শিশুতোষ যে কোন রচনা।
অনেক অনেক দিনের পুরনো, নানা বিষয়ের ওপর নানা ধরনের বই সংগ্রহ করাটা আমার নেশার মত। তাই সপ্তাহে বেশ ক’বার আমাকে নীলতে যেতে হয়, পুরনো বইয়ের দোকানে। নীলেেতর এক পুরনো বইয়ের দোকানদার শাহজাহান। তার সাথে আবার আমার খুব খাতির।
পুরনো কোন বই পেলেই সে আমার জন্য তা আলাদাভাবে রেখে দিয়ে আমাকে জানায়। আমি এসে যদি পছন্দ হয় তবে কিনে নেই। অবশ্য এ জন্য সে বইয়ের দামের সাথে একটা ভালো পরিমাণের বখশিশও পায়। আর আমি এমনও অনেক পুরনো বই কিনি যেটার অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হবার পর্যায়ের। অন্য কেউ সে বই কিনবে না।
সে বই আমি কিনে নেই বলে পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে আমার একটা আলাদা গ্রহণযোগ্যতা(!) আছে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে যখন নাস্তা করতে বসেছি তখন হঠাৎ আমার সেলফোনটা বেজে উঠল তীè স্বরে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো পুরনো বইয়ের দোকানদার শাহজাহানের গলা, ‘ওস্তাদ একটা ফাসকেলাস বই পাইছি। এমুন পুরানের পুরান। ছালকা-বালকা উইঠ্যা-মুইঠ্যা গেছে।
আপনার লাইগা তুইলা রাখছি। কখন আইবেন?’
‘বইটার নাম কী?’
‘কইলাম না বস, ছালকা-বালকা নাই, কী নাম হেডাও লেহা নাই। ’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তুমি বইটা তুলে রাখো। আমি বিকালের দিকে আসছি। আর সাথে আরো কিছু বই যোগাড় করে রেখো।
’
‘আচ্ছা বস ঠিক আছে। ‘খোদা হাফেজ, স্লামালেকুম। ’
‘ওয়ালাইকুম। ’
২.
বইটার মলাট নেই। প্রিন্টার্স লাইনের পাতাটাও নেই।
প্রথম দিকের কয়েকটা পাতাও নেই। তবে ভেতরের দু’এক পাতা পড়ে বোঝা গেল এটা সম্ভবত একটা হরর বই। বইয়ের নাম বা লেখকের নাম জানার কোন উপায় নেই। তবে ভেতরের পাতাগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখে বোঝা যায়, বইটা বহু পুরনো। পুরনো হলেও হরর বইয়ের প্রতি আমার তেমন কোন আকর্ষণ নেই।
তাই কতণ বইটা নেড়েচেড়ে দেখে আমি রেখে দিলাম। তা দেখে খুব আশাভঙ্গ হয়ে যাওয়া মানুষের মত হতাশ সুরে শাহজাহান জিজ্ঞেস করলো, ‘বস পছন্দ হইলো না বইটা? জিনিসটা কিন্তু ভালো আছিলো। বহুত পুরানা মাল। এর’ম জিনিস সব সময় পাইবেন না। ’
আমি কী কারণে যেন শাহজাহানের কথা শেষ হতেই বইটা আবার হাতে তুলে নিলাম।
কয়েক পাতা উল্টাতেই একটা ব্যাপারে আমার নজর পড়লো। আর সাথে সাথেই বইটা কেনার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ জন্মে উঠল। আমি শাহজাহানকে বললাম, ‘বইটা আমি নেব। ’
শাহজাহানের মুখের ভাব দেখে বোঝা গেল সে খুশি হয়েছে। অন্যকে খুশি করতে আমার খুব ভালো লাগে।
পুরনো বইটার সাথে আরো কিছু দরকারী বই নিয়ে, দাম মিটিয়ে, আমি বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় ঢুকেই পুরনো বইটা উল্টালাম। আবার দেখলাম সেই ব্যাপারটা। ব্যাপারটা হচ্ছে বইটা বোঝা যাচ্ছে একটা উপন্যাসের বই। আর উপন্যাসটাতে আছে বেশ কিছু পর্ব।
সেই প্রত্যেক পর্বের নিচে মলিন হয়ে যাওয়া হালকা লাল রঙে লেখা :
\ বিশেষ সতর্কীকরণ \
এই বই যে পড়বে তার জীবনে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়।
এই সতর্কীকরণটাই বইটার প্রতি আমার আগ্রহটাকে জাগিয়ে তুলেছে। একটা বইয়ের মধ্যে এ কথা ছাপার কী মানে? বুঝতে পারলাম না। তাই তখনই বইটা নিয়ে এক বসায় পড়ে শেষ করে ফেললাম, কিন্তু সতর্কীকরণের কোন কারণ খুঁজে পেলাম না।
৩.
