জলছবি স্মৃতি ছুঁয়ে থাকে হৃদয়াবেগ , ধুয়ে গেছে ধ্বনি তার ; শব্দহীন সময়ের পারাবার ।
বিকেলের আলোয় দিল্লীর মাটি স্পর্শ করল প্লেন , হীরার মনটা হু হু করে উঠল বাসার জন্য । মনে হল বসে থাকবে প্লেনে , নামবে না -- প্লেনটা আবার ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে ঢাকায় । কেন যে আসল সে , ওর বর খালিদ বুঝিয়ে পাঠাল। পাশের দেশ , মাত্র তিনদিনের জন্য যাচ্ছো , এসব বলে বলে ।
খালিদ জানে , হীরা স্বামী সন্তান আর সংসার , এই তিন ' স '
কেন্দ্রিক হয়ে থাকে ,কর্মস্থলের সুনামের ' স' কে অবহেলা করে অবলীলায় ।
পাশের সঙ্গীর ডাকে বাস্তবে ফেরে । কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির তিনদিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন দিল্লীতে , তিন সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদলের একজন হয়ে দিল্লীর মাটিতে পা রাখে সে ।
হোটেলে পৌছে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিতে নিতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায় । চা খেয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে ।
তারপর কাপড় গুলো বের করে গুছিয়ে রাখে , তিনদিনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আসা । একটু তাড়াতাড়ি ডিনার সারে । অনেকটা সময় নিয়ে কথা বলে বাসায় । মনে হল যেন কবে এসেছে বাসা ছেড়ে অনেকদিন আগে , বাসার সবাইকে যেন কতদিন দেখেনা , আজব মানুষের মন ।
নতুন পরিবেশ , নতুন বিছানা , এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় রাত ভোর হয়ে যায় ।
সকাল নটায় সম্মেলন শুরু হবার কথা । কিছু সময় হাতে নিয়ে আগে উপস্থিত হয়ে যায় অন্য দুজনের সাথে হীরা । বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা জড়ো হয়েছে , কত গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা হবে ; তারপর সে সব আলোচনার ফলাফল ফাইলবন্দী থাকবে , আলোর মুখ দেখবে না কোনদিন , কারো কোন কাজে আসবে না , এসবই মনে আসছিল তার । হঠাৎ একটা চেনা কন্ঠস্বর কানে এসে লাগল ! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অদূরে দাড়িয়ে আছে বাদল , হ্যাঁ বাদলই তো ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা , মাথা ঘুরতে থাকে । ওতো বাংলাদেশী প্রতিনিধিদলে নেই , তাছাড়া থাকে তো ইংল্যান্ডে ; সব কিছু গুলিয়ে যায় , ভাল করে কিছু মনে করতে পারে না ।
বাদলের দিকে তাকিয়ে থাকে , কিন্তু তার দু'চোখ কিছু দেখে না , দেখতে পায় না কিছু কোথাও । শুনতে পায় ," আমি মোহাম্মদ সালেহীন , বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত বৃটিশ নাগরিক , বৃটেনের প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছি , দেশের কারা এসেছেন পরিচিত হতে এলাম "। সঙ্গী দু'জন পরিচয় দেবার পরে হীরাও বলে যন্ত্রের মত , মাহজাবীন আহমেদ আমি । বাদল বলে ওঠে , তুমি এসেছো , ভালই হল । অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলে , আমরা একই প্রতিষ্ঠানে পড়েছি অনেকদিন ।
পরে কথা হবে বলে চলে গেল তার জায়গায় । বক্তারা সেদিন কে কি বলল হীরার জানা হল না ; ওর কেবল মনে হত লাগল , কেন এল , কেন এল এখানে ! সেদিনের প্রোগ্রাম শেষ হল । লাঞ্চ করতে সবাই টেবিলে গিয়ে বসল । প্লেটে সালাদ ক'টুকরা নিয়ে নাড়তে লাগল হীরা আর বার বার কোল্ড ড্রিংক্সে চুমুক , সবই তার গলায় আটকে যাচ্ছে আজ ।
খেয়াল করল বাদল এসে দাড়িয়েছে পিছনে ; বলল , আপনাদের সাথে বসতে পারলে ভাল হত ।
তারপরে হীরার দিকে তাকিয়ে বলল , তুমি তো কিছু খাচ্ছো না হীরা । হীরা বলল সে দুপুরে তেমন একটা খায় না , মিথ্যা কথাটা সত্যের মত শোনালো । সঙ্গী দুজন বুঝল তার নাম ডাকনাম হীরা । একজন বলল , হীরা নামটা বেশ আপনার , দামী রত্নের নামে নাম । বাদল তাদের রুম নাম্বার জেনে নিল , তারপর নিজেরটা জানিয়ে চলে
গেল ।
যন্ত্রমানবের মত পা দুটো ভরসা করে কোনরকমে রুমে এসে ঢুকল হীরা । মনে হল মাথা কেউ জোরে চেপে ধরেছে ,কাঁদতে ইচ্ছে হল ; কান্না আসছিল না । সব অন্ধকার , আলো নেই , বাতাস নেই -- কেমন যেন লাগতে থাকলো । বেসিনে গিয়ে বমি করে ফেলল । চোখে মুখে পানি দিয়ে এল , গ্লাস ভর্তি পানি খেয়ে নিল ঢকঢক করে ।
কিছুক্ষনের মধ্যে আবারো উঠতে হল তাকে , আবারো বমি হল বেসিনে পৌছুবার আগে । সে ফোন করল রিসেপশনে , সিকনেস জানাল আর একজন ডাক্তারের জন্য অনুরোধ করল । একা এখানে বেশী অসুস্থ হলে একটা ঝামেলা হয়ে যাবে !
