সমাজবদ্ধ কিংবা মুক্তকারাবদ্ধ এই আমরা শান্তির পথে হন্যে হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত
Tree of Hope, Remain Strong - Frida Kahlo
আমাদের পাড়ার যে ছোট্ট বেড়া দিয়ে বাঁধানো দোকানের দোকানদার গফুর মিয়া- এলাকার সর্বপ্রথম বাসিন্দা বলে সবাই জানে, উনি এখন চোখে মোটা চশমা দেন। পাড়ার মুরুব্বিরা মসজিদে যাওয়া-আসার পথে তাঁর দোকানে একটু করে থামেন- হালহকিকত জিজ্ঞাসা করেন। মাঝে মাঝে গফুর মিয়া শুনেন, মাঝে মাঝে শুনেননা। নাহ... উনার শ্রবণশক্তি এখনো এত খারাপ হয়নাই, তবে উনি যখন দোকানের পত্রিকা দিয়ে বানানো ঠোঙ্গাগুলার লেখাগুলা পড়ার চেষ্টা করেন- তখন উনার বাইরের দিকে মনোযোগ খুব কম থাকে। এলাকার মুরুব্বিরা জানেন গফুরের লেখাপড়া ওই কৌটা-প্যাকেটের নাম আর টাকা-পয়সা গোণা পর্যন্ত, মাল সদাই করতে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বলে অনেকেই আর এ দিকে ঠেকায় না পড়লে আসেননা।
কতজনে বলছে- “গফুর, এইবার তুমি ক্ষ্যামা দাও, দোকানের এতটুকুন জায়গাটা বেইচা দিয়া সেই টাকাটা দিয়া পোলার দোকানটা আরো বড় কইরা সাজাও, বুড়া বয়সটা পায়ে-পা দিয়া আরামে কাটাও”। গফুর হাসে – “কি লাগবো কন?” বলে এড়িয়ে যায়। কারে বলবেন তিনি? – এই ছেলেরে জন্ম দিতে গিয়া তার মা সেই যে কবে ৩০-৩২ বছর আগে মরে গেলো, সারাটা জীবন যাতে ছেলে সৎমায়ের সংসারে থেকে কষ্টে না থাকে সেই জন্যে আর বিয়েই করলেন্না। ছেলে গত ১০ বছর হয় বিয়ে করে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত, মাঝেমধ্যে ৩-৪ মাসে একবার এসে “টাকা লাগবোনি? শরীর ভালানি? ডাক্তার দেখাইছনি?” বলে কিছুক্ষণ থাকে, তারপর চলে যায়। গফুর মিয়া এখন বড়ই একা।
ফুলি- গফুর মিয়ার বউ, বাসর রাতে তারে একটা রুমাল উপহার দিছিলো। রুমালটাতে ফুলি লাল-নীল-কমলা রংয়ের সুতা দিয়া নকশা তুলছিলো, আর লেখছিলো-
“কথা দেন প্রাণভোমরায়,
যাবেননা কভু ছেড়ে আমায়।
ইতি আপনার বধু”
এই ৩০টা বছর দোকানে একটু জিরানোর সময়ে এই রুমালটা সামনে রেখে উনি খাওয়া-দাওয়া করেন, কল্পনা করেন ফুলি তার ছোট্ট হাতে হাতপাখাটা ধরে বাতাস করছে। গত ৩০ বছরে আমাদের এলাকাটা অনেক উন্নত হইছে, হাসপাতাল-কলেজ হইছে, বড়বড় খুপড়ির মত এপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরী হইছে – কিন্তু এত মানুষ থাকলেও গফুরের দোকানের সুঁই-সুতা খুব একটা বিক্রি হয়না বললেই চলে। কেউ বোধহয় আজকাল রুমালে নকশা তোলেনা, মনের কথা বলেনা।
ফুলিবানুর কথা মনে করেই কিনা কে জানে- গফুর মিয়া এখনো উনার দোকানে সুঁই-সুতা রাখেন, লাল-নীল-কমলা... হরেক রঙয়ের সুতা।
পদ্মাবতী গ্রামটা অনেক সুন্দর- পদ্মার পাড়ে অবস্থিত বলেই এই নাম। এ গ্রামেই নদীর পাশ দিয়ে একটা শনের ছাউনি দেয়া ঘরে থাকেন আয়শা খাতুন। ৭১ সালের যুদ্ধে স্বামীটারে হারান তিনি, আর ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের সময় নদীভাঙ্গনে ঘর ভেসে যায়- শত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলেন্না ছোট্ট মেয়েটারে ডুবার হাত থেকে বাঁচাতে। মানুষটা এখানে একাই থাকেন।
