জলছবি স্মৃতি ছুঁয়ে থাকে হৃদয়াবেগ , ধুয়ে গেছে ধ্বনি তার ; শব্দহীন সময়ের পারাবার ।
আগের পর্ব: Click This Link
বাদল চলে যেতে অনেকক্ষন মূর্তির মত বসে থাকে হীরা । নিজের হাতের চামড়ায় চিমটি কেটে দেখে এসব সত্যি কিনা ।
ঘুমের ওষুধ খেয়েছে সে , বেশীক্ষন জাগতে পারবেনা । মেইল চেক করতে বসে দেখে তার বহু আকাঙ্খার মেইল , বাদলের মেইল ।
ক'বছর আগে হঠাৎ করে যখন বাদল অদ্ভুত আচরন করল , ফোন ধরেনা , মেইল করে না ; তখন কতদিন কতবার মেইল বক্স খুলে হতাশ হয়েছে , কিন্তু সেটা খোঁজা ওর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে । এক বন্ধু আশিক তখন অনেক সাপোর্ট দিয়েছে , ভেঙে পড়তে দেয়নি । বলেছে , দেখো বাদল ঠিক একদিন তোমায় ফোন করবে , স্যরি বলবে ; তুমি অপেক্ষা করো ।
সে অপেক্ষা এভাবে শেষ হবে বুঝেছিল কোনদিন !
বাদল লিখেছে , তুমি সেবার মেইল করে জানতে চেয়েছিলে , কেন অমন করেছিলাম , এবার সুযোগ হয়েছে তোমাকে জানাবো সব ।
হীরা বুঝল , রুমে গিয়ে মেইল করেছে সে ।
বাসায় মেইল করল । শালটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল সে । বাদল কি জানে না , বাদলের উপর রাগ করবার মত শক্তি তার নেই , উপায়ও নেই । তবে সেবার মন খারাপ হয়েছিল খুব । কেবলই তখন মনে হত , তার ভাল লাগা অনেকদিন বাদে যখন ধরা পড়েই গেল , বাদল কেন তারপরে হঠাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল আর দুই দেশের অধিবাসী দুজনের সে যোগাযোগে কার কি ক্ষতি হত ! বন্ধু আশিক বুঝিয়েছিল তাকে যে বাদলের পারিবারিক সমস্যা হতে পারে , তার বউ হয়তো এটাকে ভাল ভাবে নেয়নি ।
তারপরেও হীরার কেবল মনে হত একবার বাদল নিজে থেকে ওকে সব জানাবে , ও অপেক্ষা করেছে , জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাই করতো ।
আর বাদল কেন দু:খিত হবে ? সারা জীবনের জন্য সে নিজে দু:খিত বাদলের কাছে । পরিস্থিতির কারনে খালিদকে বিয়ে করে সেই তো পর হয়ে গিয়েছে । আরো যখন মনে হয় বাদলের বউ শিউলী বাদলকে অতটা বোঝে না , বোঝার চেষ্টা করেনা , তখন আর ভাল লাগেনা তার ।
আলো নিভিয়ে শাল জড়িয়ে শুয়ে পড়ে ; ঘুমিয়ে পড়ে অনেকদিন পর বাদলের প্রশান্ত মুখচ্ছবি মনে করে ।
পরদিন যথারীতি সম্মেলন কেন্দ্রে প্রোগ্রাম , লাঞ্চ তারপরে । কে বলবে যে গতকালের ঝড়ের পরে আজকের এই হীরা । আজ ওকে আরো সতেজ সুন্দর লাগছে । লাঞ্চের পরে বাদল দেখা করে জানাল , ইচ্ছা করে তাকে বিশ্রাম নিতে দেবে বলে আর দেখা করেনি । বিকেলে আসবে ।
বিকেলের আগে একটা শাড়ি পছন্দ করে পরে নিল । এবার আর ভুল করেও মনের ভাব , ভাল লাগা বুঝতে দেবে না সে ঠিক করে মনে মনে । বিকেলে চলে এল বাদল । বলল আজ চা খাবে এ ঘরে । তারপরে আবার চুপচাপ ।