বার বার মনে আসছিল একই কথা সেই ক'বছর আগের মত করে । কেন , কেন বাদল , তুমি এমন করেছিলে সেবার ! নিজেকে ভারসাম্যহীন লাগছিল । বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার আছে তার !
বিকেল হতে রিসেপশনে এসে দাড়াল বাদল ।
জানতে চাইল রুম নাম্বার ৪১৬ এর মাহজাবীন আহমেদ আছেন কিনা । জবাবটা শুনে আর দেরী করতে পারল না ; সে রুমে একজন ডাক্তার আছেন মাহজাবীন আহমেদ অসুস্থ্ হয়ে পড়ায় .... । আরো কি কি যেন বলছিল সে ঠিক শোনেনি । রুমে ঢুকে দেখে হীরা শুয়ে আছে , ডাক্তার সাহেব বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছেন । বাদল নিজের পরিচয় দিল এবং হীরার অবস্থা জানতে চাইলে ডাক্তার সাহেব জানালেন ; ভদ্রমহিলার ঘুম হয়নি গতরাতে , দুপুরে খাওয়া হয়নি ঠিকমত , কিছুটা উদ্বিগ্ন আছেন , এ্যাসিডিটি ডেভেলপ করেছে , বমি করে দূর্বল হয়ে গেছে ।
তবে এখন ভাল আছেন , মেডিসিন দেয়া হয়েছে । এও জানালেন যে উনি আশা করছেন ভাল হয়ে যাবেন তাড়াতাড়ি । অসুবিধা হলে তাকে যেন জানানো হয় এ কথা বলে বিদায় নিলেন ডাক্তার সাহেব ।
চেয়ার নিয়ে বিছানার পাশে বসল বাদল । হীরা মনে হল উঠে বসতে গেল , বাদল মানা করল ।
কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তাকে কেমন নিষ্প্রভ লাগছে ! বেশ কিছুক্ষন দুজনে চুপ করে থাকল । হীরা নিজের বুকের ভিতর পাড় ভাঙ্গা নদীর তুমুল গর্জন টের পাচ্ছিল । গলা শুকিয়ে আসছিল , উঠে পানির গ্লাস নিতে চাইলে বাদল এগিয়ে দিল । ক'ঢোক খেয়ে শুয়ে পড়ল আবার । ও চেষ্টা করেও কথা বলতে পারছিল না , অতীতের গভীর থেকে উঠে আসা ভারী এক পাথর তার কন্ঠনালী চেপে বসে ছিল যেন ।
বাদল চুপ করে বসে থাকল । সন্ধ্যা পার হয়ে গেল কখন টের পেল না ওরা দুজন , ওরা তখন বোধহীন -- স্থান , কাল বিবেচনা করতে বেগ পেতে হচ্ছে ওদের ।
বাদল জিজ্ঞেস করল , কেমন লাগছে এখন । চোখ তুলে তাকিয়ে থাকল তার দিকে হীরা । চোখের কোল ঘেসে জল গড়িয়ে পড়ল , ঠোট কেঁপে উঠল মৃদু ; চেষ্টা করেও উত্তর দিতে পারল না কোন ।
বাদল বলল , আমি জানি কেন আজ তোমার শরীর খারাপ করছে , সব জানি আমি । আমি দু:খিত হীরা ।
হীরা ফুপিয়ে উঠল , নিজেকে সামলান কঠিন হয়ে পড়ল । ক্ষীনস্বরে বলল , বাদল আমি একটু একা থাকতে চাই ; তুমি কিছু মনে করো না ।
উঠে দাড়াল বাদল ; বলল ঠিক আছে , আমি যাচ্ছি ।
কিছুক্ষন পরে আবার আসবো , বিশ্রাম নাও ।
বেরিয়ে পড়লো । প্রথমে মনে হল সিগারেট খাওয়া প্রয়োজন । এক একবার মনে হল কোন বারে গিয়ে ঢোকে । নাহ্ , সারাজীবন সে নীতির বাইরে কোন কিছু করে নি , আজও করবে না ।
তা'ছাড়া এমন কিছু করবে না যা শুনলে কোনদিন হীরা কষ্ট পেতে পারে । যখন হীরা অন্যের হয়ে গেল , নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে কতবার পথ হারাতে গিয়েও হারায় নি । আজ কেন ? তারপর মার্কেটে গেল । হীরার ভাল লাগবে এমন পত্রিকা নিল দুটো ; আপেল , বিস্কিট , স্যান্ডউইচ , কোকের ক্যান নিল , অনেকটা সময় নিয়ে চকলেট নিল হীরার জন্য বেছে বেছে । কফি খেল বসে বসে আর ভাবলো কি করবে , কিভাবে এ সময়ের জটিলতা পার করতে পারবে ? কিভাবে হীরাকে বোঝাবে তার মনের কথা সত্য যেটা , আজ এতদিন পরে , এত কিছুর পরে ।
সে হীরার কোন কষ্ট দেখতে চায়না । কেন জীবন তাদের সাথে এমন নির্মম রসিকতা করলো ! কার কি লাভ হল এসবে ? কে দেবে জবাব !