তাঁর একটাই মাত্র ছেলে জীবিত- শহরে বড় গার্মেন্টসে সিকিউরিটি গার্ড পোস্টে চাকরি করে। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সে বাড়িতে আসে- ১টা দিন থেকে পরের দিনই আবার শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সারাসপ্তাহ জুড়ে ছেলের জন্যে আয়শা খাতুন নানারকম জোগাড়যন্ত করেন – ঘরে নতুন শন দেন, বড় দেখে হাঁসের ডিমগুলা ছেলের জন্যে মাটির পাতিলে ঠান্ডা পানি দিয়ে চুবায়ে রাখেন, ইউপি মেম্বারের বাসায় কাজ করেন তিনি- ওখান থেকে মাঝেমাঝেই চেয়ে আনেন ডাব, কপাল ভালো থাকলে গরুর মাংসও পান মেম্বারের বউয়ের কাছে খোঁজাখুঁজি করলে। উনি জানেননা... ৪ মাস আগেই এক হরতালের সময়ে পিকেটার-পুলিশের গন্ডগোলের সময় পিকেটারদের ছোঁড়া এক হাতবোমায় উনার ছেলে গুরুতর জখম হয়, ৩ দিন হাসপাতালের বেডে বেহুঁশ থেকে মারা যায়। কোনো আত্মীয়স্বজনের লাপাত্তা না থাকায় বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশটা আঞ্জুমানে মফিদুলে দাফন করা হয়।
এতদিন হইলো ছেলের খবর নাই- তবুও দিশেহারা আয়শা খাতুন হাল ছাড়েন্না, ভাবেন – ছেলে হয়তো পদোন্নতি হয়েছে, ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। হয়তো কোনো মেয়ে মানুষের পাল্লায় পড়েছে- বিয়ে করে মা’কে ভুলে গেছে। যতদূর চোখ যায় নদীর দিকে তাকায়ে থাকেন- ছেলের নৌকা থেকে বেরিয়ে “মা” বলে ডাক শুনার জন্যে। দুপুরবেলা কাজকাম করে এসে চোখটা হাল্কা মুদে রাখেন, কানটা সজাগ রাখেন। মাঝেমাঝে নৌকা থেকে নামা মানুষের আওয়াজ শুনে মৃদুঘুমটা ছেড়ে দৌঁড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন- ঐ বুঝি খোকা এলো।
আয়শা খাতুনের মাটির পাতিল ডিমে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে, ঘরের কোণায় জমা হয়ে আছে ডজনখানেক ডাব, কয়দিন আগে চেয়ে আনা মাংসটাও ফেলে দেয়ার মত হয়ে গেছে। এখনো তিনি ঘরের চালে নতুন শন পাতেন।
গত ৭ বছর হয়েছে নিলুফার বেগম বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়েছেন। উনার ২ মেয়ের ১জনে কানাডায় থাকেন, আরেকজনে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। একটাই ছেলে – সে দেশে একটা এড ফার্মের মালিক।
ছেলের বৌও একজন সমাজকর্মী- পারিবারিকভাবে নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্যে কাজ করেন তিনি। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও প্রথম ২ বছর প্রায় প্রতি মাসেই নিয়মিত ছেলে-ছেলের বৌ এসে উনাকে দেখে যেতো। আস্তে আস্তে ছেলেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- সমাজকর্মী হিসেবে বৌটাও সারাদেশে বেশ সুনাম কামিয়েছে। স্বভাবতই ব্যস্ততা বেড়েছে তাদের – তবুও পরের ২ বছর তারা ৩-৪ মাসে হলেও একজন না একজন আসতোই উনাকে দেখতে। আর মেয়েগুলোতো স্বামী-সন্তান নিয়ে বিদেশেই পড়ে থাকে – ওরা আর এমুখো হবে আশা নেই আর – টেলিফোনেই কথা বলা ভরসা, যদিও সেটাও ইদানিং আরে অতটা নিয়মিত না।
ফেলে আসা দিনগুলার সুখস্মৃতি রোমন্থন করে আর নাতি নাতনিদের জন্যে উলের সোয়েটার বুনেই তাঁর বেশিরভাগ সময় কাটে। গত ৬ মাস ধরে উনার কাছে ১ মেয়ে মাত্র ১ বার ফোন করেছে, আর ছেলে-ছেলের বৌটারও দেখা নেই গত ১টা বছর। সবাই বেশ ভালোই করছে- পত্রিকা আর লোক মারফত মাঝেমাঝে ২-১টা ভালো খবর উনার কাছে আসে।
নিলুফার এখন যদিও জানেননা তাঁর নাতি-নাতনি কি নতুন হয়েছে কিনা, আগেরগুলো শরীরের মাপ কতটুকু হয়েছে সেটাও জানেননা- তবু তিনি মেয়েদের সাথে, ছেলে আর ছেলের বৌয়ের সাথে কি কি বলেবেন, কি অভিযোগ করবেন, কোন পুরাতন স্মৃতির কথা মনে করে একটু একচোট তাদের হাসিটা দেখবেন সেইটা বিড়বিড় করে আওড়ান। সাথে সাথে উল দিয়ে বুনে চলেন নানা সাইজের সোয়েটার, কানটুপি, দস্তানা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।