আমি খুব ঘরমুখো মানুষ।
ঘর থেকে বের হতে খুব একটা ভালো লাগে না আমার। আর ঘুরতে যাওয়াতো দূরের কথা, কিন্তু এ অপছন্দের কাজেই এখন আমি রওনা হচ্ছি। মানুষ অনুরোধের ঢেঁকি গেলে। কিন্তু আজ আমাকে পুরো ঢেঁকিশালা গিলতে হচ্ছে। ব্যাপারটা খোলাসা করেই বলি, আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু নজরুল, শামীম আর আশরাফ।
এরা তিনজনই মোটামুটি বিচ্ছু টাইপের মানুষ। আর আমি একেবারে ওদের উল্টো, একেবারে শান্ত শিষ্ট (ওদের ভাষায় গোবেচারা)। তবুও আমরা পরস্পর বিপরীত মেরুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যধারী হয়েও ভালো বন্ধু। যাই হোক বহুদিন পর ক’দিন আগে আমার কাছে নজরুল ফোন করল। তারপর বেশ কসম টসম কাটিয়ে আমাকে মোটামুটি বিরক্ত করে তুললো।
এবং বিরক্তির একপর্যায়ে তার একটা আবদার পূরণের জন্য আমাকে রাজি করিয়ে ফেললো। সে আবদারটা হচ্ছে আমাদের বন্ধু শামীম গাড়ি কিনেছে। সেই গাড়িতে করে একদিন আমরা গাজীপুরের শালবনে বেড়াতে যাবো। সঙ্গে থাকবে খাবার-দাবার। শালবনের ভেতরে আমরা হারিয়ে যাবো।
বনের ভেতরে বসে খাবার খাবো। নিজেরা কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসবো। ভীষণ রকমের ছেলেমানুষী কাজকর্ম, বনভোজন টাইপের।
আমার যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকলেও নজরুলকে দেয়া কথা আর তার পুনরায় অনুরোধে রাজি হয়ে গেলাম। আজ হচ্ছে বনে হারিয়ে যাওয়ার সেই দিন।
শামীমের গাড়িটা ভক্সি মডেলের কালো গাড়ি। মাইক্রোবাস টাইপের। ভেতরে অনেক জায়গা। ড্রাইভিং সিটে শামীম নিজেই। আর আমরা বাকি তিনজন গা এলিয়ে বসলাম গাড়িতে।
গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বাতাস এসে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে গায়ে। চুলগুলোকে করে দিচ্ছে এলোমেলো। শামীম গাড়ির সিডি প্লেয়ার অন করে দিলো। গান বেজে উঠলো : চলনা ঘুরে আসি অজানাতে যেখানে নদী এসে থেমে গেছে ...... :
গান শুনে প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
মনটা হয়ে উঠলো উদাস। যতটা খারাপ লাগার প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ততটা খারাপ আর লাগলো না। মোটামুটি ভালোই লাগতে শুরু করলো। চার বন্ধুর স্মৃতিময় কথায় কথায় ঢাকা পেরিয়ে গেলাম আমরা।
ঠিক তখনই ঘটল একটা অন্যরকম ঘটনা। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সব ঢাকার ভেতর হলেও আমি কখনো ঢাকার বাইরে কোথাও যাইনি। কিন্তু ঢাকা পেরোবার সাথে সাথে আমার মনে হল আমি আগে এখানে এসেছি। কবে কার সাথে তা জানি না, তবে বারবার একটা কথাই মনে হতে থাকলো আমি এখানে এসেছি। গাড়ি চলছে।
পুরো পথটাকে আমার পরিচিত মনে হচ্ছে। গাড়ি গিয়ে থামলো একটা পেট্রোল পাম্পের কাছে। এখানে গাড়ি রেখে আমরা জঙ্গলে যাবো। আমাদের গাড়ি থামার সাথে সাথেই আমাদের দিকে পাম্পের একটা বয় এগিয়ে এলো। আমার কেন যেন মনে হল, এর নাম রুবেল।
আমি কেন জানি না ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি রুবেল না?’
ছেলেটা ভীষণ অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার আপনি কী আমাকে চেনেন?’
তোমার নাম কী রুবেল?’
