আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাকেই কুঁরে খাচ্ছি আমি, প্রতিনিয়ত

কেউ কেউ একা

আমি আমাকে কুঁরে খাচ্ছি প্রতিনিয়ত। সময়ের দোলায় ভাসতে ভাসতে চলেছি নিরুদ্দেশের পথে। সেখানে নেই কোন কূল-কিনারা। জানিনা, এ যাত্রার শেষ কোথায়? আমাকে আমি ইদানিং চিনতে পারি না। পারি না আমার সত্তাকে চিনতে।

কে আমি? আমার গন্তব্য কোথায়? এ এক বড় প্রশ্নের মুখোমুখি আজ আমি। এক বড় ভাই আমার কিছু কথা শুনে বলেছিলেন, -চিন্তা করো না তুষার, এ জীবন কিছুই না। কিছুই যে না, তা আমিও আমিও জানি। কিন্তু ক্যাঙ্গারুর থলের মতো জীবনটাকে বয়ে বেড়ানো কত কষ্টের তা শুধু যে বেড়ায় সেই জানে। যেমন জানছি আমি।

আমার কষ্টগুলো জীবন্ত শরীরে সুঁচ ফোটানোর মতো মনে হচ্ছে? হতেই পারে। বড় ভাই আরো বলেছিলেন, -জীবনটা আনন্দের, কিছুই নিয়ে আসোনি তুমি। তাই হারানোর ভয় নেই। শুধু উপভোগ করে যাও। বড় ভাইয়ের কথাটা আমার মনে ধরেছিল।

টর্নেডোর অন্ধকারেও আমি দেখেছিলাম আশার আলো। সত্যি, আমি আমি কিছুই নিয়ে আসিনি। তাহলেতো আমার হারানোর ভয় নেই। কিছু কি রেখে যেতে চাই আমি? হয়তো বা। প্রত্যেকেরই এই আশা।

রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। বলেছিলেন, -মরিতে চাহিনা আমি সুন্দরও ভুবেন। রবীন্দ্রনাথ কেন, কেউই চায় না মরতে। আমার মতো যারা, ভীতু যারা, জীবনকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসে যারা, তারাই মরণকে ভয় পায়। আমিও পাই।

প্রচণ্ডভাবে। অথচ সেই মরণই আমাকে তাড়া করছে প্রতিনিয়ত। শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে। শুধু একটা ভুলের কারণে। না, আমার নয়।

ডাক্তারের। আমি তারই জন্য এখন পঙ্গু। নিরাশার আধার আমাকে গিলে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের মতো আমি ক্ষয়ে যাচ্ছি। সত্যি করে বলছি, ভুল ছিল না আমার এতোটুকু।

আমিতো বাঁচার জন্যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই ডাক্তারই আমাকে মেরে ফেলল। মেরে ফেলল এই কারণে বলছি, এখন আমি জীবন্মৃত। প্রতি নিয়ত মরণের সাথে যুদ্ধ করছি। মরছি মুহূর্তে, দিনে হাজার বার।

এই মরণ যে কতো বড় কষ্টের তা বর্ণনাতীত। মানসিকভাবে পঙ্গু আজ আমি। আমি পাই না জীবনের সেই স্বাদ। অথচ আমার এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ি। বিশ্ববিবেক কী তাই বলবে? একজন ডাক্তার একজন রোগীকে ১০ দিনের মধ্যে মেরে ফেলতে পারে।

কীভাবে? যদি তার মনোবল ভেঙ্গে দেয়া হয়। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ প্রচলন আছে- অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী। জানি, কিন্তু মানি না। মানব কেমন করে? ট্যাকে (টাকা) জোর না থাকলে মানা যায় না। যার টাকা আছে তার সবই হয়।

