বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুলের মাঠ এটি। এখানে সকাল থেকে সিপাহীরা অবস্থান নেয়।
বাংলাদেশ যখন আই.সি.সি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হলো; তখনকার কথা কি কারো মনে পড়ে? রাস্তায় রাস্তায় রঙের ছড়াছড়ি হয়েছিল! মানুষকে ঢালাও ভাবে সেদিন রঙে রাঙিয়ে ছিল তরুণ ছেলেরা। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুলে। পিলখানার তিন নম্বর গেটের বাইরে তখন নিউ পল্টনের দুষ্ট ছেলেরা ড্রেনের পানির সাথে রঙ মিশিয়ে মানুষকে ভেজানোর কাজে লেগেছে।
যেহেতু জাতির বিজয়ে এ আনন্দ তাই বি.ডি.আর দের চোখের সামনে ঘটনাটি হওয়া সত্ত্বেও তারা নিশ্চুপ ছিল। আমি তিন নম্বর গেটের ভেতরেই দাড়িয়ে ভাবছি কিভাবে বের হবো। যদি বের হই তাহলে ঐ নোংরা পানিতে গা ভিজবে [তখন আবার আমি খুব ভদ্র ছিলাম তো! এখন হলে সেই নোংরা পানির খেলাতে আমিও অংশ নিতাম]। তিন নম্বর গেটের একজন গার্ড আমাকে দেখে বললেন, আংকেলের বাসা কই?
আমি বললাম, ফার্মগেট।
তখন তিনি চুপ করে আবার দাড়িয়ে ছিলেন।
হঠাৎ সেনা বহন করার একটি খালি গাড়ি এসে থামে। তখন তিনি আমাকে ঐ গাড়ীতে উঠিয়ে দেন। বলেন, এই গাড়ি কেন্টনমেন্ট যাবে। ফার্মগেট হয়েই যাবে। তোমারে নামায়া দিবে।
বি.ডি.আর বিষয়টা আমার কাছে কখনও ভয়ের কিছু ছিল না। সাধারাণত আর্মি-বি.ডি.আর দেখলে সাধারণ মানুষ একটু অস্বস্তি বোধ করে। আর্মি দেখলে আমারও হয়। কিন্তু বি.ডি.আর দেখলে আমার খুব আপন মনে হয়। জীবনের সবচাইতে মজারদিন গুলো আমি কাটিয়েছি পিলখানায়।
স্কুল জীবন প্রতিটি মানুষের মনে রাখার মতো জীবন। আমার সেই জীবন কেটেছে পিলখানায় অবস্থিত স্কুল বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুলে। জীবনে প্রথম আড্ডা দিয়েছি ওখানেই। জীবনে প্রথম সিগারেট খেয়েছি পিলখানাতই। পুকুর বলতে কি বোঝায়! মাছ চাষ করা পুকুর দেখতে কেমন।
গরুর খামার দেখতে কেমন এসব কিছুই আমি দেখেছি পিলখানাতেই। স্কুল ফাকি দিয়ে পুরো পিলখানা ঘুরেঘুরে বেড়িয়েছি আমরা বন্ধুরা। একবারতো স্কুল পালিয়ে এক পুকুরে আড্ডা দিচ্ছিলাম আর সিগারেট ফুকার দায়ে বি.ডি.আর টহলদার আমাদের আটক করে। এবং শাস্তি হিসেবে ছিল স্কুলের প্রিন্সিপালের কাছে তুলে দেয়া অথবা কান ধরে ৫০০ বার ওঠ-বোস করা। আমরা দ্বিতীয় অপসানটাই বেছে নিয়েছিলাম।
কারণ, প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে গেলে আব্বু-আম্মুকে ডাকা হবে। তার আগে পাছায় কমপক্ষে ২০টা বেতের বাড়ি। তাই দ্বিতীয়টি। আমরা সেই টহলদ্বার অংকেলকে বললাম আমরা কান ধরে উঠ-বোস করবো। তিনি অবাক হলেন না।
স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ঠিকাছে শুরু করো। আমরা বিশজন বন্ধু তখন শুরু করলাম। দশবার হওয়া মাত্র তিনি বললেন, তোমরা করতে থাকো আমি আসছি। এসে যদি না পাই তাই বললাম খবর আছে।
তিনি চলে গেলেন।
আমরাও গাধাগুলা কানধরে ওঠ-বোস বন্ধ করলাম না। ১০০ বার হয়ে যাওয়ার পরও যখন দেখলাম তিনি আসছেন না; তখন বুঝলাম আমরা কি পরিমাণ গাধা। আমাদের সুযোগ দিয়েছেন ভেগে যাওয়ার কিন্তু আমরা গাধাগুলো ভাগছি না। যাইহোক। সু-বুদ্ধি হওয়ার পর ভাগলাম।
এবার আসি প্রেমের বিষয়ে। জীবনে প্রথম স্কুলে থাকতেই প্রেমে পড়েছি। আমাদের স্কুলের পাশেই ছিল একটি পুকুর। সে পুকুরের পাড়ে বসে আমি আর সেই মেয়েটি গল্প করতাম। মেয়েটি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল।
সেই পুকুর পাড়ে বসেই আমি তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলাম। আর সেই পুকুর পাড়েই প্রথম ছেকা খাওয়া। এ মেয়েটি নিয়ে একটু পরেই বলছি।