‘জ্বী হ্যাঁ। তবে আপনি জানলেন কীভাবে? আপনাকে তো এর আগে এদিকে কখনো দেখিনি। আর এখানে আমি চাকরীতেও নতুন আমাকে তো কারো চেনার কথা না। ’
আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
এর নাম জানলাম কী কবে আমি? আমি আর কোন কথা বললাম না। শামীম, নজরুল, আশরাফ কিছুই না বুঝে শুধু আমার দিকে আর রুবেল নামের ছেলেটার দিকে তাকাতে লাগলো।
আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। মাঠের ওপরে গাছ থেকে ঝরে পরা শুকনো পাতার চাদর মাড়িয়ে আমরা হাঁটছি। আশরাফ বেসুরো গলায় গান গাইতে গাইতে হাঁটছে সবার আগে।
নজরুল আর শামীম আমাদের স্কুল দিনের গল্প করছে। আর ওদের পাশে পাশে হাঁটছি আমি। আমি কোন কথা বলছি না চুপচাপ হয়ে আছি। আমি ব্যাপক চিন্তিত, কারণ এখন যা হচ্ছে যা ঘটছে আমার মনে হচ্ছে এসব এর আগেও হয়েছে। এ পথ ধরে আমি এর আগেও হেঁটে গেছি।
কিন্তু কবে, কার সাথে তা মনে নেই। হঠাৎ আমার মনে হল আশরাফের সামনে মাটি খুঁড়ে একটা ফাঁদ বানানো আছে। আমি আশরাফের দিকে তাকালাম। মনে হল আর কয়েক কদম পরই ফাঁদ। ওকে সাবধান করার জন্য আমি চিৎকার করে বললাম।
‘আশরাফ সাবধান, তোর সামনে একটা ফাঁদ আছে, পাশ কেটে যা। ’
আমার চিৎকার শুনে আশরাফ পিছনে ঘুরল কিন্তু চলা থামালো না। তাই নিজেকে সামলাতেও পারলো না। কিছু বোঝার আগেই হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল ফাঁদের গর্তের ভেতর। আর এ ঘটনা দেখে আমি নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
আর আমার দু’পাশে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল শামীম আর নজরুল। ওদের ঘোর কাটালো আশরাফের চিৎকারে। ‘কইরে তোরা? আমারে উঠাস না তাড়াতাড়ি। মশায় কামড়ায়া ছেদাভেদা কইরা ফালাইলো রে, এহ্ কী গন্ধ, ওয়্যাক থু: ...। ’
আমরা ছুটে গিয়ে দেখলাম গর্তের ভেতর এখনও চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছে আশরাফ।
কে যেন মাটিতে বিশাল একটা গর্ত খুঁড়ে তারপর ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে। তার ভেতরেই পড়েছে আশরাফ। ডাল-পালার ঝোপ নিচে থাকায় সে আর বেশী ব্যাথা পায়নি। আমরা তিনজন মিলে আশরাফকে গর্ত থেকে টেনে তুললাম। কাদায় মাখামাখি সারা গা।
কিন্তু ওদিকে কোন নজর নেই। গর্ত থেকে বেরিয়েই আশরাফ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কী আগেও এসেছিল এখানে?’
‘নাতো।
‘তাহলে জানলি কী করে যে এখানে একটা গর্ত আছে?’
আমি খুব বিব্রতবোধ করলাম। কারণ এ প্রশ্নের কোন জবাব আমার জানা নেই। এখানে একটা গর্ত আছে এটা আমার কখনোই জানার কথা না।
তবু আমি কী করে জানলাম? আমি কথা না বলে চুপ করে রইলাম। প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরে গেল নজরুলের কথায়। নজরুল জিজ্ঞেস করল, ‘কীরে আশরাফ তোর তো অবস্থা খারাপ। কাদা-টাদার মাখামাখি। এগুলো এখন ধুবি কোথায় গিয়ে?’
আশরাফ বললো, ‘আশেপাশে পানি পাওয়া যাবে কোথায়?’
