আমার পরানে যে সুর বাজিছে ...............
আমাদের হলে রঙ করা হবে। বাইরের দেয়াল রঙ করা হলো। ফান্ডে মনে হয় টাকা বেশী ছিল তাই ঠিক করা হল ছাত্রদের রুমও রঙ করা হবে। রঙ বলা ঠিক হচ্ছে না। চুনকাম করা হবে।
একসকালে কন্ট্রাকটর এসে বলল রুমের মালপত্র সরিয়ে নিতে। চুনকাম করা হবে। বাঙ্গালী ফ্রি পেলে কেরোসিন খায় আর এ ত চুনকাম। চুন যদিও খেতে দিবে না কিন্তু দেয়ালে লাগিয়ে দিবে বিনা খরচায়। পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়া মিস হয় না কোনো বছর।
সুতরাং আমি বড় গলা করে বলতেই পারি আমি মনে-প্রানের শুধু মনেই বাঙ্গালী( প্রানে বাঙ্গালী কিনা সেটা নিশ্চিত না)।
যা হোক ফ্রি পাবার লোভে আমরা সাথে সাথে রাজি। কন্ট্রাকটরের কথা-মত সমস্ত মালপত্র বারান্দায় সরিয়ে নিয়ে গেলাম।
সারাদিন চুনকাম করা হল। এইসময়টা আমাকে বসে থাকতে হল বারান্দায়।
চুনকামের শেষে বুঝলাম কন্ট্রাকটর নিজেও বাঙ্গালী। সত্যি বলতে কি আমার চেয়ে বেশী বাঙ্গালী। হারামজাদা চুনের সাথে কোন ধরনের আঠা ব্যবহার করে নি। হাত দিতেই সমস্ত চুন উঠে চলে আসে।
(পাঠকদের ভিলেনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল।
কন্ট্রাকটরই কাহিনীর ভিলেন। থাক আসল কথায় চলে আসি। )
মালপত্র রুমে ফেরত নেবার সময় দেখি ফ্লোর চুনে সয়লাব। সময়মত তিনজন বয়স্কা মহিলা চলে এল। এরা চুনকামের সময় দেয়াল পরিষ্কার করে দিয়েছিল।
কন্ট্রাকটর দেখলাম বাঙ্গালী হতে জার্মান হিটলারে রুপান্তরিত। তার কড়া হুকুমে মহিলারা ঘষে ফ্লোর পরিষ্কার করে দিল।
কন্ট্রাকটর যে বাঙ্গালী এবং আমার চেয়ে বড় বাঙ্গালী আবার তার প্রমান পেলাম একটুপর। তিনজন মহিলার ভিতর নেত্রী গোছের একজন এগিয়ে এসে আমাদের হড়বড় করে যা বলল তার সারমর্ম হল এইযে তাদের সাথে কন্ট্রাকটরের চুক্তি হয়েছে দেয়াল পরিষ্কার করা। ফ্লোর পরিষ্কার করার কোন কথা হয় নি।
সুতরাং এই অতিরিক্ত কাজের জন্য আমাদের টাকা দিতে হবে।
আমার বাঙ্গালী মন খচ করে উঠল। টাকা দিব কেন?