কি যেন বলতে চায় বাদল বোঝা যাচ্ছিল ; বলে হীরা তুমি কি কিছু জানতে চাইবে না । হীরা বলে , হ্যা বল শিউলী কেমন আছে ? বাচ্চারা কতটুকু হল ? তোমার লক্ষ্মী ছেলেটা কি কি করে । উত্তর দিয়ে যায় সে । তারপরে বলে , আর কিছু নেই জানবার ? চুপ করে থাকে হীরা । নিজ থেকে বলে যায় বাদল ।
তোমার সাথে অমনি করে যোগাযোগ বন্ধ করবার কথা তো ছিল না ! ফোনে তোমার নামে নম্বর সেভ করা ছিল , শিউলীর চোখে পড়ে তোমার মিসকল । তারপর ও তোমাকে নিয়ে এমন সব অশোভন কথা বলে যে আমার খারাপ লাগে । আমাদের দুজনকে নিয়ে এমন সব কটুক্তি করে যা শোনার কথা না , প্রতিবাদ করতে গেলে সে আরো বেপরোয়া হয়ে যায় ; বাসায় বাচ্চারা ছিল , তাদের সামনে । তোমার আড়ালে হলেও তোমাকে অসন্মান করছে আমি মানতে পারিনি । প্রবাস জীবনে অফিসের দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম ,আর তখন বাসায় ফিরে শিউলীর তোমাকে নিয়ে সন্দেহবাতিক কথাবার্তা আমার ভাল লাগেনি ।
আমার ব্যাপারে তোমার দুর্বলতা তোমার সংসার জীবনকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে সে চিন্তাও ছিল আমার । তোমার ভাল লাগা অসন্মান করতে আমি কোনদিন পারবো না , তবু ভান করে চুপ করে গেলাম । তোমার সব কিছু সহ্য করতে কত কষ্ট পেতে হয়েছে বুঝতে পেরেছিলাম , তবু মনে হত তোমার বিয়ের পরে আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেটা তো কাটিয়ে উঠতে পেরেছি । বল হীরা , তুমি আর কি জানতে চাও ? হীরার খুব ইচ্ছে হল জানতে , কেন শিউলী হীরার বিষয়ে এত স্পর্শকাতর , কি এমন কথা হয়েছে তার বাদলের সাথে হীরাকে নিয়ে যার কারনে শিউলীর এত প্রতিক্রিয়া ; যেখানে বাদল আর হীরার মনে মনে গড়ে ওঠা গভীর সম্পর্ক লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছে যুগ পার করে , সেখানে শিউলীর মন খারাপ করবার মত বিষয়টা কি হতে পারে , জানতে ইচ্ছে হয় । বাদলের কোন্ আচরনে শিউলী এমন করেছে জানতে চেয়েও কিছুই জিজ্ঞেস করা হয় না বাদলকে ।
দেখে অপরাধীর মত চুপ করে বসে আছে বাদল । হীরার বুকটা ভেঙে যায় , মনে হয় বলে , বাদল আমারই তো ভুল ছিল ; আমি খালিদের সাথে সম্পর্কে না গিয়ে অপেক্ষা করতে পারতাম যদিও পারিবারিকভাবে , সামাজিকভাবে আমি অনোন্যপায় ছিলাম । কিছু বলতে পারে না ।
বলে , চল বাদল বাইরে খেয়ে আসি । দুজনে বেরিয়ে পড়ে , খাওয়া সেরে নেয় ।
পরদিন আয়োজকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমনের ব্যবস্থা । ওরা দুজন যাবে না , নিজেরা ঘুরবে সারাদিন । হীরার মনে পড়ে ওর সাথে টিপ নেই পরবার অথচ ইচ্ছে করছে পরতে , বাদলকে সাথে নিয়ে টিপ কেনে । বাদল সুগন্ধী ফুল কেনে একতোড়া । কাল সন্ধ্যায় চলে যাবে হীরা দেশে , পরদিন সকালে তার ফ্লাইট দূরদেশে ।