‘এই জঙ্গলের ভেতর তুই পানি পাবি কোথায়?’ বলল শামীম।
হঠাৎ আমার মনে হল আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে ডানদিকে গেলেই একটা পুকুর পাওয়া যাব্ েআমি ওদের বললাম, ‘আয় আমার সাথে। ’
‘কোথায়?’ সমস্বরে ওদের প্রশ্ন।
আমি জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ওরাও হাঁটতে শুরু করল আমার পেছন পেছন। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর আসার পর আমি ভীষণ বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলাম একটি পুকুর।
আমার মনে হয়েছিল যেখানে ঠিক সেখানেই। পুকুর দেখে আর কোন কথা না বলে আশরাফ দৌড়ে গেল শান-বাঁধানো ঘাটের দিকে। কাদা পরিষ্কার করতে। তখনই আমার আবার মনে হল ঘাটটা শ্যাওলা পরে পিচ্ছিল হয়ে আছে। আমি আবার চিৎকার করলাম, ‘সাবধান, আশরাফ ............।
’
কিন্তু আমাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পিছলে ধপাস করে পানি তে পড়লো আশরাফ। আশরাফের অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো নজরুল, শামীম। কিন্তু আমি হাসলাম না। কারণ আমার মনে হল নজরুল আর শামীমের পেছনে একটা বিষধর সাপ ফণা তুলে আছে। আমি চোখ ঘুরাতেই দেখি সত্যি সত্যিই একটা বিশাল সাপ ফণা তুলে আছে।
এখন কী করার আমি ভেবে পেলাম না। আবার শামীম, নজরুলকে বললামও না। কারণ হঠাৎ ভয় পেয়ে ছুটোছুটি করতে গিয়ে সাপের ছোবল খেতে পারে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হল দুর্ভাবনার কিছুই নেই।
আর তখনি কোথা থেকে একটা বেজী এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো সাপটার ওপর। সাপ বেজীর লড়াই বেধে গেল। আর তার আওয়াজ শুনেই শামীম, নজরুল পিছন ঘুরতেই দেখলো তাদের পেছনে চলছে সাপ বেজীর মহাযুদ্ধ। আঁতকে উঠে ওরা সরে গেল খানিক দূরে। আশরাফও কাদা পরিষ্কার করে উঠে এলো।
বেচারা একেবারে ভিজে জবুথবু। সাপ-বেজীর লড়াই দেখতে দেখতে নজরুল হঠাৎ বাজি ধরলো আশরাফের সাথে যুদ্ধে সাপটা জিতবে। আশরাফও বাজি ধরল বেজীটা জিতবে। কিন্তু এবার আমার মন বললো কেউ জিতবে না। এবং হলোও তা।
সাপ বেজী দু’জনই মারা পড়ল। বহুণ ধরে লড়াই দেখতে দেখতে সবাই বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিলাম। ততণে আশরাফের ভেজা কাপড় শুকিয়ে গেছে। শামীম বললো, ‘চল খেয়ে নিই। ’
সবাই রাজি এ প্রস্তাবে।
পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে পুকুর ঘাটেই খেতে বসলাম। খেতে খেতে হঠাৎ একটা বিষয় আমার খেয়াল হল। এই যে, আমরা এতণ জঙ্গলে, এর মধ্যে একটা মানুষও দেখিনি, কথাটা বলতেই সবাই একমত হয়ে গেল। ঠিকই তো! ব্যাপারটা কী?
ধীরে ধীরে দিনের আলো একটু কমে এলো। মানে বিকেল হয়ে এসেছে।
ঘড়ি দেখলাম পাঁচটা বেজে ত্রিশ। শামীম বললো, এবার ফেরার পালা। ’
আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। আর আমার মনে হল এখানে আর কোনোদিন আসা হবে না। পেট্রোল পাম্প থেকে গাড়ি ফেরত নিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম।
আসার সময় রুবেল নামের সেই ছেলেটার সাথে দেখা হল কিন্তু কিছু বললাম। গাড়ি দিয়ে ফিরছি। আশেপাশে পথঘাট সব চেনা মনে হচ্ছে। হঠাৎ আমার সব মনে পড়ল। এই পথে আমি এর আগে কখনও আসিনি।
তবে এ পথ সম্পর্কে আমি জানি। আর আমি এ ব্যাপারে জেনেছি একটা বইয়ে। সেই বইটা হচ্ছে নীলতে থেকে কিনে আনা সেই মলাট ছাড়া বইটা। এতণ আমাদের সাথে যা ঘটেছে, যা হয়েছে সবই সেই বইয়ের ঘটনা। সেই বইয়ের কাহিনীও চার বন্ধুকে নিয়ে, যারা ঘুরতে বেরিয়েছিল আমাদের মনে জঙ্গলে।
ভীষণ আতংকিত হয়ে উঠলাম আমি। মনে পড়ল বইয়ে মলিন হয়ে যাওয়া হালকা লাল কালিতে ছাপা সতর্কবাণী ‘এই বই যে পাড়বে তার জীবনে নামিয়া আসিবে চরম বিপর্যয়। ’
