িতে হীরা বলে ওকে নাকফুল কিনে দিতে । চমকে যয় সে , বলে নাকফুল নিয়ে তো অনেক রকম সংস্কার আছে ।

তুমি কেন চাইছো এটা আমার কাছে ? পরতে পারবে নাতো ! হীরা বলে , বেশ দিও না কিনে , ভেবেছিলাম পরবো না , রেখে দেব আমার কাছে । কখনো টাকা পয়সার প্রয়োজন হলে বিক্রি করা যাবে , তুমি সংস্কারের বাহানা করে দেবে না তাই বল । তারপরে হাসতে থাকে বাচ্চা মেয়ের মত । সবচেয়ে দামী আর সুন্দর হীরার নাকফুলটা কিনে দেয় হীরাকে । বাদলের ইচ্ছে হচ্ছিল নক্ষত্রকে বলে বিশেষ একটা নাকফুল তৈরী করাতে শুধু হীরার জন্য ।

শার্টের দোকানে ঢুকে কাল শার্ট খোঁজে হীরা সাদা স্ট্রাইপ দেয়া বাদলের জন্য । কাল শার্ট কেন জানতে চাইলে হীরা বলে তাকে , সেই যে ছাত্র ছিলে ক্যাম্পাসে কলেজের মাঠে কাল শার্ট পরে একজন মানুষ পায়ের উপর পা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছিলে -- সে ছিলে তুমি । আবার যুগ পার করে যখন দেখা দিয়েছিলে দেশে এসে সেদিনও পরেছিলে কাল শার্ট । তোমাকে ভাবলে কাল শার্ট পরাই তো চোখে ভাসে । আর তোমাকে মানিয়ে যায় এমন যে মুগ্ধতা কেড়ে নেয় অবসর ।

তোমার কারনে কাল হয়ে যায় আমার প্রিয় রং । শার্ট কেনে , একটা ঘড়িও নেয় বাদলের জন্য , মজা করে । বলে , হাতঘড়িটা পরে থাকলে মনে হবে কে যেন তোমার হাত ধরে আছে শক্ত করে , সে আর কেউ নয় - আমি । রুমে ফেরে , খাবারের অর্ডার দেয় । বাদল বাইরে খেতে চেয়েছিল ; হীরা রাজী হয়নি ।

তার ইচ্ছা সে কাছে বসে খাওয়াবে বাদলকে । মেয়েদের কত রকমের অদ্ভুত ভাল লাগার বিষয় আছে অন্যে কি আর বোঝে ? কেমন উড়ু উড়ু হয়ে যায় হীরা , সূর ভাজে " চঞ্চলা মন আনমনা হয় যেই তার ছোয়া লাগে , ভোরের আকাশে আলো দেখে পাখী যেন জাগে ....." এটা ওটা গুছিয়ে নিতে থাকে । বাদলের ইচ্ছে করে গান শুনতে , সে কথা বলতে হীরা শুরু করে , " তুহি মেরি মান্দির , তুহি মেরি পূজা , তুহি দেবতা হো ,তুমহো দেবতা ...." থামিয়ে দেয় বাদল , বলে অন্য গান গাও তা না হলে থাক , শোনাতে হবে না এ গান । উঠে আসে বাদলের চেয়ারের কাছে সে । বলে জান , তুমি দেবতা হয়ে আছো আমার জীবনে , কত বার ভেবেছি মানুষ হও না কেন ; মানুষ হিসেবে দেখতে চেয়েছি তোমায় কতদিন ,পাইনি ।

কেন বলতো ? বাদল বলে , আমি মানুষ ছিলাম , আছি ; তবে এক দেবীর যোগ্য হতে সাধনা করে যাচ্ছি । তুমি মিথ্যাই দেবতা করে রেখেছো এক স্বার্থপর , আত্মকেন্দ্রিক , অপরিনামদর্শী মানুষকে । দু'জনেই চুপ - পিন পতন নীরবতা । খাওয়া এল ঘরে ; খেয়ে নিল দুজনে । হীরা এটা ওটা তুলে দেয় আর বলে নিজ হাতে কোনদিন রেঁধে খাওয়াতে পারবো কিনা জানিনা , কাছে বসে খাওয়ানোতে সুখ ।

সব গুছিয়ে নিল হীরা ; হঠাৎ কি মনে হতে তার মোবাইল স্ক্রীনে সেভ করে রাখা বাদলের তিনটা মেসেজ দেখাল , যা সে এতবছর ধরে রেখেছে আর প্রতিদিন একবার অন্তত দেখতে ভুলে না । অবাক হয় বাদল ! হিসেব মেলে না , কে কাকে বেশী ভাল বাসে ! চলবে ........
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.