হ্যাঁ, সবই হয়। প্রতিদিন ৩৬ হাজার টাকার ওষুধ খেয়েও দুরারোগ্য ক্যান্সারকে ভয়ে ভয়ে রাখা যায়। কিন্তু আমি আর গ্রামের কৃষক ছমির উদ্দিনরা তা পারি না। ১৮ হাজার কেন, ১৮ টাকা খরচ করতে কষ্ট হয়। জানি- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান।

আর এই মৌলিক চাহিদারগুলোর পরই রয়েছে চিকিৎসার ব্যবস্থা। কিন্তু কতোজন চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে আমাদের দেশে? না, পাচ্ছে না অধিকাংশ মানুষই। পাচ্ছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। পেট ব্যথা করলেই যারা বিদেশে দৌড় দেয় চিকিৎসার জন্য তারাতো হাতে গোনা। কিন্তু গ্রামের কৃষক, পেট ব্যথা করলে ভাবে- কিছু হয়নি।

অথচ, তার নিজের অজান্তে বাসা বেঁধেছে শরীর মরণ ব্যাধি ক্যান্সার। তার কাছে এই ক্যান্সারের কোন ভীতি নেই। কারণ, সে জানতে পারে না এই ক্যান্সারের কথা। তার পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। অথচ আমি আমি দেখেছি একজন ধনীর জীবন চর্চায়- তিনি মাসে মাসে নিজের শরীরের অলিগলি পরীক্ষা করে আসেন সিঙ্গাপুর থেকে।

সামান্য এদিক ওদিক হলেই শুরু করেন চিকিৎসা। শত শত ডলার খরচ করে। কৃষক কিন্তু আজও জানে না এক ডলার মানে কতো টাকা। একদিন ছমিরউদ্দিনেরা মরে পড়ে থাকে। দুদিন কাঁদে ছেলেমেয়ে।

তারপর আবার শুরু হয় নিত্য দিনের মতো কাজ। কেউ তাদের মনে রাখে না। রাখার কথাও নয়। এই ছমিরউদ্দিনেররাই আমাদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। অথচ সে থাকছে নিরন্ন।

চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষকের মেয়ের বাড়ন্ত শরীর দেখে কুত্তার মতো হাঁপাচ্ছে আমাদের সাহেবেরা। কাজ দেবার অজুহাতে তাকে ধষর্ণ কিংবা বিদেশে পাচার করতে বিবেকে বাধছে না। প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। আসলে কি জানেন, আমি সুন্দর পৃথিবীটাকে সুন্দর কিছু দেখতে পাই না।

রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, নজরুলের.. আমি কিন্তু অন্যচোখে দেখি এই বাংলাকে। আমার চোখে কিন্তু একটা গ্লাসের খালি অংশটুকুই চোখে পড়ে, ভরা অংশটুকু চোখে পড়ে না। আমি একটু ঠোঁটকাটা ধরনের। সত্যি কথা বাবাকে বলতেও ভয় পাই না। তাই বলছি- বাংলাটা হলো স্বার্থপরদের বাংলা, এদেশের মানুষ হয়ে গেছে টাউট- বাটপার।

আমিও। পাশাপাশি এ কথাও বলতে আমার বাধে না- আমার বাবার মতো ভাল লোকেরাও আছে। আমার বাবা বলে তাঁকে আমি ভালো বলছি না। আমার বাবার একটি উক্তি শুনলেই আপনিও বলবেন- ভালো বাবার কথা। বাবা ঘুষ খাওয়া প্রসঙ্গে বলতেন- আমি আজ ঘুষ খাবো, কাল আমার ছেলেটা মারা যাবে, আমার ছেলে মাত্র একটা।

বলতে পারেন অনেকে- ঘুষ খাওয়ারও একটা যোগ্যতা লাগে। আমার বাবার ছিল না। আমি জানি ছিল। আমার বাবা ছিলেন সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ। টাউট-বাটপারের মধ্য আমার বাবার মতো মানুষরা আছেন বলেই আজও পাখি গান গায়।