আর সেই সাথে আমার আবার মনে পড়ল বইয়ের শেষের আগের লাইনটা। ভয়ে শিউরে উঠে আমি ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা শামীমকে সাবধান করার আগেই সামনের দিক থেকে ধেয়ে আসা ট্রাকের সাথে আমাদের গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লাগলো। আমাদের গাড়িটা পুরোপুরি নড়ে উঠে উল্টে গেল।
আমার কানে ভেসে এল নজরুল, শামীম আর আশরাফের আর্তচিৎকার। আমার শরীর অবশ হয়ে এল। জ্ঞান হারাবার আগে আমি আরো একবার শিউরে উঠলাম। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছেঁড়া ফাড়া বইয়ের সর্বশেষ বাক্যটি : ওরা চারজন, আর ঘরে ফিরতে পারলো না।
অনেক অনেক দিনের পুরনো, নানা বিষয়ের ওপর নানা ধরনের বই সংগ্রহ করাটা আমার নেশার মত।
তাই সপ্তাহে বেশ ক’বার আমাকে নীলতে যেতে হয়, পুরনো বইয়ের দোকানে। নীলেেতর এক পুরনো বইয়ের দোকানদার শাহজাহান। তার সাথে আবার আমার খুব খাতির। পুরনো কোন বই পেলেই সে আমার জন্য তা আলাদাভাবে রেখে দিয়ে আমাকে জানায়। আমি এসে যদি পছন্দ হয় তবে কিনে নেই।
অবশ্য এ জন্য সে বইয়ের দামের সাথে একটা ভালো পরিমাণের বখশিশও পায়। আর আমি এমনও অনেক পুরনো বই কিনি যেটার অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হবার পর্যায়ের। অন্য কেউ সে বই কিনবে না। সে বই আমি কিনে নেই বলে পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে আমার একটা আলাদা গ্রহণযোগ্যতা(!) আছে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে যখন নাস্তা করতে বসেছি তখন হঠাৎ আমার সেলফোনটা বেজে উঠল তীè স্বরে।
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো পুরনো বইয়ের দোকানদার শাহজাহানের গলা, ‘ওস্তাদ একটা ফাসকেলাস বই পাইছি। এমুন পুরানের পুরান। ছালকা-বালকা উইঠ্যা-মুইঠ্যা গেছে। আপনার লাইগা তুইলা রাখছি। কখন আইবেন?’
‘বইটার নাম কী?’
‘কইলাম না বস, ছালকা-বালকা নাই, কী নাম হেডাও লেহা নাই।
’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তুমি বইটা তুলে রাখো। আমি বিকালের দিকে আসছি। আর সাথে আরো কিছু বই যোগাড় করে রেখো। ’
‘আচ্ছা বস ঠিক আছে। ‘খোদা হাফেজ, স্লামালেকুম।
’
‘ওয়ালাইকুম। ’
২.
বইটার মলাট নেই। প্রিন্টার্স লাইনের পাতাটাও নেই। প্রথম দিকের কয়েকটা পাতাও নেই। তবে ভেতরের দু’এক পাতা পড়ে বোঝা গেল এটা সম্ভবত একটা হরর বই।
বইয়ের নাম বা লেখকের নাম জানার কোন উপায় নেই। তবে ভেতরের পাতাগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখে বোঝা যায়, বইটা বহু পুরনো। পুরনো হলেও হরর বইয়ের প্রতি আমার তেমন কোন আকর্ষণ নেই। তাই কতণ বইটা নেড়েচেড়ে দেখে আমি রেখে দিলাম। তা দেখে খুব আশাভঙ্গ হয়ে যাওয়া মানুষের মত হতাশ সুরে শাহজাহান জিজ্ঞেস করলো, ‘বস পছন্দ হইলো না বইটা? জিনিসটা কিন্তু ভালো আছিলো।
বহুত পুরানা মাল। এর’ম জিনিস সব সময় পাইবেন না। ’
আমি কী কারণে যেন শাহজাহানের কথা শেষ হতেই বইটা আবার হাতে তুলে নিলাম। কয়েক পাতা উল্টাতেই একটা ব্যাপারে আমার নজর পড়লো। আর সাথে সাথেই বইটা কেনার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ জন্মে উঠল।
আমি শাহজাহানকে বললাম, ‘বইটা আমি নেব। ’
শাহজাহানের মুখের ভাব দেখে বোঝা গেল সে খুশি হয়েছে। অন্যকে খুশি করতে আমার খুব ভালো লাগে। পুরনো বইটার সাথে আরো কিছু দরকারী বই নিয়ে, দাম মিটিয়ে, আমি বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় ঢুকেই পুরনো বইটা উল্টালাম।
আবার দেখলাম সেই ব্যাপারটা। ব্যাপারটা হচ্ছে বইটা বোঝা যাচ্ছে একটা উপন্যাসের বই। আর উপন্যাসটাতে আছে বেশ কিছু পর্ব। সেই প্রত্যেক পর্বের নিচে মলিন হয়ে যাওয়া হালকা লাল রঙে লেখা :
\ বিশেষ সতর্কীকরণ \
এই বই যে পড়বে তার জীবনে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়।
এই সতর্কীকরণটাই বইটার প্রতি আমার আগ্রহটাকে জাগিয়ে তুলেছে।
একটা বইয়ের মধ্যে এ কথা ছাপার কী মানে? বুঝতে পারলাম না। তাই তখনই বইটা নিয়ে এক বসায় পড়ে শেষ করে ফেললাম, কিন্তু সতর্কীকরণের কোন কারণ খুঁজে পেলাম না।
৩.