উঠে পড়ল সে , হীরার জন্য গিফট কিনতে ইচ্ছে হল । ডিসেম্বরের এই শীতে একটা শাল কিনতে মন চাইল ওর জন্য । কে জানে যদি ফিরিয়ে দেয় , যদি ব্যবহার না করে । তবু নিজের ইচ্ছেকে অবদমন করা গেল না ; সারা জীবন অনেক ইচ্ছেকে গলা টিপে মেরেছে সে , তাতে লোকসান হয়েছে সবারই , এখন বুঝতে পারে ।
ঘিয়ে রঙের কাশ্মীরি শাল নিল বিভিন্ন রঙের ফুল পাড় ।
ফিরে এল হোটেলে । আস্তে নক করে ঢুকল হীরার রুমে । বসতে বসতে বলল , তোমার সাথে বসে খাব বলে এসব নিয়ে এসেছি । মনে হল তার মুখের সেই বিষন্নতা অনেকটাই কম ।
জিজ্ঞেস করল , এখন কেমন লাগছে । হীরা জানাল একটু ভাল আগের চেয়ে । তারপরে নিজে আস্তে আস্তে উঠে বাথরুমের দিকে গেল । বাদলের মনটা শান্ত হল , তবে ভয় হচ্ছিল হীরা কোন্ কথার কি অর্থ করে সেটা ভেবে ; কারন ওর মন যে ভাল নেই সে জানে এবং একমাত্র সেই জানে তার কারন । অনেকটা সময় পরে বেরিয়ে এল সে , বোঝা যাচ্ছে কেঁদেছে সে ; মন হালকা করতে কান্নার কোন বিকল্প নেই ।
পরদিন প্রোগ্রাম আছে দুজনেরই । বাদল হাত মুখ ধুয়ে এল । হীরা তেমন সহজ হতে পারছিল না , বুঝতে পেরে বাদল খাওয়া গুলো সাজিয়ে নিল , কফির জন্য অর্ডার দিল ফোনে দুজনের । হীরা খুব অবাক হল , বলল , তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমার এসব খেতে ইচ্ছে করছিল ? লুকোন চকলেটগুলো বের করিয়ে দেখাল বাদল ; পরিবেশ হালকা করবার জন্য বলল ,আর এসব আমার জন্য ! তুমি পাবেনা একটাও ।
চোখে পানি নিয়েও হেসে দিল হীরা ।
বাদলের মন যে কত অস্থির হচ্ছে সেটা কি জানে কেউ , না জানে না । ক' বছর আগে হঠাৎ একদিন কেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল সে হীরার সাথে , সে কথা কি বিশ্বাস করবে ও ? সে কি আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পেতে পারে না হীরাকে সব , সব কিছু বলে দিয়ে !
হীরাকে ওষুধ এগিয়ে দিয়ে , পত্রিকাদুটো বের করে দেয় । তারপরে বলে এখানে একটা শাল আছে , যদি আমার উপর থেকে রাগ - অভিমান সরিয়ে ফেলতে পারো তো কাল সম্মেলন কেন্দ্রে পরে যেও । আমি তোমাকে কোন জোর করবো না , সে রাস্তা আমি নিজে বন্ধ করেছি । শালটা খুলে হীরার হাতে দেয় ।
টেবিলের উপর থেকে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ফিরে দেখে হীরা শালটা জড়িয়ে ফেলেছে গায়ে !
বিস্মিত মুগ্ধ বাদল , বিশ্বজয়ী বাদল ! কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ধন্যবাদ ।
সে তো কোনদিন আবেগকে প্রশ্রয় দেয়না , এখন আবেগপ্রবন হয়ে যাচ্ছে কেন !। আমি যাই বলে কোনরকমে বেরিয়ে আসে সে রুম থেকে , হাটতে থাকে নিজের রুমের দিকে যদিও মনে করতে বেগ পেতে হয় তার নিজের রুম নাম্বার । সেটা যদি আজ ৪১৬ হত !
চলবে ....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।