বাতাস বয়ে চলে। এখনো খণ্ড খণ্ড লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। বিচার হয় ধর্ষণের। এতো কথা বলেই আমি এটুকু বোঝাতে চেয়েছি যে, মানুষ এখনো আছে। আর মানুষ আছে বলেই চলছে পৃথিবী।

কথা বলছিলাম ডাক্তার প্রসঙ্গে। আমার জীবনের কুঁরে খাওয়া প্রসঙ্গে। সুবিধা বঞ্চিত আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ। এদের সুবিধাগুলো আমাদের হিসেব করে দিতে হবে। মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে হবে।

আমার চোখের সামনে একটা লোক না খেয়ে মরে যাচ্ছে অথচ আমি একজন স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে হয়েও তা নীরবে মুখ বুজে সইবো? না, এটা মানুষ হলে হয় না। মানুষের ভেতরে থাকে জীবসত্তা আর মানবিক সত্তা। মানবিক সত্তা বিলোপ হলে জাগে জীবসত্তা। আর তার কারণেই মানুষ মানুষকে করে খণ্ড খণ্ড লাশ। আসলে আমাদের মানবিকতার শিরা উদাহ হয়ে গেছে শরীর থেকে।

এবার বলবো সোজা কথা। আমার গলা ফুললে গিয়েছিলাম পিজির এক ডাক্তারের কাছে। তিনি আমাকে দেখেশুনে বললেন, আপনার ক্যন্সার হওয়ার সম্ভবনা আছে। আমাকে পরীক্ষা করতে দিলেন অনেককিছু। আমি একা।

সঙ্গে কেউ নেই। ভেঙ্গে পড়লাম। ভেঙ্গে পড়ারই কথা। সবকিছু পরীক্ষা করতে দিয়ে আমি টিএসসি পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারিনি। আমার ভেতরে বাঁচার ইচ্ছাটা এমনভাবে বাসা বেধেছিল যে, মরণ কিছুতেই মেনে নিতে চাইছিলাম না।

উনি ছিলেন একজন ইন্টারনি ডাক্তার। পরীক্ষার রিপোর্ট দিতে চার দিন লাগবে। আমি সেই চারদিনে ৩ কেজি ওজন কমে গেলামা চিন্তায়। সব সময় কাঁদি। সবার কাছে ফোন করে বলি- আমি বাঁচতে চাই।

চার দিন পর আমি হাসপাতালে এলাম। রিপোর্ট পেলাম হাতে। সবকিছু স্বাভাবিক। মুখে হাসি এলো। রিপোর্ট নিয়ে গেলাম ডাক্তাররের কাছে।

তিনি দেখে শুনে আবার আমাকে পরীক্ষাগুলো করতে বললেন। এবার তিনি বললেন, কখনো কখনো লিভার ও ফুসফুসিতে ক্যান্সার হলে গলার কাছে ফুলে ওঠে। আমি এবার আরো টেনশানে পড়লাম। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে আমি। তাদের সামনে মরে গেলে তাদের পরিস্থিত কি হবে? আমি আর দেরি না করে স্কয়ারে গেলাম।

জাহাঙ্গীর আলম ( মেডিসিন) কে দেখালাম। তিনি সার্জারীর জোয়ারদারের কাছে আমাকে দিয়ে পাঠালেন বায়োপসি করার জন্য। গলা থেকে মাংশ নেয়া হলো। চারদিন কাটল দোজখের আগুনে। খবর ভালো এলো।

অদতরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে এই রকম হয়েছে আমার। ডাক্তার ওষুধ দিলেন। আমি আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠলাম। কিন্তু আমার ভেতর থেকে সেই ভয়টা দূর করতে পারলাম না। দিন দিন সেই ভয়গুলো আমাকে অক্টোপাশের মতো ঘিরে রাখে।

আজও। সব সময় মনের ভেতরে মনে হয় আমার ক্যান্সার হয়েছে। আমি এখন সম্পূর্ণ মানসিক রুগি হয়ে গেছি। আমি ডেল কার্নেগীর বই পড়েছি। আমি জানি, মানসিক টেনশান থাকলে সেটা কতো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে।