আমি খুব ঘরমুখো মানুষ। ঘর থেকে বের হতে খুব একটা ভালো লাগে না আমার। আর ঘুরতে যাওয়াতো দূরের কথা, কিন্তু এ অপছন্দের কাজেই এখন আমি রওনা হচ্ছি।
মানুষ অনুরোধের ঢেঁকি গেলে। কিন্তু আজ আমাকে পুরো ঢেঁকিশালা গিলতে হচ্ছে। ব্যাপারটা খোলাসা করেই বলি, আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু নজরুল, শামীম আর আশরাফ। এরা তিনজনই মোটামুটি বিচ্ছু টাইপের মানুষ। আর আমি একেবারে ওদের উল্টো, একেবারে শান্ত শিষ্ট (ওদের ভাষায় গোবেচারা)।
তবুও আমরা পরস্পর বিপরীত মেরুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যধারী হয়েও ভালো বন্ধু। যাই হোক বহুদিন পর ক’দিন আগে আমার কাছে নজরুল ফোন করল। তারপর বেশ কসম টসম কাটিয়ে আমাকে মোটামুটি বিরক্ত করে তুললো। এবং বিরক্তির একপর্যায়ে তার একটা আবদার পূরণের জন্য আমাকে রাজি করিয়ে ফেললো। সে আবদারটা হচ্ছে আমাদের বন্ধু শামীম গাড়ি কিনেছে।
সেই গাড়িতে করে একদিন আমরা গাজীপুরের শালবনে বেড়াতে যাবো। সঙ্গে থাকবে খাবার-দাবার। শালবনের ভেতরে আমরা হারিয়ে যাবো। বনের ভেতরে বসে খাবার খাবো। নিজেরা কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসবো।
ভীষণ রকমের ছেলেমানুষী কাজকর্ম, বনভোজন টাইপের।
আমার যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকলেও নজরুলকে দেয়া কথা আর তার পুনরায় অনুরোধে রাজি হয়ে গেলাম। আজ হচ্ছে বনে হারিয়ে যাওয়ার সেই দিন। শামীমের গাড়িটা ভক্সি মডেলের কালো গাড়ি। মাইক্রোবাস টাইপের।
ভেতরে অনেক জায়গা। ড্রাইভিং সিটে শামীম নিজেই। আর আমরা বাকি তিনজন গা এলিয়ে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বাতাস এসে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে গায়ে।
চুলগুলোকে করে দিচ্ছে এলোমেলো। শামীম গাড়ির সিডি প্লেয়ার অন করে দিলো। গান বেজে উঠলো : চলনা ঘুরে আসি অজানাতে যেখানে নদী এসে থেমে গেছে ...... :
গান শুনে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মনটা হয়ে উঠলো উদাস। যতটা খারাপ লাগার প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়েছিলাম।
ততটা খারাপ আর লাগলো না। মোটামুটি ভালোই লাগতে শুরু করলো। চার বন্ধুর স্মৃতিময় কথায় কথায় ঢাকা পেরিয়ে গেলাম আমরা। ঠিক তখনই ঘটল একটা অন্যরকম ঘটনা। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সব ঢাকার ভেতর হলেও আমি কখনো ঢাকার বাইরে কোথাও যাইনি।
কিন্তু ঢাকা পেরোবার সাথে সাথে আমার মনে হল আমি আগে এখানে এসেছি। কবে কার সাথে তা জানি না, তবে বারবার একটা কথাই মনে হতে থাকলো আমি এখানে এসেছি। গাড়ি চলছে। পুরো পথটাকে আমার পরিচিত মনে হচ্ছে। গাড়ি গিয়ে থামলো একটা পেট্রোল পাম্পের কাছে।
এখানে গাড়ি রেখে আমরা জঙ্গলে যাবো। আমাদের গাড়ি থামার সাথে সাথেই আমাদের দিকে পাম্পের একটা বয় এগিয়ে এলো। আমার কেন যেন মনে হল, এর নাম রুবেল। আমি কেন জানি না ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি রুবেল না?’
ছেলেটা ভীষণ অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার আপনি কী আমাকে চেনেন?’
তোমার নাম কী রুবেল?’