আর কবে কিভাবে ওদের দেখা হবে জানে না । ঘরে ঢুকে পানি দিয়ে ফুল দানীতে সাজিয়ে রাখে ফুলগুলো । মিষ্টি সুরভীতে ভরে যায় ঘর । হীরা ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে কপালে টিপ পরে , ছেলেমানুষীতে পেয়ে বসেছে তাকে আজ । বাদল লাজুক প্রকৃতির ছেলে ছিল , এখনও তাই ।
চোখ তুলে তাকাতে সময় নিল ; কিন্তু তাকিয়ে আর চোখ সরাতে ইচ্ছে করে না ওর । দুজনের চেহারায় স্বর্গীয় আভা ছড়িয়ে পড়ে , সে আভায় ঘর ভরে যায় ভাল লাগা আবেশে ।
হীরা মনে করিয়ে দেয় রাত দশটা বেজে যাচ্ছে , বাদলের রুমে যাওয়া উচিৎ । জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের রঙ বেরঙের আলোকসজ্জা দেখে ভাল লাগে তার । যেন ওর মনের রঙেরা খেলা করছে চোখের সামনে ওকে ভুলিয়ে রাখতে ! উঠে আসে বাদল ।
ওর পাশে দাড়ায় । ধরা গলায় বলে , কাল সন্ধ্যায় দুজন আবার দূরের মানুষ , তারপরে কি হবে জানিনা । তুমি অনুমতি দিলে একটা ইচ্ছা ছিল আমার পূর্ন করে নিতাম ।
অবাক হয় হীরা , বাদল এমন করে কথা বলছে কেন ? এ কোন বাদল ? বুঝতে পারে না । বলে তোমার কোন ইচ্ছা আমি অপূর্ন রাখতে পারি না , কিছুতে না ।
এত বছরেও কিছু চাওনি তুমি ; তবু একটু বলবে আমায় কি সে ইচ্ছা ! বাদল বলে , তোমার কপালে একটু আদর করবো , আর যখন বলেই ফেলেছি তুমি না করো না । বলে ঘুরে দাড়ায় মুখোমুখি , দুহাতে হীরার মুখটা তুলে ধরে , দেখে চোখ থেকে মুক্তোদানার মত অশ্রু বেয়ে নামছে । রুমের মৃদু আলোয় এক ছায়া সুন্দরী তাকে আলোড়িত করে , ভাঙ্গে ; নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সে । হীরা বলে , জান বাদল , আমি তোমার ভালবাসার আলোতে বেঁচে থাকি , আমার দিন কাটে রাত কাটে সে আলোয় ভেসে , আমি ভাল থাকি , এত বছর ধরে তাই আছি ।
বাদলের ঠোট ছুয়ে যায় হীরার কপাল , হীরার দুচোখেও আদরের পরশ বুলিয়ে দেয় সে ।
বন্ধ চোখে হীরা এক অন্য মানুষ হয়ে যায় । বাদলের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে পরম নির্ভরতায় , তার অনন্ত আরাধনার ঠাই যে !বাদল সব শক্তি দিয়ে দুহাতে জড়ায় ওকে , ভরে রাখে শূন্য বুক ক্ষনিক পাওয়ায় ।
হীরা টের পায় তার মাথায় ঝরে পড়ছে চোখের জল বাদলের , বাদল কি কাঁদতে পারে ! বাদলের বুক ভিজে যায় হীরার চোখের জলে । এমন সুখের কান্না ওরা কখনো কাঁদেনি ; এমন সুখ থাকতে পারে তাদের জন্য বরাদ্দ ভাবতে পারেনা তারা । এ আনন্দ অশ্রুর জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেক বছর ।
চলবে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।