আমি জানি, এখন আমার একজন মানসিক ডাক্তারের সাহায্য প্রয়োজন। আমি যাবও। হয়তো মুক্তিও পারো। কিন্তু আমার মনের এই পরিস্থিতির জন্য আমি কি ওই অল্প বিদ্যা ভংঙ্করী ডাক্তারকে দায়ী করতে পারি না? আমি জানি না, একজন ডাক্তারকে কীভাবে শিক্ষা দেয়া হয়। তবে আমার মনে হয়, একজন ক্যান্সার রোগীকেও তার সামনে অসুখের কথা বলা ঠিক না।

একজন ডাক্তারের কথা অসুস্থ রোগী সুস্থ্য হয়ে উঠবে। আর এইসব ডাক্তাররা সুস্থ্য রোগীদের অসুস্থ্য করে তুলছে। আমার জীবনের একটি বাস্তব ঘটনা আমি এখানে তুলে ধরলাম। পাশাপাশি আরো কিছু প্রস্তাবনা রাখছি- আমাদের দেশে অনেক বড় বড় হাসপাতাল হয়েছে। অনেক বড় বড় ডাক্তার আছে।

আমি চাই- এ্যাপোলো, স্কয়ার, ল্যাব এইড, ইউনাইটে হাসপাতালসহ দেশের প্রত্যেকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রতিজন ডাক্তার সপ্তাহের একদিন দেশের রোগীদের বিনা পয়সার পরামর্শ দিতে হবে। এটা অনুরোধ নয়। দাবি। দেশ আজ ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে না হলেও স্বল্পমূল্যে তাদের ওষুধ সরবরাহ করতে হবে।

দেশের অত্যাধুনিক অপরারেশান থিয়েটারগুলোতে গরিবদেরও অপারেশ করতে হবে। সপ্তাহে একটা দিন যদি ডাক্তারা গরিবদের সেবায় না লাগে তাহলে আমাদের ছেলেদের ডাক্তার হয়ে দরকার নেই। আমি বাংলাদেশের বড় বড় হাসপাতাল ঘুরেছি। ডাক্তাদের সাথে পরিচয় ঘটেছে। আমি জানি, আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো ডাক্তার আছে।

কিন্তু তারা রোগীকে ঠিক মতো সময় দেয় না। রোগীরা বিদেশে যাবার এটা একটা বড় কারণ। ডাক্তার যদি সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক মনমানসিকতা নিয়ে ডাক্তরী করতে আসে তাহলে সে ডাক্তারের ডাক্তার না হয়ে একজন কসাই বা খুনি হওয়াই ভালো। এক একজন ডাক্তারের কাছে তিন চার মাসের আগে কোন সিরিয়াল পাওয়া যায় না। আবার ডাক্তারের সাহায্যকারীর হাতে দুশো টাকা গুঁজে দিলে আজই সিরিয়াল হয়ে যায়।

এই হলো আমাদের ডাক্তার আর ক্লিনিকগুলোর অবস্থা। এগুলোর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলছে না। কেউ কিছু করছে না। আমরা কী নীরবে এই ডাক্তারদের স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নেব? না, কখনোই না। এক ধরনের ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালে বসে বিকেল বেলা তাদের ক্লিনিকে যেতে বলে।

এই সব ডাক্তারদের সনদপত্র বাতিলসহ এরচেয়ে বড় ধরনের ব্যবস্থা সরকারের নিতে হবে। হাসপাতাল কতৃপক্ষের সবার সৎ হতে হবে। গরিব-দুঃখী চিকিৎসা নিতে এসে যদি হাসপাতালে ধর্ষিতা হয় তাহলে তারচেয়ে আর মর্মান্তিক ব্যাপার কি হতে পারে। দেশের তৃণমূল পর্যায় থেকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পাশাপাশি সবাই চিকিৎসা ব্যবস্থা পাক- এটাই আমার চাওয়া।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.