‘জ্বী হ্যাঁ।
তবে আপনি জানলেন কীভাবে? আপনাকে তো এর আগে এদিকে কখনো দেখিনি। আর এখানে আমি চাকরীতেও নতুন আমাকে তো কারো চেনার কথা না। ’
আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এর নাম জানলাম কী কবে আমি? আমি আর কোন কথা বললাম না। শামীম, নজরুল, আশরাফ কিছুই না বুঝে শুধু আমার দিকে আর রুবেল নামের ছেলেটার দিকে তাকাতে লাগলো।
আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। মাঠের ওপরে গাছ থেকে ঝরে পরা শুকনো পাতার চাদর মাড়িয়ে আমরা হাঁটছি। আশরাফ বেসুরো গলায় গান গাইতে গাইতে হাঁটছে সবার আগে। নজরুল আর শামীম আমাদের স্কুল দিনের গল্প করছে। আর ওদের পাশে পাশে হাঁটছি আমি।
আমি কোন কথা বলছি না চুপচাপ হয়ে আছি। আমি ব্যাপক চিন্তিত, কারণ এখন যা হচ্ছে যা ঘটছে আমার মনে হচ্ছে এসব এর আগেও হয়েছে। এ পথ ধরে আমি এর আগেও হেঁটে গেছি। কিন্তু কবে, কার সাথে তা মনে নেই। হঠাৎ আমার মনে হল আশরাফের সামনে মাটি খুঁড়ে একটা ফাঁদ বানানো আছে।
আমি আশরাফের দিকে তাকালাম। মনে হল আর কয়েক কদম পরই ফাঁদ। ওকে সাবধান করার জন্য আমি চিৎকার করে বললাম। ‘আশরাফ সাবধান, তোর সামনে একটা ফাঁদ আছে, পাশ কেটে যা। ’
আমার চিৎকার শুনে আশরাফ পিছনে ঘুরল কিন্তু চলা থামালো না।
তাই নিজেকে সামলাতেও পারলো না। কিছু বোঝার আগেই হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল ফাঁদের গর্তের ভেতর। আর এ ঘটনা দেখে আমি নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আর আমার দু’পাশে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল শামীম আর নজরুল। ওদের ঘোর কাটালো আশরাফের চিৎকারে।
‘কইরে তোরা? আমারে উঠাস না তাড়াতাড়ি। মশায় কামড়ায়া ছেদাভেদা কইরা ফালাইলো রে, এহ্ কী গন্ধ, ওয়্যাক থু: ...। ’
আমরা ছুটে গিয়ে দেখলাম গর্তের ভেতর এখনও চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছে আশরাফ। কে যেন মাটিতে বিশাল একটা গর্ত খুঁড়ে তারপর ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে। তার ভেতরেই পড়েছে আশরাফ।
ডাল-পালার ঝোপ নিচে থাকায় সে আর বেশী ব্যাথা পায়নি। আমরা তিনজন মিলে আশরাফকে গর্ত থেকে টেনে তুললাম। কাদায় মাখামাখি সারা গা। কিন্তু ওদিকে কোন নজর নেই। গর্ত থেকে বেরিয়েই আশরাফ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কী আগেও এসেছিল এখানে?’
‘নাতো।
‘তাহলে জানলি কী করে যে এখানে একটা গর্ত আছে?’
আমি খুব বিব্রতবোধ করলাম। কারণ এ প্রশ্নের কোন জবাব আমার জানা নেই। এখানে একটা গর্ত আছে এটা আমার কখনোই জানার কথা না। তবু আমি কী করে জানলাম? আমি কথা না বলে চুপ করে রইলাম। প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরে গেল নজরুলের কথায়।
নজরুল জিজ্ঞেস করল, ‘কীরে আশরাফ তোর তো অবস্থা খারাপ। কাদা-টাদার মাখামাখি। এগুলো এখন ধুবি কোথায় গিয়ে?’
আশরাফ বললো, ‘আশেপাশে পানি পাওয়া যাবে কোথায়?’
