বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন
মহা বিপদে পড়ে গেছেন রহমত আলী।
অবশ্য তার হাতে এক কেজির মিষ্টির প্যাকেটটা দেখে কেউ বলবে না তিনি এখন ঘোরতর বিপদে। নেটের ব্যাগে হেলতে দুলতে সেটা রহতম আলীর সাথে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে।
মনটা তার আজ বিশেষ ভালো নেই। বিপদে পড়লে লোকে চোখে সর্ষে ফুল দেখে, অন্ধকার দেখে, কেউ কেউ ঝিলমিল তারা বাতিও দেখে।
তিনি দেখছেন বিপদ। শুধুই বিপদ।
দুটো টোকাই তার মিষ্টির প্যাকেটের দিকে লোভাতুর নয়নে তাকিয়ে। তিনি ব্যাপরটা খেয়াল করলেন। ওদিকে দিকে এলন।
মিষ্টি খাবে বাচ্চারা?
টোকাই দুটো সবিস্ময়ে একে অন্যের দিকে তাকায়।
তিনি প্যাকেট খুলে একটা মিষ্টি তুলে ওদের দিকে বাড়িয়ে দেন। বড় পিচ্চিটা নেবে কী নেবে না ভাবছিল। ছোট পিচ্চিটা ততক্ষণে মিষ্টিটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে টুপ করে মুখে পুরে ফেলেছে। তার অত ভাবাভাবি নেই।
ছোটজনের খাওয়া দেখে সঙ্কোচ কেটে যায় বড়টার। সেও মিষ্টি নেয়।
খাও! মিষ্টি খাও।
পিচ্চি দুটো মিষ্টি চিবুতে চিবুতে তকিয়ে থাকে হেঁটে যেতে থাকা রহমত আলীর পিঠ ও মিষ্টির প্যাকেটের দিকে।
আইবুড়ো মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না দেখে এমনিতে মহা বিপদের মধ্যে আছেন।
সকালে অফিসে ঢুকেই হাজিরা খাতায় সাইন করেন। তারপর যতটা সময় থাকেন ততক্ষণই মেয়ে সম্পর্কিত প্রশ্নের পর প্রশ্নে তটস্থ থাকেন। আপনার মেয়ের পাত্র দেখা হল? বিয়ে কবে খাচ্ছি ভাই? বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে। বেশি বয়সের মেয়ে কেউ বিয়ে করতে চায় না। তা বোর্ড স্ট্যান্ড করা মেধাবী মেয়ে।
বিয়ে হচ্ছে না কেন? একজন আবার রোজ পাত্রের খবর দিয়ে যায়। রহমত সাহেব, একটা ছেলে আছে আমার হাতে। বয়স একটু বেশি। তবে বংশ ভাল। মেয়ে পছন্দ হলে ওদের তেমন কোন শর্ত নেই।
শুধু লাখ পাঁচেক টাকা ছেলের ব্যাবসা বাড়াতে লাগবে। ওদের আপনার সাথে যোগাযোগ করতে বলি কী বলেন?
রহমত আলীর জানা আছে, সহকর্মীর তার আনা সব ভালো পাত্রগুলোর দাবী তিন, চার, পাঁচ লক্ষ টাকাই তার সাথে যোগাযোগের একমাত্র দেয়াল। তাই সে সহকর্মী দিনকে দিন আরও ভালো ভালো পাত্রের খোঁজ আনছেন!
ছোট মেয়েটারও বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। তার উপর গত পরশু বড় মেয়ের লজ্জিত মুখ আর স্ত্রীর কান্না জড়িত গলা থেকেই পেয়েছেন সংবাদটা। ছোট মেয়ের পেটে একজন ভোটার এসেছে।
বিপদ। বিপদ। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা রহমত আলী। জীবনটা তাকে সারাজীবন ঠকিয়েছে। যখন জন্ম নিয়েছিলেন রহমত আলী তখন তার বাবার অঢেল সম্পত্তি।
কিন্তু তিনি ছিলেন শেষ বয়সে মা-বাবার অসাবধানতার ফসল। ততদিনে অপর চার পুত্রের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে। সে সম্পত্তির উইল পরিবর্তনের আগেই বাবা মারা যান। ভাইয়েরাও এ কথা সে কথা শুনিয়ে সময় পার করে দেয়। রহমত আলীর মেলে না কিছুই।
জীবনের খাতায় তিনি যা পেয়েছেন তা হলÑ বড়সড় একটা শূণ্য!
তার এখন হাতও শূণ্য। স্ত্রী বলছিল ছোট মেয়ের বাচ্চা নষ্ট করিয়ে ফেলার কথা। তাও অনেক টাকার ব্যাপার। বাড়ি ভাড়া পড়ে আছে ছয় মাসের। বাড়িওয়ালা বিনীত মূখে বলে গেছেনÑ আপনাদের সমস্যা বুঝতে পারছি।
তা ছয় মাসের ভাড়া দিতে না পারলে দেবেন না। আমি কী জোর করেছি? তবে বাড়িটা আপনাদের সামনের মাসেই ছেড়ে দিতে হবে। আমি নতুন ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে এ্যাডভান্স নিয়েছি।
স্ত্রী বাজার করে নিয়ে আসতে বলেছিল। সাফ কথা, বাজার না আনলে রান্না হবে না।
সবার খাওয়া বন্ধ। পকেটে তাই তিনশটি টাকা ছিল আজ। তাই দিয়ে মিষ্টি কিনেছেন এক কেজি।
তিনি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছেন, বাজারের বদলে মিষ্টির প্যাকেট দেখে হতভম্ভ হবে স্ত্রী। বড় মেয়ে প্রতিদিনকার বিষন্নতা কাটিয়ে হেসে ফেলবেÑ বাবা! মিষ্টি কেন!! তোমার প্রমোশন হয়েছে বুঝি? ছোট মেয়েটাও হয়ত আড়ষ্টগলায় বলার চেষ্টা করবেÑ কোন ভাল খবর নাকি বাবা?
তিনি তখন কীভাবে বলবেন আসল কথাটা তাই নিয়েই বিপদে পড়েছেন।
এটাই এখন এ সময়ের সবচেয়ে বড় বিপদ। রহমত আলী ঠিক করেছেন মেয়েদের হাতে মিষ্টি তুলে দিতে দিতে বলবেনÑ মা রে? অফিস থেকে আজ আমাকে অবসর দিয়েছে। আই অ্যাম নাউ আ রিটায়ার্ড পারসন।
মিষ্টির প্যাকেটটা সেজন্যই কেনা। দুঃসংবাদ সু-সংবাদের মত পরিবেশন করলে হয়ত ওদের কষ্টটা কম হবে ।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে রহমত আলীর। ক্লান্ত পা দুটো টেনে চলেছে তাকে। তিনি বাসার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছেন।
রহমত আলীর ফেলা দীর্ঘশ্বাসটা বুকে এসে বেঁধে ক্যাকটাসের। যেন কাঁটা! আর সব দুঃখ কাঁটার মত সেটাও বিদীর্ণ করে ক্যাকটাসের বুক।
বারান্দা থেকে তাকে দেখছিল সে। আর দুই বাসা পড়ে রহমত আলীর বাসা। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জল গড়িয়ে পড়ে ক্যাকটাসের।
ক্যাকটাস... অশ্র“ বইয়ে দাও তোমার শেকড়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।