আমি মিন মিন করে একটু প্রতিবাদ করতেই মহিলার মুখের ভাব, মুখের ভাষা এবং শারীরিক ভঙ্গি পোড় খাওয়া যোদ্ধার মত হয়ে উঠল। (আমাজন যোদ্ধা আর কি। একই নারী- একই অঙ্গে কত রূপ)।
আমি সারাদিন বারান্দায় বসা। এত কষ্টের কোন ফল নেই। রুমের অবস্থা খুব খারাপ। চুন সব উঠে আসছে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। এখন আবার পকেট থেকে টাকা বের করতে হবে।
আমার মন তখন ফ্রি লোভী বাঙ্গালী থেকে কূটবুদ্ধির ব্রিটিশ মনে রুপান্তরিত। আমি মনে মনে মহিলাটিকে একটা দুই অক্ষরের গালি দিলাম।
আমি কন্ট্রাকটরকে খুজতে লাগলাম । কন্ট্রাকটর ব্যাটা কই? দেখি শালা আশে-পাশে কোথাও নাই। সে বড় ব্রিটিশ।
আমি তখন কিছুটা বিভ্রান্ত। ব্যাটা দেখি সর্বক্ষেত্রে আমার চেয়ে এককাঠি সরেস। হিটলারের মত হুকুম দিয়ে টাকা দেয়ার সময় পালিয়েছে।
এদিকে আমাজন যোদ্ধারা আমাকে ঘিরে ধরেছে। তাদের টাকা দিতেই হবে।
দরিদ্র এই নারীদের টাকার দাবী অতি সামান্য। এটা জেনেও আমি অস্বীকারের চেষ্টা করছি। কেননা আমি প্রতারিত। যা ফ্রি পাবার সেটা আমি পেয়েছি। কিন্তু চুন ত না খেতে পারলাম না সেটা দেয়ালে আটকিয়ে থাকছে।
আমি কূটবুদ্ধির ব্রিটিশ থেকে রুপান্তরিত হয়ে জার্মান সেনাপতির মত গর্জনের চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমাজন যোদ্ধারাও কখন যেন মিত্রপক্ষ হয়ে গেছে। মিত্রপক্ষের প্রবল বিক্রমে আমি পরাজিত। তাদের টাকা দিয়ে দিলাম। আমাজন নেত্রী একটা হাসি দিল টাকা পেয়ে।
দেখলাম যোদ্ধাকে হাসলে খারাপ লাগে না দেখতে।
আমার মুড মেজাজ খারাপ। সন্ধ্যার দিকে অফ হওয়া মুড অন করতে বের হলাম। রাস্তায় বের হয়েই দেখি আমার সহপাঠি আর সহপাঠিনী হাত ধরা-ধরি করে হাটছে। আমার মনে হল এরা কত সুখী।
আমার কেন সুখ নাই? থুতু ফেললাম রাস্তার সাইডে। ( নজর যেন না লাগে সেজন্য থুতু মারা। আমার নানী আমার মুখে হাল্কা থুতু দিত। এতে নজর বা মুখ লাগে না। আমিও তাদের মুখেই থুতু মারব ভেবেছিলাম।
কিন্তু ভেবে দেখলাম দুনিয়ার কোন শালার ভাল করতে নাই। রাস্তার পাশেই ফেলি থুতু। )
ইতস্তত ক্যাম্পাসে ঘুরছি মুখ কালো করে। হঠাৎ দেখি মিত্রপক্ষ বা আমাজনের যোদ্ধারা। সাথে একজন অল্পবয়স্ক মেয়ে( পচিশের মত হবে, আমার বয়স তখন পচিশ হয় নি)।
আরেকটা ছোট ছেলে। ছেলেটার গায়ে জামা নাই। একটা প্যান্ট পড়া। প্যান্টটা আবার সাইজে বড়। তাই কোমড়ে বেল্টের বদলে একটা দড়ি বাধা।
দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে ছেলেটা গম্ভীর মুখে হাটছে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট প্রফেসর। অংকের কোন জটিল সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছে। (কোন স্যারকে দেখে স্টাইলটা শিখেছে। প্রমথ বাবু ত এমনি এমনি বলেননি ব্যাধি সংক্রামক,স্বাস্থ্য নয়। )
পিছনের চারজন মহিলাই ছেলেটার কাজকর্মে মুখ টিপে টিপে হাসছে।
ছেলেটা পিছনে তাকালেই তাদের হাসি বন্ধ। আমি লক্ষ্য করে দেখি তিনজন বয়স্কা মহিলাকে আর আমাজন সোলজার বা মিত্রপক্ষের হিংস্র সৈন্য মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে স্বর্গের চার দেবী নেমে এসেছে মর্ত্যে আর ছোট ছেলেটা একটা কিউপিড। আমি অবাক হয়ে দেখছি। মুগ্ধ হয়ে দেখছি।
এদের হাসিতে যে মাধুর্য সেটা আমার ত নয়ই, আমার সহপাঠিনীর মুখেও ছিল না। আমি এবার আর রাস্তার পাশে থুতু ফেললাম না। স্বর্গের কারোর উপর কখনো নজর পড়ে না।
সেদিন আমি সত্যিকার অর্থে প্রথমবারের মত বুঝতে পেরেছি ভালো ভাবে বেচে থাকার জন্য ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী লাগে না বা ভালো কোন জায়গায় চাকুরী লাগে না। যেটা লাগে সেটা হল ভালোবাসা।
চারপাশে সেটা ছড়ানো অফুরান। অন্ধ আমরা সেটা দেখতে পাই না। তাই এত পরিশ্রম এত কষ্ট। এত কিছু থাকার পরও ভালোভাবে বাচতে পারি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।