‘এই জঙ্গলের ভেতর তুই পানি পাবি কোথায়?’ বলল শামীম।
হঠাৎ আমার মনে হল আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে ডানদিকে গেলেই একটা পুকুর পাওয়া যাব্ েআমি ওদের বললাম, ‘আয় আমার সাথে। ’
‘কোথায়?’ সমস্বরে ওদের প্রশ্ন।
আমি জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ওরাও হাঁটতে শুরু করল আমার পেছন পেছন। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর আসার পর আমি ভীষণ বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলাম একটি পুকুর। আমার মনে হয়েছিল যেখানে ঠিক সেখানেই। পুকুর দেখে আর কোন কথা না বলে আশরাফ দৌড়ে গেল শান-বাঁধানো ঘাটের দিকে।
কাদা পরিষ্কার করতে। তখনই আমার আবার মনে হল ঘাটটা শ্যাওলা পরে পিচ্ছিল হয়ে আছে। আমি আবার চিৎকার করলাম, ‘সাবধান, আশরাফ ............। ’
কিন্তু আমাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পিছলে ধপাস করে পানি তে পড়লো আশরাফ। আশরাফের অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো নজরুল, শামীম।
কিন্তু আমি হাসলাম না। কারণ আমার মনে হল নজরুল আর শামীমের পেছনে একটা বিষধর সাপ ফণা তুলে আছে। আমি চোখ ঘুরাতেই দেখি সত্যি সত্যিই একটা বিশাল সাপ ফণা তুলে আছে। এখন কী করার আমি ভেবে পেলাম না। আবার শামীম, নজরুলকে বললামও না।
কারণ হঠাৎ ভয় পেয়ে ছুটোছুটি করতে গিয়ে সাপের ছোবল খেতে পারে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হল দুর্ভাবনার কিছুই নেই। আর তখনি কোথা থেকে একটা বেজী এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো সাপটার ওপর। সাপ বেজীর লড়াই বেধে গেল।
আর তার আওয়াজ শুনেই শামীম, নজরুল পিছন ঘুরতেই দেখলো তাদের পেছনে চলছে সাপ বেজীর মহাযুদ্ধ। আঁতকে উঠে ওরা সরে গেল খানিক দূরে। আশরাফও কাদা পরিষ্কার করে উঠে এলো। বেচারা একেবারে ভিজে জবুথবু। সাপ-বেজীর লড়াই দেখতে দেখতে নজরুল হঠাৎ বাজি ধরলো আশরাফের সাথে যুদ্ধে সাপটা জিতবে।
আশরাফও বাজি ধরল বেজীটা জিতবে। কিন্তু এবার আমার মন বললো কেউ জিতবে না। এবং হলোও তা। সাপ বেজী দু’জনই মারা পড়ল। বহুণ ধরে লড়াই দেখতে দেখতে সবাই বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিলাম।
ততণে আশরাফের ভেজা কাপড় শুকিয়ে গেছে। শামীম বললো, ‘চল খেয়ে নিই। ’
সবাই রাজি এ প্রস্তাবে। পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে পুকুর ঘাটেই খেতে বসলাম। খেতে খেতে হঠাৎ একটা বিষয় আমার খেয়াল হল।
এই যে, আমরা এতণ জঙ্গলে, এর মধ্যে একটা মানুষও দেখিনি, কথাটা বলতেই সবাই একমত হয়ে গেল। ঠিকই তো! ব্যাপারটা কী?
ধীরে ধীরে দিনের আলো একটু কমে এলো। মানে বিকেল হয়ে এসেছে। ঘড়ি দেখলাম পাঁচটা বেজে ত্রিশ। শামীম বললো, এবার ফেরার পালা।
’
আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। আর আমার মনে হল এখানে আর কোনোদিন আসা হবে না। পেট্রোল পাম্প থেকে গাড়ি ফেরত নিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। আসার সময় রুবেল নামের সেই ছেলেটার সাথে দেখা হল কিন্তু কিছু বললাম। গাড়ি দিয়ে ফিরছি।
আশেপাশে পথঘাট সব চেনা মনে হচ্ছে। হঠাৎ আমার সব মনে পড়ল। এই পথে আমি এর আগে কখনও আসিনি। তবে এ পথ সম্পর্কে আমি জানি। আর আমি এ ব্যাপারে জেনেছি একটা বইয়ে।
সেই বইটা হচ্ছে নীলতে থেকে কিনে আনা সেই মলাট ছাড়া বইটা। এতণ আমাদের সাথে যা ঘটেছে, যা হয়েছে সবই সেই বইয়ের ঘটনা। সেই বইয়ের কাহিনীও চার বন্ধুকে নিয়ে, যারা ঘুরতে বেরিয়েছিল আমাদের মনে জঙ্গলে। ভীষণ আতংকিত হয়ে উঠলাম আমি। মনে পড়ল বইয়ে মলিন হয়ে যাওয়া হালকা লাল কালিতে ছাপা সতর্কবাণী ‘এই বই যে পাড়বে তার জীবনে নামিয়া আসিবে চরম বিপর্যয়।
’
আর সেই সাথে আমার আবার মনে পড়ল বইয়ের শেষের আগের লাইনটা। ভয়ে শিউরে উঠে আমি ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা শামীমকে সাবধান করার আগেই সামনের দিক থেকে ধেয়ে আসা ট্রাকের সাথে আমাদের গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লাগলো। আমাদের গাড়িটা পুরোপুরি নড়ে উঠে উল্টে গেল। আমার কানে ভেসে এল নজরুল, শামীম আর আশরাফের আর্তচিৎকার। আমার শরীর অবশ হয়ে এল।
জ্ঞান হারাবার আগে আমি আরো একবার শিউরে উঠলাম। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছেঁড়া ফাড়া বইয়ের সর্বশেষ বাক্যটি : ওরা চারজন, আর ঘরে ফিরতে পারলো না!
......এই গল্পের সাথে যে ছবিটি আছে সেটি এঁকেছেন কার্টুনিস্ট কিশোর
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।