স্কুল থেকে আমি বের হয়েছি ২০০২ সালে। এস.এস.সি পাশ করার পর আমি বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচির সংগঠক হিসেবে কাজ করেছি টানা চার বছর।
তার মানে হিসাবটা গিয়ে দাড়ায়, ২০০৬ পর্যন্ত। তাহলে ১৯৯৬ থেকে ২০০৬। একদম কাটায় কাটায় দশবছর আমি নিয়মিত ভাবেই চলাফেরা করেছি পিলখানা এলাকায়। ঐ জায়গাটাকে বরাবরই মনে হয়েছে আমার নিজের একটি জায়গা। অসংখ্য স্মৃতি বিজড়িত জায়গাটিতে সংগঠক হিসেবে যখন যেতাম তখন প্রায়ই আমি একা একা মনোরম সেই পরিবেশটিতে হেটে বেড়াতাম।
আর পুরনো স্মৃতিটি আউড়ে বেড়াতাম। শুধু আমি না। আমার যত বন্ধু আছে সবাই সুযোগ পেলেই স্কুলের প্রাক্তণ ছাত্র পরিচয়ে পিলখানায় ঢুকে স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে বেড়ায়। স্মৃতি মনে করার জন্য পাশে কোনো বন্ধু না থাকলেও চলে।
এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের একজন ছাত্র।
অনেকদিন হয়ে গেছে স্কুলে যাওয়া হয় না। আজ হঠাৎ ভার্সিটিতেই শুনি পিলখানায় গন্ডগোলের কথা। সাথে সাথে কেন্টিনের টেলিভিশনের সামনে যাই। ঠিক তখনই আমার মোবাইলে সুদূর লন্ডল থেকে একটি এস.এম.এস আসলো। এস.এম.এসটিতে লেখা, আমাদের জায়গাগুলোতে নাকি গুলি হচ্ছে......
থমকে যাই।
সুদূর লন্ডন থেকে সেই মেয়েটি। যাকে ভালোবাসতাম একসময় সেও একই ভাবে মর্মাহত ঘটনাটিতে। আতংক আমাকে ছুঁতে পারেনি। মুহূর্তে ক্যাম্পাস খালি হলেও আমি যাইনি। ভেবেছি, ওরাতো আমাদেরই লোক।
কিন্তু যখন শুনলাম, বি.ডি.আর সেনারা সাধারণ মানুষের উপর গুলি করেছে। দুজন মারা গেছে। তখন খুব বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে করছিলাম, সেই বি.ডি.আর সেনার কথা। যিনি শুধু ড্রেনের পানি থেকে বাচার জন্য আমাকে তাদের বহরের গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন।
আজ সেই সেনারা রক্তের রঙে রাঙিয়েছে রাস্তা। সত্যিই আমি অবাক হচ্ছিলাম। আমার স্কুলের অধিকাংশ বন্ধুকে আমি ফোন করে খবর নিচ্ছিলাম। কারণ তারা অধিকাংশই আশেপাশের এলাকাগুলোতেই থাকে। আমার এক বন্ধু আছে।
বি.ডি.আর তিন নম্বর গেটের ঠিক কাছেই তার বাসা। ওদের বাসার ছাদ থেকে আমাদের স্কুল দেখা যেতো। তাকেও ফোনটা দেই। সে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, দোস্ত আমাদের মাঠটাতে এখন বন্দুক হাতে সিপাহী।
হতাশাটা তার মাঝেও।
দেশ কিংবা দেশের মানুষের অনুভূতির চেয়ে আমাদের কাছে এই বিষয়টি এতটাই হতাশা জনক যে আমার এক মেয়ে বন্ধু আমার সাথে কথা বলার সময় কেঁদে দিয়ে বলে, আমাদের স্মৃতিতে আজ গুলি কেনো।
ব্যাপারটা কেনো এভাবেই সবাই নিচ্ছিল বুঝতে পারছি না। স্মৃতিতে কেনো গুলি হবে! স্মৃতির জায়গাটাতো নষ্ট হবে না। তাও সেই অসাধারণ নির্মল জায়গার সাথে গুলি কিংবা বারুদের গন্ধটা যায় না। এটা হয়তো কেউ মেনে নিতে পারছে না।
আমি হয়তো না। সবাই উৎকন্ঠায় আছে। কিন্তু আমরা আছি কষ্টে। কেনো এই গুলি কিংবা কেনো এই রক্ত। যে মাঠে স্কুলের শিক্ষার্থীরা খেলে ধুলো উড়াতো।
সেই মাঠে এখন সিপাহীদের বুটের আঘাতে ধুলো উড়ছে। আর হচ্ছে থেমে থেমে গুলি।
-----------------------------------------------------------------------------
আমার সেই লন্ডন প্রবাসী বন্ধু; যাকে এক সময় প্রচন্ড ভালোবাসতাম। সে আমাকে কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়ে কাঁদছিল। কিছুই বলেনি।
চুপ করে শুধু কাঁদছিল। হঠাৎ বলল, প্রতিটি জায়গা আমাদের চেনা। চেনা জায়গাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ওরা বিদ্রোহ করছে তো আমার কেনো কষ্ট হচ্ছে!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।