ফজরের আযানের কিছু সময় আগেই ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ান এখলাসুদ্দিন। এটা তার প্রতিদিনের অভ্যাস। শান্ত, ঘুমিয়ে থাকা, আঁধো আলো ফোটা চারপাশ দেখেন। এ সময়টাকে খুব পবিত্র একটা সময় মনে হয় তার। চারপাশ প্রায় ঘিরে থাকা দালান-কোঠাগুলোও পবিত্র মনে হয় তার কাছে।
সদ্য মায়ের যোনিপথ বেয়ে নেমে আসা শিশুর মত পবিত্র, এখনো ঋতুমতী না হওয়া চঞ্চল কিশোরীর মত পবিত্র কিংবা অক্ষতযোনি রূপসী, উচ্ছলা যুবতীর মত পবিত্র...। এখলাসুদ্দিন খুব ভালোবাসেন এই পবিত্রতায় নিজেকে অবগাহিত করতে। চার তালায় থাকার সুবাদে চারপাশের উচু দালানের ফাঁকে এক চিলতে আকাশ দেখার সুযোগ হয় তার। আকাশ দেখতে তার ভালো লাগে। যদিও আকাশ দেখে তার ভেতর সাহিত্যবোধ জাগে না, কারণ তিনি কখনো সাহিত্য পড়েন নি।
ছোটবেলায় বাবা একটা বই কিনে দিয়েছিলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’। কিন্তু সেই বই তার পড়া হয়নি। অল্প কিছুদিন পরই বাবা মারা যাওয়ার পর তার নানা [ যিনি গ্রামের মসজিদের ইমাম ছিলেন, এবং গ্রামে একটি মাদ্রাসা চালাতেন ] ‘হিন্দুয়ানী বই’ আখ্যা দিয়ে সেটা পুড়িয়ে ফেলেন। তার হাতে তুলে দেন ‘আল কোরান’। নানা’র কাছে, মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার।
এখলাসুদ্দিনের মা বেঁচে ছিলেন যে ক’দিন, মাঝে মাঝে ঘুম পাড়ানোর ছলে একটা-দুইটা গল্প বলতেন, গান গাইতেন। এই তার যা একটু সাহিত্যের কাছাকাছি আসা।
মা’র কথা তার খুব মনে পড়ে। বাবা’র স্মৃতি তার মনে খুব বেশি নেই। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন।
যেটুকু মনে আছে, তা মার’ই কথা। একদিন কি জানি কি হলো, তার মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। তিন মাস পর মারা যাবার আগ পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি। শুধু যেই দিন মারা গেলেন তার আগের রাতে এখলাসুদ্দিনকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকেছিলেন। তিনি কাছে যাবার পর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেন, বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কাঁদেন।
সেই কান্নাও নিরব। পরদিন সকালে তার মা’কে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অনেকে বলে চুপ করে থাকতে থাকতে দম আটকে মারা গেছেন, আবার কেউ কেউ বলতো আত্মহত্যা করেছেন। গ্রামের লোকজন বলাবলি করতো, তার নানা নাকি একদিন রাতে ঘরে ঢুকে তার মা’কে ধর্ষণ করেছিলেন। সেই থেকেই নাকি তার মা চুপচাপ।
মরণের সময় নাকি তার পেটে দুই মাসের একটা বাচ্চাও ছিলো। এখলাসুদ্দিনের বয়স তখন ছয় কি সাত। বেশ বড় হয়ে এই গল্পগুলো শুনেছেন। তিনি জানেন না, কথাটা কতটুকু সত্যি। এই অজাচারের গল্প তিনি কখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি, তবে তার মনে আছে, তার নানা মারা যাবার সময় তার হাত ধরে খুব কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি অনেক বড় পাপ করেছি।
আমাকে তুই মাফ করে দিস’।
এসব কথা ভাবতে গিয়ে এখলাসুদ্দিন বিষন্ন হয়ে যান। ভোরের পবিত্রতা তাকে এসব কথা মনে করিয়ে দেয়। মা’য়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর মধ্যেই আযান শুরু হয়।
এখলাসুদ্দিন চোখ বন্ধ করে খুব মনোযোগ দিয়ে আযান শোনেন। তিনি নামায পড়েন না, আল্লাকে মানেন না। তারপরও আযান শুনতে তার খুব ভালো লাগে। আর কোনো ওয়াক্তের আযান না, ফযরের আযান। শান্ত, ঘুমন্ত প্রকৃতিতে কেঁপে কেঁপে আসে আযানের ধ্বনি, পাখিরাও তখনো জেগে ওঠেনা, কিচির মিচির শুরু করে না।
আযানের শব্দে যেন ঘুম ভাঙ্গে প্রকৃতির। আধো ফোটা আলোও যেন আড়মোড়া ভেঙ্গে গায়ের উপর থেকে চাদর সরিয়ে দেয়, বের হয়ে আসে উদ্ভাসনায়। আযান শুনতে শুনতে এসবই ভালো লাগে এখলাসুদ্দিনের। এটাই তার নামায। মন্ত্রমুগ্ধ এখলাসুদ্দিন একটা অপার্থিব শান্তি বোধ করে এই সময়টায়।
মনের ভেতরের পঁচা, গলা বায়ু যেন নিঃশ্বাসের সাথে বের হয়ে যায়। তার আত্মা হয় পরিশুদ্ধ। এখলাসুদ্দিন পরিশুদ্ধতা পায় তার যাবতীয় পাপ থেকে। .........
( চলবে )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।