শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর।
রোমানদের দুঃখ:
বর্ষণমুখর এক সন্ধ্যা, চারদিকে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ, আমি খবরের কাগজ পড়ছিলাম। পাশেই তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া আমার মেয়ে ফারিন মনোযোগ দিয়ে অংক করছিল। তার কাঠপেন্সিলটা খাতার উপর গণিতের ধ্রুপদী সৌন্দর্যের সন্ধানে চষে বেড়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে দুলে উঠছে মায়ের হাতে বেঁধে দেয়া ছোট দুটি বেনী। হঠাৎ খাতা থেকে মুখ তুলে ফারিন বলল, "আব্বু, রোমানদের খুব কষ্ট ছিলো, না?"
গণিতের সাথে রোমানদের কষ্টের সম্পর্ক ঠিক বুঝতে না পেরে মেয়ের দিকে অবাক চোখে তাকাই।
"এই যে, রোমানরা একটা ছোট্ট সংখ্যা লেখার জন্য কতগুলো বর্ণ ব্যবহার করত! এই দেখো, ৩৮৭৮ কে রোমান পদ্ধতি লিখে কত পেয়েছি। " আমার সামনে খাতা তুলে ধরল ফারিন: MMMDCCCLXVIII।
রোমানদের দুঃখটা এবার বুঝতে পেরে মুচকি হাসলাম আমি। ফারিন তখন বলতে থাকল, "আর তাছাড়া একে দেখে চট করে বুঝার উপায় নেই এটি ৩৮৭৮। আবার লেখার সময় এটি অন্য বর্ণের সাথে গুলিয়েও যেতে পারে।
" মৃদু মাথা নেড়ে মেয়ের সাথে একমত হই।
"সেই তুলনায় আমাদের সংখ্যা কত ভালো! আর শূন্যটা কী সুন্দর! সহজে যোগ-বিয়োগ গুণ-ভাগ করা যায়। আচ্ছা বাবা, রোমানরা কিভাবে গুণ-ভাগ করত?"
প্রগাঢ় আনন্দে কোমল হয় আমার চোখ। আমার দুই মেয়ের জন্মের পর--বড়টি এবার অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে--চেয়েছিলাম গণিতের প্রতি তাদের মমতা গড়ে উঠুক। এই পৃথিবীতে শুধু আসা আর চলে যাওয়া নয়, জগতের সুশৃংখল নিয়ম আবিষ্কারে যে সর্বোত্তম পরিশুদ্ধ আনন্দ--আমার কন্যারা তা পাক।
মেয়েরা আমাকে নিরাশ করেনি।
"রোমান যোগ-বিয়োগ এবং বিশেষকরে গুণ ও ভাগ এত জটিল ছিল যে তারা Abacus নামে একটা যন্ত্র ব্যবহার করত। আমাদের ১৭৩ ×১০০ = ১৭৩০০ এর মত সহজ ছিলনা ব্যাপারটি। অসম্ভব জটিলতার কারণে কেউ কাগজ পেন্সিলে হিসেব না করে Abacus এর সাহায্য নিত, এমনকি খুব ছোটখাট হিসেব হলেও। "
বড় মেয়ে জেরীন ততক্ষণে পাশে এসে বসেছে।
"বলতো জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার কোনটি?" মেয়েদের কাছে আমি প্রশ্ন ছুড়ি। দুইবোন এক নাগাড়ে বলতে থাকে--কম্পিউটার, রকেট, মোবাইলফোন, মুদ্রাযন্ত্র, নিউটনের গতিসূত্র...।
"নিঃসন্দেহে এগুলো বড় আবিষ্কার। কিন্তু এ সবই সম্ভব হয়েছে একটি ক্ষুদ্র সংখ্যা ০'র ফলে। আর একে সাহায্য করেছে আমাদের দশ-ভিত্তিক বাকি অংকগুলি।
আজকে সমগ্র জ্ঞান-বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে ০'র ক্ষমতার উপর। তাই বলা যায় ০'র আবিষ্কার-ই সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। "
"কিন্তু শূন্য আবিষ্কার করার কী আছে বাবা? এটি তো ছিলই। " ফারিনের জোরালো প্রতিবাদ।
"না মামনি, এটি সবসময় ছিলনা।
খুব প্রাচীনকালে মানুষের গণিতের শূন্যের কোনো ধারণা ছিল না। তখন এটি ছিল কিছুই না। ধরো, তোমার বড় আপুকে আমি পনের টাকা দিলাম, বড় আপু আবার সেই পনের টাকা তোমাকে দিয়ে দিল। আপুর কাছে আর কত টাকা আছে?"
"কিছুই নাই। "
"ঠিক।
আবার তুমি এভাবেও বলতে পার: আপুর কাছে 'শূন্য' টাকা আছে। তাই না?"
"হ্যাঁ। "
"তারমানে যা কিছুই না তাকে তুমি শূন্যও বলতে পারো। কিন্তু প্রাচীনকালে মানুষ একে 'শূন্য' হিসেবে চিন্তা করেনি। তারা ভাবত যা 'কিছুই না' তা নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করা বোকামি।
কে চায় তার ভেড়া 'কিছুই না' হোক, টাকা-পয়্সা 'কিছুই না' হোক? আর এর ফলে শূন্যের ক্ষমতা তারা উপলব্ধি করতে পারেনি। তুমিই বলো, এই যে ৫০-এর ০, এটা কি 'কিছুই না'? এর কি কোন গুরুত্ব নেই?"
"আছে বাবা। "
"আচ্ছা, তাহলে বলোনা ০ কিভাবে আসলো?" দুইবোন দুইপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে।
০ নিয়ে বলা সহজ কথা নয়। কত হাজার বছরের মানব সাধনার ফল, কত সভ্যতায় পরিভ্রমণ, কতই না অরণ্য-জনপদে তার পথপরিক্রমণ! ০ কখনো পেয়েছে মানুষের ভালোবাসা, কখনো বা ঘৃণা।
বাইরে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে থাকে, আর দেয়াল থেকে বিশ্বমানচিত্রটি নামিয়ে নিয়ে আমি আমার মেয়েদের নিয়ে যাই প্রাচীন জ্ঞানীমানবদের কাছে... [চলবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।